বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

তৃণমূল ও বিজেপির সম্পর্কের টানাপোড়েন

তৃণমূল ও বিজেপির সম্পর্কের টানাপোড়েন

স্থপতি রায়

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ নভেম্বর, ২০২১— মমতা বন্দোপাধ্যায় আগে সদম্ভে এবং সদর্পেই প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন, বিজেপিকে সঙ্গে নিয়েই বামফ্রন্টের পতন ঘটাবেন। ১৯৯৮এ কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে পৃথক দল তৈরি করেন, সেই সময়ের কথা। অভিযোগ ছিল, কংগ্রেস দল বিচ্যুত হয়েছে তার নীতি থেকে, তাই বিতন্ডা করে বেরিয়ে গিয়ে বিজেপিতেই আশ্রয়।
কংগ্রেসে যে কর্তৃত্বের তিনি দাবিদার হয়ে ওঠেন, কংগ্রেস সেই জায়গাটা তাঁকে ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না। তাই কংগ্রেসের মধ্যেই একটা প্রতিবাদী চেহারা নির্মাণ করে আপন উচ্চাশা চরিতার্থ করার কৃতিত্ব তাঁরই। এই নির্মাণটুকু হাতে পাওয়াই যথেষ্ট ছিল তাদের জন্য যারা পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতির বিস্তারে চরম উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছিলেন এবং এমনই একজনই ছিল তাদের জন্য বড় আবিষ্কার। বাকি নির্মাণের দায়িত্ব হাতে তুলে নেয় বিভিন্ন ঘরানার মিডিয়া হাউস, সঙ্ঘের রাজনৈতিক শাখা ও ধান্ধা পুঁজির প্রতিনিধি। আর অল্প বয়সেই এ বোধ হয়েছিল যে ভঙ্গিসর্বস্বতা দিয়েএই বঙ্গে, এমনকি এই দেশে অনেক সহজেই বড় জায়গা করে নেয়া যায়। যত সময় এগিয়েছে এইসব কৃতকৌশলের পটুত্ব ততই বেড়েছে। অতি স্থুল কীর্তি, এমনকি নির্বোধ কার্যক্রমও যখন বাহবা কুড়িয়েছে, ততো স্ফীত হয়েছে আত্মবিশ্বাসের ফানুস।
বিবিসির কাছে সাক্ষাৎকারে তৃণমূল নেত্রী বলেন, বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস পরস্পরের স্বাভাবিক মিত্র। সঙ্ঘের ক্রিয়াকলাপে তাঁর মুগ্ধতা অজ্ঞাত ছিল না। বিজেপির অতি দক্ষিণপন্থী, মৌলবাদী ও বিভেদকামী রাজনীতি তৃণমূলের বাহিনী ও নেতৃত্বকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। তৃণমূল জোট বাঁধে আরএসএস পরিচালিত বিজেপির সঙ্গে। ভয়াবহ মৌলবাদী ও হিন্দুত্ববাদী এই ফ্যাসিষ্ট রাজনৈতিক দলটির সঙ্গে জোট করে মমতাই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে প্রথম প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এই জোটের মাধ্যমেই পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভয়াবহ রাজনীতি প্রসারিত হয়েছে। ইতিপূর্বে ১৯৯২এ, তখনও তিনি কংগ্রেসে, হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টরা যখন অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধুলিসাৎ করে দিল, চারদিকে ধিক্কারের মধ্যেই, তাঁর কন্ঠস্বর শোনা গেল না।
১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি মমতা ব্যানার্জী তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিজেপির সঙ্গে জোট করে ভিড়ে গেলেন কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতার ভাগ পেতে।
১৯৯৮-৯৯ বাজপেয়ীর ১৩ মাসের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার সময় মমতা রেলওয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারপারসন। রেলওয়েকে ব্যবহার করে রাজ্যে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার সূত্রপাত তখনই। ১৯৯৯ এ বাজপেয়ীর তৃতীয় মন্ত্রীসভায় মমতা রেলমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গে নিজের প্রতিষ্ঠার কাজে রেলওয়েকে তছনছ করে ব্যবহারে লেগে পড়লেন তিনি। সে সব নিয়ে আলোচনা অবশ্যই আর একটি প্রবন্ধের বিষয় হতে পারে।
২০০১ এ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচন। বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে সুবিধা হবে না বুঝে বিজেপিকে ছেড়ে রাজ্যে কংগ্রেসের হাত ধরেছিলেন। বঙ্গীয় মিডিয়া ধুয়া তুলেছিল, 'হয় এবার নয় নেবার'। কিন্তু বামফ্রন্টই বিধানসভায় জয়ী হয়। অবশ্য পাশাপাশি তিনি কলকাতা কর্পোরেশনে বিজেপির সঙ্গে জোট অক্ষুন্ন রাখেন। তৃণমূলের সুব্রত মুখার্জী মেয়র, বিজেপির ডেপুটি মেয়র মীনাদেবী পুরোহিত।
কিন্তু তাঁর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। ক্ষমতাহীন, মন্ত্রিত্বহীন দিনযাপন। তাই কোনও অজুহাত না দেখিয়েই তৃণমূলনেত্রী কংগ্রেসের হাত ছেড়ে ফিরে গেলেন বিজেপির সঙ্গে, সরকারি দলে। কিন্তু গিয়েই মন্ত্রীত্ব ফিরে পেলেন না।
২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার ভয়াবহ ও নৃশংস ঘটনাবলীতে যখন সর্বত্র বিজেপি ধিক্কৃত তখন মমতা তাঁর তৃণমূল দল নিয়ে বিজেপির সঙ্গী। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে যখন বিবেকবান মানুষ গুজরাটের মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে ধিক্কার জানাচ্ছে তখন তিনি নীরব দর্শক। আর কিছুদিনের মধ্যেই গুজরাট নির্বাচনে জয়ের জন্য মোদিকে অভিনন্দন জানিয়ে উপহার পাঠান পুষ্পস্তবক।
২০০৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বাজপেয়ীর মন্ত্রীসভায় আবার মমতা। এবার দপ্তরবিহীন মন্ত্রী।
২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর নয়া দিল্লিতে আরএসএস-এর মুখপত্র "পাঞ্চজন্য"র সম্পাদক তরুণ বিজয়ের লেখা একটি বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তৃণমূল নেত্রী দীর্ঘ ভাষণে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন আরএসএসকে। বলেছিলেন: “আপনারা প্রকৃত দেশপ্রেমী। আমি জানি আপনারা দেশকে ভালবাসেন।” এইচ ভি শেষাদ্রি, মোহন ভাগবত, মদনদাস দেবী, বিজেপি রাজ্যেসভা সদস্য বলবীর পুঞ্জ প্রমুখের উপস্থিতিতে মমতা বলেন, “একসঙ্গে এতজন আরএসএস নেতার সঙ্গে আমি আগে বৈঠক করিনি। তবে ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করেছি।” আরও অনেক প্রশস্তিবাক্য বর্ষণ করেন। “কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে” তিনি আরএসএসকে সমর্থন করবেন, একথাও তৃণমূল নেত্রী খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছিলেন। প্রত্যুত্তরে বলবীর পুঞ্জ তাঁর ভাষণে বলেন, "হামারি মমতাদি, সাক্ষাৎ দূর্গা।" (সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৪)।
বাজপেয়ী মন্ত্রীসভায় এরপর দপ্তর পেলেন মমতা ব্যানার্জী ২০০৪ সালের ৯ জানুয়ারি। কয়লা ও খনি দপ্তর।
প্রসঙ্গত দ্য টেলিগ্রাফ, ৬ অক্টোবর ২০১৪ সালের একটি সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাক: "বাংলায় বাম শাসনের ৩৪ বছরে বহু আরএসএস শাখা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গত তিন বছরে (অর্থাৎ তৃণমূল শাসনকালে) সংশ্লিষ্ট সংস্থার সেই প্রবণতা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণবঙ্গে বর্তমানে ১১০০টি এবং উত্তরবঙ্গে ৪২৫টি আরএসএস শাখা নতুনভাবে কাজ শুরু করেছে।"
২০০১ সালে বিজেপি থেকে বেরিয়ে এসে তৃণমূল নেত্রী রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের কৌশল নির্ধারণের জন্য নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে যে কনভেনশনের আয়োজন করেছিলেন তাতে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় এবং বিজেপি সভাপতি লালকৃষ্ণ আদবানি। সিদ্ধার্থশংকর সভায় জানান, “মমতাই আমার যোগ্য উত্তরসূরী। আমি এখন থেকে এই কথাটাই বিভিন্ন সভায় বলতে চাই।” তিনি আরও বলেন, “সিপিএমকে কিভাবে হারাতে হয়, তা ১৯৭২ সালে আমি দেখিয়ে দিয়েছি।” মন্ত্রগুরুর এই শিক্ষা তিনি সারাজীবন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। গত শতকের সাতের দশকের এই হন্তারক মানুষটিই সারাজীবন তাঁর আদর্শ মানুষ এবং শিক্ষাগুরু। ঐ মানুষটির পদাঙ্ক অনুসরণ করেই রাজ্যটিকে নির্মম স্বৈরাচারী শাসনের মডেল বানিয়েছেন। রাজ্যের প্রশাসনকে অমেরুদন্ডী, পুলিশকে দলদাস, রাজ্যজুড়ে সর্বব্যাপক দুর্নীতি, রাজ্যকে খুন জখম রাহাজানি ধর্ষণ লুঠের রাজধানীতে পরিণত করা, এক অংশের বুদ্ধিজীবীদের ক্রীতদাস এবং মিডিয়ার বড় অংশকেই আজ্ঞাবাহী পদাঙ্কানুসারী, নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রহসনে পরিণত করা, গণতন্ত্রকে পদদলিত করার সার্বিক কৃতিত্ব অবশ্যই এই দলটি এবং তার নেত্রী দাবি করতে পারেন। দু:খের বিষয়, অভিধানে এই সরকারের চরিত্র বিশ্লেষণের জন্য শব্দভান্ডার যথেষ্টই অপ্রতুল। অর্থনীতি-রাজনীতির কৃতকৌশলে একটিই দৃষ্টিকোণ: যতদিন আছি, ঋণ চলুক; ঋণের টাকার লুন্ঠন চলুক, ঋণের টাকাতেই চলবে ভোটব্যাঙ্ক সংরক্ষণ ও নিশ্চিতিকরণের কর্মসূচি, ক্লাব-পুজো অনুদান আর অনুদান নির্ভর সার্বিক রাজনীতি। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু দুই ধর্মীয় মেরুকরণের সুকৌশল প্রয়োগ, দুই মৌলবাদী শক্তিকেই প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার। গোয়াতে সফরকালে তৃণমূল নেত্রী, সংবাদ মাধ্যমের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ৬২ শতাংশ হিন্দু অধ্যুষিত গোয়ায় বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাস্তায় হেঁটেই তিনি বিভিন্ন হিন্দুমন্দিরে পুজো দিতে যাচ্ছেন। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালও কেমন হিন্দুত্ববাদী ক্রিয়াকলাপের শ্লোগান তুলছেন, সর্বক্ষণ “জয় শ্রীরাম"ধ্বনি তুলছেন। দেখা যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি শুধু বিজেপির একচেটিয়া নয়, সঙ্ঘ অনুরাগী মমতা বা আপের হকও থাকতে পারে।
তৃণমূল শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার পদদলিত। অফিস, কারখানায় সর্বত্র রাজ্যে সবধরনের আন্দোলন ধর্মঘট কার্যত নিষিদ্ধ। রাজ্যের সরকারি  কর্মচারীদের দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলা পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়ে যায়, স্বীকৃত ইউনিয়নের নেতাদের ধরে ধরে বদলি করে দেয়া হয় দূর দূরান্তরে। মালিকদের আশ্বস্ত করা হয় কোনও আন্দোলন ধর্মঘট হবে না। এমন কি মোদি সরকারের শ্রমজীবী বিরোধী আক্রমণের বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় স্তরে কেন্দ্রীয় ট্রেডইউনিয়নগুলির ডাকা ধর্মঘট নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে, বিজেপি শাসিত রাজ্যেও যে নির্মমতা পরিলক্ষিত হয় নি। স্মরণে থাকবে, তৃণমূল সরকারের প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে, এপিডিআর চৌরঙ্গীতে একটি প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছিল, ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। মমতার পুলিশ বাতিল করে দেয় সেই জমায়েৎ। মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন, এত করে আমরা কি ফ্যাসিবাদীদের ডেকে আনলাম?
ফ্যাসিবাদীদেরই ডেকে আনা হয়েছিল। তবে সেই বোধোদয় এখনও এক শ্রেণীর আধাবিপ্লবীদের হয়েছে মনে করার কোনও কারণ নেই।
ইতিমধ্যে কিছু পটপরিবর্তন ঘটেছে। সেদিকে একটু দেখে নেয়া দরকার।
তৃণমূলনেত্রী কোনও প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বিজেপি ইলেকশন করে, আরএসএস তো ইলেকশনে নেই। আমি তাই আরএসএস-এর সঙ্গে আছি।
২০১১ সালের ১৩ মে বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়েছিল। ১৪ মে আনন্দবাজারের অনুরোধে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পরামর্শ: “আদরনীয় মমতাবেন, প্রথমেই আপনাকে আমার অভিনন্দন। আপনার কাছে আমার গগনচুম্বী প্রত্যাশা। কিন্তু প্রথমেই বলি, আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একথাটা বললাম।... আপনি একজন দৃঢ়চেতা মুখ্যমন্ত্রী, আপনার বুদ্ধিমত্তা(র)... উপর আমার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। কিন্ত প্রশাসনে কঠোরতা খুব আবশ্যক। এই কঠোরতা শুরুতেই আপনার কাছ থেকে প্রত্যাশা করি।” বুঝেছেন: প্রথম রাতেই বিড়াল মেরে দিন।
নরেন্দ্র মোদির এই পরামর্শ ছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর কাছে বড় পাথেয়।
কলকাতার ব্রিগেডে বিজেপির লোকসভা নির্বাচনী প্রচার সভায় ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ নরেন্দ্র মোদি ডাক দেন: “বিকাশের মন্ত্র নিয়ে আমরা এগোচ্ছি। আমাদের সুযোগ দিলে পশ্চিমবঙ্গের দু-গুণ তিন গুণ ফয়দা হবে। মমতা বন্দোপাধ্যায় রাজ্যের জন্য উন্নতি করবেন। কেন্দ্র থেকে আমি এই রাজ্যের উন্নতি করব। আমাদের মাথার উপর প্রণবদা আছেন, উনিও করবেন।" মমতাকে বলেন, "৩৫ বছর ধরে যে দল এই রাজ্যকে শেষ করেছে, সেই দলকে বিদায় করেছেন আপনি। এর জন্য অভিনন্দন জানাই।” (এই সময়, ইন্টারনেট সংস্করণ, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)।
ব্রিগেডের সভায় বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি রাজনাথ সিং বলেন, “সিপিএম বাংলার কোষাগারকে চৌপাট করে দিয়ে গেছে। মমতা ব্যানার্জী ইউপিএ সরকারের কাছে তিন বছরের জন্য ঋণশোধ স্থগিত রাখার যে আবেদন জানিয়েছিলেন তা কেন্দ্রের মেনে নেওয়া উচিত ছিল।”
মমতা ব্যানার্জী বাজেট বক্তৃতায় ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বিধানসভায় বলেন, “এই সরকার (ইউপিএ) বিদায় নিক। নতুন সরকার আসবে। তখন কথা বলে ঋণ কাঠামোর রিস্ট্রাকচার করা হবে।” মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় আরো বলেন, “কেন্দ্রের নতুন সরকার সুদ মুকব করার পর তিন বছর সময় পাবো। তারপর, অল উইল বি গোল্ড। স্বর্ণযুগের বাংলা ফিরিয়ে আনবো।”
বিজেপিকে ডেকে আনার ভাষা আর কি হতে পারে? উল্লেখ্য ২০১৪ লোকসভার যে নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য কর্পোরেট মহল কোটি কোটি টাকা খরচ করেছিল, সেই নির্বাচনেই পিকে ছিলেন বিজেপি বা নরেন্দ্র মোদির দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কৌশলী। সেই সাফল্যের কৃতিত্বের পর নীতিশ কুমারকে পার করে মমতার দায়িত্ব বর্তায় তাঁর উপর। এখন তিনি মমতার বাঁধা কৌশলী। ত্রিপুরা বা গোয়ার আশু দায়িত্বও তাঁর। যখন পিকের নেত্রী দেশ থেকেই বিজেপি হটানোর জন্য বদ্ধপরিকর, গোয়ায় তৃণমূলের কৌশলী মমতাসঙ্গী পিকে, গোয়াতেই ২৯ অক্টোবর, ২০২১ ঘোষণা করেন, বিজেপি থাকতে এসেছে, আরও কয়েক দশক থাকবে বিজেপি। নিজেরই কৌশলী এমন কথা বলছেন। কেন?
গত কয়েকবছর হঠাৎ-ই তৃণমূল নেত্রীর গলায় বিজেপি বিরোধী কথা শোনা যাচ্ছে। তার আগে ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে এই দুটি দলের বাইনারি বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঐ ৫ ফেব্রুয়ারির বিগ্রেডের সভায় নরেন্দ্র মোদি বাংলার মানুষকে একই 'লাড্ডু' দু'ভাগ করে দুটো 'লাড্ডু'র কথা বলেছেন - একটা 'লাড্ডু' রাজ্যে 'তৃণমূল সরকার', অন্যটা দিল্লিতে 'বিজেপি সরকার'। বলেছেন, বিজেপি তৃণমূলের দীর্ঘদিনের বন্ধু।
২০১৪ সাল, যখন রাজ্য সরকারে তৃণমূল সরকারের প্রায় তিনবছরের স্বৈরাচারী অপশাসনের অনেক অপকীর্তির রেকর্ড প্রতিষ্ঠিত, তৃণমূলের সাহায্যে সঙ্ঘের নির্মিতিতে রাজ্যে বিজেপির কিঞ্চিত শক্তিসঞ্চয় হয়েছে, তৃণমূল কিছুটা সঙ্কটে। ইউপিএ সরকারের পরাজয় ঘটুক, বিজেপি দিল্লির শাসনক্ষমতায় আসীন হউক তৃণমূল সেটাই চায়, কিন্তু পাশাপাশি রাজ্যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শক্তি হিসেবে উঠে আসতে চাইছে এই দ্বন্ধও সামনে আসছে।
কেন্দ্রীয় সরকারে যে দলই থাকুক তাঁরা সিবিআই, ইডি, ইনকাম ট্যাক্স প্রভৃতি সংস্থাকে প্রয়োজন মত বিরোধী দলকে হাতে রাখার জন্যে ব্যবহার করে থাকে। সেটা সম্ভব হয় এই কারণে যে, আঞ্চলিক দলগুলি প্রায়শ রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে দলগত ও ব্যক্তিগত সম্পদ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নেয় এবং সহজেই কেন্দ্রীয় সরকার এবং সিবিআই, ইডি ইত্যাদি সংস্থার শিকারে পরিণত হয়। এবং এতদজনিত বিষয়গুলি ঝুলেই থাকে, নিষ্পত্তি হয় না। মামলাগুলি ঝুলে থাকে, সময়ে সময়ে ব্যবহার করা হয় মাত্র।
আর কেন্দ্রীয় সরকারের থাকা দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যাবহার করে ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত ও দলীয় সম্পদের পাহাড় জমিয়ে তোলে। সেই বিপুল অর্থের একটা অংশ ব্যবহার করে নির্বচনকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তবে এটাও মানতে হবে জনমানসের ব্যাপক অংশে এই দুর্নীতি অনেকটা মান্যতা পেয়ে গেছে, সাধারণভাবে, মানুষের মধ্যে আর ঘৃণার সৃষ্টি করে না।
হিন্দুত্ববাদী-সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিবাদী বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনেকের কাছে তৃণমূল এখন একটি বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। এই লড়াই অবশ্যই নির্বাচনকেন্দ্রিক। যদিও এই অনেকের মধ্যে 'অনেকে'র এত নির্বাচন নির্ভরতা ও প্রীতি সাম্প্রতিক অতীতেও দেখা যেত না। তাই এই দলটির স্বৈরাচারী কার্যক্রমে সোচ্চার অনুমোদন প্রসারিত না করলেও, সুকৌশলটা উপেক্ষনীয় নয়। “বুঝতে পারছেন না, তৃণমূলের বেশি প্রতিবাদ করলে বিজেপি এসে যাবে।”
বিজেপি-তৃণমূলের সখ্যের কথা এবং পারস্পরিক নির্ভরতার বিষয় কেউ কেউ বিস্মৃত হয়েছেন। ইতিহাস প্রেমী এই 'বিপ্লবী'রা এই দুই প্রতিক্রিয়ার শক্তির সম্মিলিত অবস্থানের পর্যালোচনা করলে বর্তমান অবস্থা নির্ণয়ের অনেক সুবিধা হতো।
তৃণমূল দল বিজেপি সরকারের জনবিরোধী ও প্রতিক্রিয়ার কর্মসূচি রূপায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের এনডিএর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মেনিফেস্টোতেও স্বাক্ষরকারী।
তৃণমূল কংগ্রেস রাজনৈতিক দল হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ যেমন কায়েম রাখতে চায়, সেই দখলদারিতে ভাগ বসাতে চাইলে, বিজেপির সঙ্গেও একটা বিরোধের জায়গা তৈরি হয়। তারপর কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিজেপির একটার পর একটা জনবিরোধী কার্যক্রমে মানুষের যে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ, তাতে, সময়বিশেষে, গলা মেলানোই সমীচিন মনে করেছে তৃণমূল। তৃণমূল নেত্রী তাঁর গলার স্বরটা সকলের উপরে তোলার যে কৌশলী দক্ষতা রাখেন এসব ক্ষেত্রেও সেই নৈপুণ্য প্রদর্শিত। হ্যাঁ, বিরোধীদের সঙ্গেও কিছুটা থাকতে হবে!
২০১৬ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি আক্রমণাত্মক হতে গিয়েও একটা ভাগাভাগির কৌশল নেয়। বিধান সভা তৃণমূলেরই থাকুক। লোকসভা বিজেপির হতে হবে।
২০১৯এ লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে বিজেপির উল্লেখযোগ্য উত্থান হয়। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির অন্য ভূমিকা দেখা গেল, পশ্চিমবঙ্গের দখল নেওয়াটা আশু কর্মসূচিতে জায়গা পেয়ে গেল। পাশাপাশি তৃণমূল নেতৃত্বের একটা বড় অংশের মধ্যেও ভাঙ্গন ধরাতে সমর্থ হল বিজেপি। তৃণমূলের একটা বড় অংশ বিজেপিতে যোগ দেয় মূলত এই সম্ভাবনায় যে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাতে চলে আসতে পারে। ক্ষমতায় তৃণমূলই ফিরে আসে, আর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপিও এজেন্সিদের কিঞ্চিৎ খেলিয়ে দেয়। এবং দ্রুতই যথার্থ ফলাফল নজরে আসে, এবার উচ্চকন্ঠে শুরু হয় বালখিল্য প্রচার: ২৪এ প্রধানমন্ত্রীর মুখ মমতা। ত্রিপুরা ও গোয়ায় যখন বিজেপি নির্বাচনের মুখে যথেষ্ট সংকটে, জনবিরোধী নীতির কারণে ত্রিপুরায় বামেদের এবং গোয়ায় কংগ্রেসের চ্যালেঞ্জের মুখে। এই সংকটেই তৃণমূল ঐ দুটি রাজ্যে বিরোধীদের ভোট ভাঙিয়ে বিজেপির হাত শক্ত করার প্রত্যক্ষ কাজে যথোপযুক্ত ভূমিকা পালন করছে। ইতিপূর্বে মৌখিক সমর্থনের একটা ভান বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও, কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে ২৭ সেপ্টেম্বর সারা ভারত ধর্মঘটের যে ডাক আন্দোলনকারীরা দিয়েছিলেন, সমস্ত কৃষক-সংগঠন, ট্রেডইউনিয়ন সংস্থা, গণসংগঠন সহ বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে এই ধর্মঘট কার্যকর করতে তৃণমূল সরকারের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে।
হ্যাঁ, এইসব রাজনৈতিক ঘটনার প্রেক্ষিতেই তৃণমূলের ভোটকুশলী তাঁর নেত্রীর সঙ্গী হিসেবে গোয়ায় প্রচার চলাকালীন বিজেপির দীর্ঘ স্থায়িত্ব সম্পর্কে আশ্বস্ত করেন।
সাহিত্যপত্র পাক্ষিক 'দেশ' ২ অক্টোবর ২০২১ সম্পাদকীয় নিবন্ধে যে বক্তব্য উপস্থিত করেছে, তা থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি রেখে প্রবন্ধটি শেষ করব।
“রাত্রে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাবেন নরেন্দ্র মোদি”
... “বর্তমান সময়ে সাম্প্রতিকতম রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মমতা বন্দোপাধ্যায়কে প্রধানমন্ত্রী করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে, পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা আসন ৪২টি, ত্রিপুরায় ২টি। গোয়া-সহ আরও দু'একটি রাজ্যে যেখানে মমতার দল নিজেদের প্রাসঙ্গিক এবং তথাকথিত 'সর্বভারতীয়' রাজনৈতিক করে তুলতে প্রচেষ্টারত, সেখান থেকে সব মিলিয়ে যদি ৫০টি আসনেও জয়লাভ করা সম্ভব হয়, তাহলেও কি ৫৪৩ আসনবিশিষ্ট লোকসভায় তা যথেষ্ট? এবং তা কেন্দ্রে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে? বলা হয়ে থাকে রাজনীতি সম্ভব্যতার শিল্প। সেই সূত্র মেনে হয়তো অনেক হিসেবনিকেশ হতে পারে। কিন্তু যাই হোক না কেন, ৫০-৬০টি আসন পেয়ে মমতা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন কিনা, তা সময়েই জানা যাবে। তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে বাঙালি অস্মিতার জয়জয়কার। বাঙালির পক্ষে সে আহ্লাদ বড় কম নয়। কিন্তু নানা প্রশ্নের সলতে পাকানো আছে এর মধ্যে। কারণসমূহ একটু তলিয়ে দেখা যাক। ইদানিং বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে লক্ষ্যণীয়, মমতা বন্দোপাধ্যায়ের দল নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে একেবারে নিশ্চুপ। কোনও বিরুদ্ধ সমালোচনা অন্তত প্রধানমন্ত্রীর নামে শোনা যায় নি। বরং আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর দলের নিশানায় রাহুল গাঁধী এবং কংগ্রেস! তারই স্বীকৃতি কি লখিমপুরে তৃণমলের প্রতিনিধিদের যেতে দেওয়া এবং কংগ্রেসকে আটকে দেওয়া? বিজেপি তো এমনিতেই রাহুলকে নিশানায় রেখে চলে সর্বদা। আর এভাবে কংগ্রেস তথা রাহুলকে যত কোনঠাসা করা হচ্ছে, আখেরে ততটাই লাভবান হচ্ছে বিজেপি। যেখানে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে বিরোধী ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে, সেখান তা দানা বাঁধতে পারছে না। কেজরিওয়ালের আপ তো আগে থেকে বিজেপি-র পরোক্ষে সুবিধা করে দিয়েছে। এখন মমতার তৃণমলও সে পথে থাকায় নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি-র মস্ত লাভ হবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অবশ্য দেওয়া-নেওয়ার শিল্পের কথা মাথায় রাখতে হবে। কোথাও কোনও নির্বাচন হল না, অথচ ভবানীপুরে তড়িঘড়ি উপনির্বাচন ডাকা হল। মমতার নিশ্চিত জয়কে আরও নিষ্কন্টক করা হল। ভাল তো হলই। মমতার জয়ে ভবানীপুর তার ঘরের মেয়েকে ফিরে পেল। কিন্তু আশঙ্কা অন্য ক্ষেত্রে। বিজেপি চায় কংগ্রেসমুক্ত ভারত। নরেন্দ্র মোদি তো সরাসরি দেশবাসীকে এ বিষয়ে আহ্বানও জানিয়েছেন। কেজরিওয়াল অখিলেশরাও তাই চান। এদের মতো মমতার তৃণমূলও যদি রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসকে দুর্বলতর করে তোলে, তাহলে আখেরে ২০২৪ পর্যন্ত প্রতিদিন রাত্রে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাবেন নরেন্দ্র মোদি। মমতা কি সত্যিই তা চান? এমনটা হলে অবশ্য কিছু বলার নেই।”
লেখাটির জন্য বিভিন্ন পুস্তিকার সাহায্য নেওয়া হয়েছে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.