বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
ছোটখাট চেহারার নির্মলা মল্লিক (নাম পরিবর্তিত) ভোরে এক বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন, এগারোটা থেকে একটা স্কুলে মিড ডে মিল রান্না করেন। দুপুরে কাজ শেষ হলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সাইকেলের দুই হ্যান্ডেল থেকে ঝোলে দুটো থলে। তাতে ভরা থাকে সরু, লম্বা, সাদা মলাটের বই — বিনামূল্যে সামাজিক সুরক্ষা যোজনার (বিএম-এসএসওয়াই) পাশবই। এটা তাঁর স্বেচ্ছাবৃত কাজ — বই আপডেট করা, টাকা জমা না পড়ে থাকলে তা নিয়ে খোঁজ-খবর করা, ম্যাচিয়োর হয়ে থাকলে টাকা তুলে এনে দেওয়া মেয়েদের। বাগদা, বনগাঁ, গাইঘাটার হাজার তিনেক শ্রমজীবী মহিলার কাছে নির্মলাই এ বিষয়ে ‘দুয়ারে সরকার।’ একটি নারী অধিকার সংগঠনের সদস্য নির্মলা আরও একটি পরিচয়, তিনি শাসক দল তৃণমূলের সদস্য, ভোটের সময় বুথের ভিতরে ‘এজেন্ট’ হিসেবেও বসেছেন।
কিন্তু তাতেও শ্রম দফতরের দুর্নীতি-চক্রের হাত থেকে রেহাই পাননি নির্মলা। “নতুন বই তৈরি করা, এবং যাদের বই রয়েছে তাদের জন্য সুবিধেগুলো আদায় করা, এ বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব খারাপ,” বারাসতের একটি সভায় বললেন নির্মলা। “নতুন গ্রাহকদের নাম লেখা হয় অনলাইনে। কিন্তু ওয়েবসাইটে আমরা ঢুকতে পারি না। পাসওয়ার্ড লক করা থাকে। লেবার অফিসাররা এসএসওয়াই বইয়ের কাজ নিজেরা করেন না। এজেন্টদের নামের লিস্ট ধরিয়ে দেন। এজেন্টদের টাকা না দিলে তারা ফর্ম জমাই নেবে না। নানা অজুহাতে ফর্ম ফেরত দিয়ে দেবে।”
এই ঘুষের টাকার ভাগাভাগিতে সমস্যা হলে তার হ্যাপাও পোয়াতে হয় মেয়েদেরই, নালিশ করলেন বারাসতের ওই সভায় আগত মেয়েরা। উত্তর ২৪ পরগনার একটি অঞ্চলে বছরখানেক ধরে বিএমএসএসওয়াই-এর নতুন বই হচ্ছে না। মেয়েদের ধারণা, এর কারণ এজেন্ট রাজি হচ্ছে না (মিনিমাম ওয়েজ) ইনস্পেক্টরকে টাকা দিতে।
ঘুষের অঙ্ক অনেকগুণ বেড়ে যায় যখন সরকার থেকে প্রাপ্য টাকা ঢোকে অ্যাকাউন্টে। “পঞ্চাশ হাজার টাকার ডেথ বেনিফিট আদায় করতে এক বার আমরা দালালকে দশ হাজার টাকা দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। টাকা পাওয়ার পর তাকে ওই টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করেছি।” তবে কাজ আদায় করতে দরদস্তুরে যেতেই হচ্ছে। অন্যদের থেকে ফর্ম জমা নিতে একশো টাকা নেয়, নির্মলার মতো মেয়েদের থেকে নেয় চল্লিশ টাকা। “এত লড়াই করছি, তবু আপস-মীমাংসা করতে হচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না,” আক্ষেপ নির্মলার। ‘বিনামূল্যে’ সামাজিক সুরক্ষার এমনই মূল্য দিতে হচ্ছে মেয়েদের।
নির্মলার মতো সমাজকর্মীদের আরও সমস্যা — এজেন্ট-এর কাছে বারবার যাতায়াত করতে হয়, অটো ভাড়ায় তিরিশ-চল্লিশ টাকা ভাড়া চলে যায় প্রতিবার। বই আপডেট করতে কখনও তিরিশ টাকা, কখনও পঞ্চাশ টাকা গুণে দিতে হচ্ছে। “সরকার যেখানে বছরে ৬৬০ টাকা দিচ্ছে, সেখানে এজেন্টদের টাকা দিতেই যদি এ ভাবে টাকা বেরিয়ে যায়, মেয়েদের কী থাকে?” প্রশ্ন তাঁদের। তার ওপর, বই আপডেট না করে মাসে ৫৫ টাকা জমা-পড়ার রসিদ একটা ফর্মে লিখে, তার জেরক্স কপি ধরিয়ে দিচ্ছে এজেন্টরা। “এই স্লিপ একজন মেয়ে তার ষাট বছর বয়স পর্যন্ত গুছিয়ে রাখতে পারবে? ও তো হারিয়ে যাবে। কেন বই আপডেট করা হবে না?” জিজ্ঞাসা নির্মলার।
শ্রম দফতরের এক আধিকারিকের মতে, এজেন্টদের এই দুর্নীতি ব্যতিক্রম নয়। “এই এজেন্টদের পোশাকি নাম ‘সেল্ফ এমপ্লয়েড লেবার অর্গানাইজ়ার’ — সংক্ষেপে এসএলও। এরা শ্রম দফতরে কার্যত একটা সিন্ডিকেট চালাচ্ছে।” ওই আধিকারিক নিজেও এই চক্রের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। “আমি শ্রম বিভাগের যে দফতরে পোস্টেড, সেখান থেকে আমার মাইনে হয় কিন্তু সেখানে আমাকে বসতে দেওয়া হয় না। আমাকে পাঠানো হয়েছে অন্য জেলায়, শ্রম-সংক্রান্ত অপর একটি দফতরে। এর কারণ, বিএমএসএসওয়াই-কে কেন্দ্র করে এসএলও-রা যে দুর্নীতি চক্র চালাচ্ছে, তা আমি থামাতে চেয়েছিলাম। আমার উপস্থিতি আমার সিনিয়র অফিসারদের কাছেও অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল,” বললেন তিনি। তাঁর অভিজ্ঞতা, শ্রম দফতরের আধিকারকরা এসএলও-দের সমঝে চলেন, তাদের চটাতে ভয় পান।
কী করে গড়ে উঠল এই দালাল-রাজ? ২০০১ সালে যখন অংসগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড প্রকল্প শুরু হয়, তখন নিয়মিত গ্রাহকদের থেকে তাদের প্রদেয় টাকা জমা নেওয়ার এজেন্ট দরকার হয়েছিল। তখন নিযুক্ত করা হয়েছিল পঞ্চায়েতের ট্যাক্স কালেক্টর, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, ভিলেজ এক্সটেনশন পার্সন-এর মতো গ্রামস্তরের কর্মীদের। কিন্তু প্রকল্পের যথেষ্ট প্রসার না হওয়ায় ২০১০ সালে ‘সেল্ফ এমপ্লয়েড লেবার অর্গানাইজ়ার’ (এসএলও) নামে কর্মীদের নেওয়া শুরু হয়, বিশেষ ভাবে এই কাজের জন্য। ২০১৭ সালে তৃণমূল সরকার অংসগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের পাঁচটি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পকে একত্র করে চালু করেছিল ‘সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প’ (এসএসওয়াই)। তখন গ্রাহক দিত তিরিশ টাকা, সরকার পঁচিশ টাকা। ২০২০ সালে সরকার ঘোষণা করে, গ্রাহকের প্রদেয় টাকা-সহ মোট পঞ্চান্ন টাকা প্রতি মাসে সরকারই দিয়ে দেবে।
এর ফলে গ্রাহকদের থেকে টাকা নেওয়ার প্রয়োজন রইল না। আবেদনও এখন অনলাইনে হয়, ফলে এই কর্মীদের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু এই এসএলও-রা রয়েই গেল। তাদের আইডি ব্যবহার করে আবেদনের ফর্ম আপলোড করতে হয়। শ্রম দফতরের মিনিমাম ওয়েজ ইনস্পেক্টর ওই ফর্ম অনুমোদন করলে গ্রাহকের নাম নথিভুক্ত হয়। টাকা ‘ক্লেম’ করতেও একই রুটে যেতে হয়। এই ‘দ্বাররক্ষী’ ভূমিকার ফায়দা তোলা হচ্ছে। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর দু’লক্ষ টাকা মঞ্জুর হলে তিরিশ হাজার টাকার কমে রফা হয় না।
অথচ, ‘বাংলা সহায়তা কেন্দ্র’-গুলি নানা প্রকল্পে অনলাইনে আবেদন করতে সাহায্য করে। সেই নিয়ম চালু করা যেত বিএমএসএসওয়াই প্রকল্পেও। তেমন প্রস্তাবও উঠেছে। কিন্তু মধুচক্রটি ভাঙায় আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।
বিএমএসএসওয়াই বর্তমানে এ রাজ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের একমাত্র সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প, যাতে নথিভুক্ত রয়েছেন ১ কোটি ৭৫ লক্ষ শ্রমিক, যাঁদের মধ্যে পেনশন প্রাপকদের সংখ্যা ৪৫ হাজার, অন্যান্য সুবিধাপ্রাপকের সংখ্যা প্রায় ৩৫ লক্ষ (সূত্র বাজেট বক্তৃতা, ২০২৫)। গ্রাহকের ষাট বছর বয়স হলে জমা টাকা পাওয়া যায়। তা ছাড়াও টাকা পাওয়ার কথা শিক্ষা, চিকিৎসার জন্য। হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে কাজের দিন নষ্ট হওয়ার ক্ষতিপূরণ, দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটলে দু’লক্ষ টাকা, সাধারণ মৃত্যু ঘটলে পঞ্চাশ হাজার টাকা, এমন নানা সুবিধে পাওয়া যায়। বাস্তবে কোভিডের সময় চিকিৎসা কিংবা কাজ হারানোর ক্ষতিপূরণ তো মেলেইনি, টাকা তোলার আবেদন গ্রহণ করাও বন্ধ হয়েছিল লকডাউনের মাস চারেক পর থেকে, বললেন শ্রমিক নেতা অশোক ঘোষ।
ষাট বছর বয়সে পিএফ ‘ম্যাচিয়োর’ করার পর টাকা পেতে সমস্যার নানা কারণের অন্যতম, ম্যানুয়ালি তৈরি-করা বই অনলাইনে আপলোড করা হয়নি। তা ছাড়া, অন্য রাজ্যের শ্রমিকদের বেআইনি ভাবে বই করানো হয়েছিল, টাকা কাটাও হয়েছে। এখন ফেরত দেওয়ার উপায় নেই।
আরও উদ্বেগের বিষয় হল, ২০২০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত রাজ্য সরকার মাত্র একবারই ট্রেজ়ারিতে বিএমএসএসওয়াই প্রকল্প বাবদ প্রদেয় টাকা জমা করেছে, ২০২২-২৩ সালে। সেই টাকার অঙ্কও প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। প্রতি অর্থবর্ষে হিসেব করে টাকা জমা দেওয়ার কথা, কিন্তু তা দেওয়া হচ্ছে না। মাসে পঞ্চান্ন টাকার রসিদ কি তবে প্রতিশ্রুতির কাগজমাত্র? বাস্তবে কত টাকা ওই প্রকল্প বাবদ জমা পড়ার কথা, আর কত টাকা জমা পড়েছে রাজকোষে, সে বিষয়ে স্বচ্ছতার অভাব রয়ে গিয়েছে।
নির্মলার মতো যে মেয়েরা স্বচ্ছ প্রক্রিয়া দাবি করে, চাপে পড়ে যায় তারাও। “আমি মেয়েদের হয়ে কাজ করে দিই বলে আমার উপর চাপ তৈরি করে এজেন্টরা, পার্টিও। আমাকে বলে, ‘তুমি কেন বই তুলছ?’ আসলে ওদের ভয় আছে যে ভোটে মেয়েরা হাতছাড়া হয়ে যাবে। আমাকে দেখার করার জন্য রাতে যেতে বলেছিল পার্টি থেকে। আমি যাইনি। বলেছি, দিনের বেলা, পৌরসভায় বসে কথা হবে।”
কেবল অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরাই নয়, শ্রমিকদের হয়ে কাজ-করা সমাজকর্মীরাও অসুরক্ষিত বোধ করছেন, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের ফাঁদে।