বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
মেয়েটির নাম মিনু। ওর মা রিক্সাভ্যান ঠেলেঠেলে সবজি নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করতেন। মিনু মায়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতো। একসময়ে মিনুর মা একটা জায়গায় বসে সবজি বিক্রি শুরু করলেন। মিনু তখন থেকে নিজেই ভ্যান ঠেলে নিয়ে ঘুরতে শুরু করলো। সকাল থেকে মিনুর গলায় “সবজি, সবজি, সবজি” হাঁক শুরু হয়। পটল, ঝিঙে, টমেটো, পেঁপে, বেগুন, পালংশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, কাঁচালঙ্কা, মূলো, কচুরলতি, ঢ্যাঁড়শ… মিনুর ভ্যানে সময়ের সব সবজিই থাকে। সারা দুপুরও “সবজি, সবজি, সবজি”। ঘুরতে থাকে মেয়েটা। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা। বিরাম নেই।
কয়েকদিন আগে আমি বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। মিনু যাচ্ছে রোজকার মতো হাঁক পেড়ে। হঠাৎ আমাকে দেখে মিনু ভ্যান দাঁড় করিয়ে দেয়। এসে আমাকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে বলে, “দাদু, তোমাদের আশির্বাদে আমি মাধ্যমিক পাশ করে গেছি। ভালভাবেই।” আমি একটু হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, “তুই স্কুলে পড়তি?” ও বললো, “হ্যাঁ, পড়তাম তো।” আমি বললাম, “খুবই ভাল খবর। তোকে পরে একটা প্রাইজ দেবো।” মিনু বললো, “তুমি আশির্বাদ করছো, এটাই তো প্রাইজ।”
আমি কয়েকবছর আগে একটা বই লিখেছিলাম ছোটদের জন্য – “মানুষের ঘরবাড়ি”। দিন তিনেক বাদে ওকে ডেকে বললাম, “এদিকে আয়”। বইটাতে লিখে দিলাম, “স্নেহের মিনুকে, আদর আর ভালবাসা সহ - দাদু।” ওকে দিয়ে বললাম, “দ্যাখ, কী লিখে দিলাম।” ও বই হাতে নিয়ে দেখছে। আমি বললাম, “পড়।” ও দেখছে। দ্বিতীয়বার বললাম, “পড়।” হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো, “তুমি কী আমার পরীক্ষা নিচ্ছো?” চমকে উঠলাম! আমি সত্যিই হতবাক হয়ে বললাম, “না রে। পরীক্ষা নেবো কেন? আমি কী লিখে দিলাম, সেটা তোকে পড়ে দেখতে বললাম।” মিনু কিন্তু পড়তে পারলো না! ‘স্নে’-তেই আটকে গেলো! আমি বললাম, “ঠিক আছে, এখন নিয়ে যা। পরে পড়ে নিস।”
ঘটনাটা আমার কাছ থেকে শুনে একজন বললো, “কেন, তুমি জানো না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী জানবো!” সে বললো, “অক্ষর ছাড়া শিক্ষা।” আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “স্কুলে! অক্ষর ছাড়া শিক্ষা? মানে!” “হ্যাঁ। পড়ছে যখন, পরের ক্লাসে এমনিতেই উঠে যাবে। পরীক্ষা নেই। এমনি করেই মাধ্যমিক-ও পাশ করে যাবে। পাশ করে। অক্ষর না চিনলেও।”
ব্যাপারটা অত্যন্ত ভয়াবহ, সন্দেহ নেই। ‘পড়ছে, কিন্তু শিখছে না’! এমনকি অক্ষর-ও না! খানিকটা বিব্রত বোধ নিয়েই একটু খোঁজখবর করার চেষ্টা চালালাম। আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। সারা ভারত জুড়ে কতো লক্ষ-কোটি ‘মিনু’ ছড়িয়ে আছে, তা ভেবে আমার ঘুম ছুটে যাবার অবস্থা!
এব্যাপারে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র হাতে পেলাম, “অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অফ এডুকেশন (রুরাল)”। ২৯টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে; ৬০৫ জেলার ১৭,৯৯৭ গ্রামে; ১৫,৭২৮ স্কুলে; ৩,৫২,০২৮ পরিবারের ৬,৪৯, ৪৯১ শিশুর উপর এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। সন্দেহ নেই, বেশ বড় কাজ। “ওমুক দল শাসিত তোমুক রাজ্যের এই হাল” - এমন অতি সহজিয়া ও চটকদারি ‘রাজনীতি’-র সুযোগ নেই এখানে। পুরো ভারতবর্ষের সমীক্ষা রিপোর্ট এটা।
৬, ৭-১০, ১১-১৪, এবং ১৫-১৬ — এইভাবে ৬ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত, ছাত্র-ছাত্রী নির্বিশেষে এই সমীক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে পাঠরত, এমনকি স্কুলে যায় না, এমন ছাত্রছাত্রীদের উপরেও সমীক্ষা চালানো হযেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিসংখ্যানের বিচারেও যথেষ্ট ঠিকঠাক এই রিপোর্ট।
সর্বভারতীয় এই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণীর প্রায় ২ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর অক্ষর জ্ঞানটুকুও নেই! অষ্টম শ্রেণীর প্রায় ৩২ শতাংশ ছাত্র এবং ২৭ শতাংশ ছাত্রী, দ্বিতীয় শ্রেণীর বইও পড়তে পারে না! অথচ ১৪, ১৫ ও ১৬ বছর বয়সী ছাত্রছাত্রীদের প্রায় ৮০, ৮৩ ও ৮৬ শতাংশ ছাত্রছাত্রী স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের ১৪-১৬ বছর বয়সী ছাত্রছাত্রীদের প্রায় ৮৫ শতাংশ স্মার্টফোন ব্যবহারে সক্ষম। কিন্তু এই সংখ্যা অন্ধ্র প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, কেরালা, মিজোরাম, পাঞ্জাব, সিকিম, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, ত্রিপুরা এবং উত্তরাখণ্ডের চেয়ে কম। পশ্চিমবঙ্গের ৪৬৯-টি স্কুলের উপর এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল।
সম্প্রতি পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিকে ‘স্কুলছুট ছাত্রীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে শূণ্য, মাধ্যমিক স্তরে স্কুলছুটের হার কমে হয়েছে ২.৯%’। তবে, অক্ষরজ্ঞান ছাড়া মাধ্যমিক পাশ বিষয়ে কোনও তথ্য আমরা তাঁর কাছ থেকে পাইনি।
‘স্বাধীনতা’র ৭৮-বছর পরেও স্কুল শিক্ষার এই বেদনাদায়ক হালের মূল কারণ হল, রাষ্ট্রীয় আমলাদের মোড়লি। এইসব ‘পণ্ডিত’ প্রশাসনিক কর্তারা শুধুমাত্র রাষ্ট্রশক্তির সেবক; জনশক্তির সঙ্গে এঁদের প্রত্যক্ষ কোনও যোগাযোগই নেই। এঁরা তৃণমূল স্তরের সমাজ সম্পর্কে একেবারেই বোধহীন শিক্ষায় ‘শিক্ষিত’। “ওই যে লোকটি টোকা মাথায় চাষ করছেন, ওঁকে চাষী বলে। উনি সমাজের বন্ধু।” ভারতীয় সমাজের ৬৫% যে কৃষক সমাজের মানুষ, তাঁরা “সমাজের বন্ধু”; তাহলে সমাজ কাদের নিয়ে? এইরকম উদ্ভট, অবাস্তব, অ-সামাজিক ‘শিক্ষা’ চলে আসছে যুগযুগ ধরে!
সমাজের ঘাড়ের উপর বসে থাকা ‘শিক্ষিত’ আমলারা কোটিকোটি টাকা আয়ের গদিতে বসে যা ভাবেন, তা-ই নানা দলের মন্ত্রীরা বেদবাক্য বলে মেনে নেন। মাটিতে বৃহত্তর জনসমাজের হালহকিকত সম্পর্কে এঁদের কোনও ধারণাই নেই। স্কুলে কী ‘শিক্ষা’ দেওয়া দরকার, তা এঁরা স্বপ্নের জগতে ভেসেই ঠিক করেন। বহুভাষিকতা এবং ভাষিক ভিন্নতার বাস্তবতা ঠিকভাবে উপলব্ধি না করার কারণে, কতো স্কুল-ছুট ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যায়, তার কোনও হিসেবই নেই। স্কুল ছাত্রছাত্রীদের মানসিকতা, তাঁদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, এসব সম্পর্কে প্রত্যক্ষ কোনও জ্ঞানই এঁদের নেই। অথচ ‘দেশ’ পরিচালনার সবরকম নীতি-রীতি এঁরাই ঠিক করেন! মন্ত্রীরা সবাই আজ আছেন, কাল থাকবেন না। যতক্ষণ আছেন, আমলাদের তৈরি করা কাগজে সই মারার ‘দায়িত্ব’ পালন করেন মাত্র। কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি অক্ষতই থাকে। আমলারা – যাঁরা স্কুল শিক্ষা, কলেজ বা ইউনিভার্সিটির শিক্ষা, ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা, বড় শিল্প, চামড়া শিল্প, কুটির শিল্প, গোবর সার, মহাকাশ গবেষণা, বস্তি উন্নয়ন, টমেটো বা বেগুন চাষ, সাংবাদিকতা, ইত্যাদি ইত্যাদি – হ্যানো কোনও বিষয় নেই, যা জানেন না! তাই আজ ‘গোবর সার’ দফতরের দায়িত্বে, তো কালকেই ‘শিক্ষা’ দপ্তরের মাথায়!
শিক্ষাজগতে কর্মরত ও গবেষণারত বহু প্রকৃত জ্ঞানিগুণিজনের মতামতকে, যুগের পর যুগ অবহেলা করে চলার পরিণতিতেই আজ পশ্চিমবাংলা তথা ভারত জুড়ে লক্ষ-কোটি ‘মিনু’দের এই হাল। নানা ‘দল’-এর সরকারের পর সরকার যায়-আসে, কিন্তু শিক্ষাজগতের মৌলিক কোনও পরিবর্তন ঘটে না। আজ সরকার বললো, “বাচ্চাদের ইংরেজি শেখার দরকার নেই”; উঠে গেল ইংরেজি পড়া। কালকেই সরকার আবার সিদ্ধান্ত নিল, “ইংরেজি পড়ানো খুবই দরকার।” চালু হয়ে গেল ইংরেজি শেখার ধূমধাম! ছাত্রছাত্রীদের মনোজগত কিংবা সুযোগসুবিধা অথবা ভবিষ্যৎ নিয়ে মন্ত্রী-আমলাদের আসলে কোনও মাথা-ব্যথাই দেখা যায় না।
পশ্চিমবাংলায় স্কুল শিক্ষার হাল কেমন? উত্তরবঙ্গের একটি স্কুলের, চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে ষোলোটি ভাষাভাষী সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রী। সাঁওতাল, মুন্ডা, ওরাওঁ, রাজবংশী, নেপালী, বোরো, সাদ্রি, ধিমাল, ... ইত্যাদি। তাঁদের বেশিরভাগই পড়াশোনা করছে এমন ভাষায়, যা তাঁদের নিজেদের ‘মাতৃভাষা’ না। “শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ”— এই আপ্তবাক্যর কী হবে! স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে এই গভীর ভাষা-সমস্যা নিয়ে যথাযথ অনুসন্ধান, গবেষণা, চর্চা, এসব হয়নি সরকারের তরফে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এজাতীয় সমস্যা আছে। তা নিয়ে সেসব দেশে যে ধরনের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও সমাধানের উদাহরণ দেখা যায়। এখানে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। বাংলা ভাষার উপর অন্য ভাষার আধিপত্য নিয়ে যথেষ্ট সচেতনতা গড়ে উঠছে। কিন্তু কোথাও কোথাও বাংলা, সাঁওতালি ও নেপালী ভাষার আঞ্চলিক আধিপত্যের কারণে, কতগুলো ‘মাতৃভাষা’ মুছে গেছে ও যাচ্ছে পশ্চিমবাংলায় — তা নিয়ে কজন মন্ত্রী-আমলা-শিক্ষাবিদ চিন্তিত?
আসলে, লক্ষ-কোটি ‘মিনু’দের নিয়ে এখানে সরকারি মাথাব্যথার কারণ কোনও দিনই ছিল না। তাই ‘স্বাধীনতা’র পর থেকে অন্তত পাঁচ-পাঁচটা সরকার গেল-এল পশ্চিমবাংলায়; ইউনিয়ন সরকারে বদল ঘটলো ১৬ বার। কিন্তু ভারত জুড়ে ‘মিনু’-রা আজও মাধ্যমিক ‘পাশ’ করে চলেছে সামান্য অক্ষরজ্ঞান ছাড়াই! ৭৮-বছরের ‘স্বাধীন’ ভারতে পারমাণবিক চর্চা কিংবা মহাকাশ গবেষণা অথবা যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে এত অগ্রগতির পাশাপাশি, শিক্ষাক্ষেত্রে এই দুরবস্থার দায় কাদের: ‘মিনু’-দের, নাকি প্রশাসনিক ‘হনু’-দের?
সূত্র: 1) ASER 2024; 28 January, 2025
2) Decolonisation in Language Education: Addressing the question of Heterogeneity in West Bengal and Kerala in the 1990s. by Lekshmi R., Suma Chisti, Abhijith N. Arjunan, Dr. Dripta Piplai (Mondal). In: Postcolonial Direction in Education; Vol. 13, Issue 2, 2025, pp: 370-408