গিগ কর্মীদের কাহিনি— সংগঠনই শক্তির উৎস
গিগ কর্মীদের কাহিনি— সংগঠনই শক্তির উৎস
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
৫০, ২০, ২৫ ১৫। সংখ্যা চারটিকে সময়-সারণিতে পর পর রেখে ছবি আঁকলে সে-ছবির চেহারা-চরিত্র সম্পর্কে দু’টি কথা খুব সহজেই বলা যায়। এক, সংখ্যাগুলির গতিপথ একমুখী নয়, উঁচুনিচু। দুই, সেই পথ তার চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে আখেরে নীচের দিকে গিয়েছে। অর্থাৎ উত্থানপতন সত্য বটে, কিন্তু বৃহত্তর সত্যটি পতনেরই। বলা চলে, রাস্তাটা পাহাড়ি, এবং গাড়ি সে-রাস্তায় উঠছে না, নামছে।
সংখ্যাগুলো মজুরি বা পারিশ্রমিকের। ক্রেতাদের চাহিদা মতো তাঁদের কাছে নানা পণ্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবসায় নিযুক্ত একটি ‘ডেলিভারি’ কোম্পানির শ্রমিক বা কর্মীদের কাজের পারিশ্রমিক। শ্রমিক বা মজুরি-র মতো শব্দগুলি নিয়ে এই ধরনের কোম্পানির পরিচালকদের অবশ্য আপত্তি থাকতে পারে, কিন্তু সেই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। আগে সংখ্যাগুলোর কথা খোলসা করে বলা যাক। পণ্য ডেলিভারি বা পৌঁছে-দেওয়ার ব্যবসায় বহু সংস্থা কাজ করছে, তার মধ্যে কয়েকটি বহুলপরিচিত। তেমনই একটি সংস্থা ‘ব্লিংকিট’। বছর দশেকের ব্যবসা তাদের। এই নামটি অবশ্য বছর দেড়েক আগে নেওয়া, তার আগে অন্য নাম ছিল। ইতিমধ্যে গত বছর এর মালিকানা অধিগ্রহণ করেছে অতিকায় ‘জোম্যাটো’, তবে ব্লিংকিট স্বনামেই তার ডেলিভারির ব্যবসা চালাচ্ছে।
তো, এই সংস্থার কর্মীদের উপার্জনের হারে গত কয়েক মাসে দেখা গিয়েছে উত্থানপতনের খেলা এবং তা নিয়ে তর্ক, বিক্ষোভ, আন্দোলন, টানাপড়েন। ‘ডেলিভারি ভয়েস’ নামক একটি সংগঠন এই বিষয়ে নিয়মিত নানা তথ্য-পরিসংখ্যান সরবরাহ করে চলেছে। এই লেখায় ব্যবহৃত তথ্যগুলি প্রধানত সেখান থেকে সংগৃহীত। সংবাদমাধ্যমে ও পত্রপত্রিকায় এই বিষয়ে খবর ও আলোচনা নিতান্তই বিরল, তবে খুব সম্প্রতি তার পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে, এটুকুই সুলক্ষণ।
সাম্প্রতিক টানাপড়েনের শুরু গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে। সেই সময় সংস্থার কর্মীদের পারিশ্রমিকের হার ঘণ্টা-পিছু ৫০ টাকা থেকে কমিয়ে ২০ টাকা করে দেওয়া হয়। সময়টা খেয়াল করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে তথা কলকাতায় পুজোর বাজার তখন জমে উঠছে, অন্য নানা অঞ্চলেও উৎসবের মরসুম অদূরেই। তার আগের দু’বছর ছিল কোভিডের একাধিক তরঙ্গে বিপর্যস্ত, সেই আকালের পরে আবার ‘স্বাভাবিক’ অবস্থায় শারদোৎসব আসছে— পণ্যবাহী কর্মীরা নিশ্চয়ই বাড়তি আয়ের আশায় বুক বাঁধছিলেন। কিন্তু কর্মীদের হিসেব আর পরিচালকদের হিসেব এক হয় না। শারদীয় উৎসবের মরসুমে এই ধরনের সমস্ত কোম্পানিই মুনাফা অনেকখানি বাড়িয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে। পারিশ্রমিকের হার কমাতে পারলে সেই পরিকল্পনা সার্থক করে তোলা সহজ হয়। উৎসবের সময় ডেলিভারির সংখ্যা যেহেতু বেশি, তাই প্রতিটি ডেলিভারির জন্য প্রদত্ত পারিশ্রমিক বাবদ খরচ কমানো গেলে বছরের অন্য সময়ের তুলনায় ব্যস্ত মরসুমে মোট মুনাফা বেশি বাড়ে। অন্য দিকে, এমন একটা অঙ্ক কষে নেওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, কর্মীরা যেহেতু এই ক’টা সপ্তাহ বেশি কাজ পাবেন, তাই পাওনার হার কমলেও তাঁদের মোট উপার্জন সেই অনুপাতে কমবে না, বেশি ‘ট্রিপ’ পাওয়ার সুবাদে কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবেন, সে ক্ষেত্রে পারিশ্রমিক কমানোর ব্যাপারটা নিয়ে ততটা উত্তেজিত হবেন না। বরং ভাববেন, এখন ঝামেলা বাধিয়ে ব্যবসার ক্ষতি করা ঠিক নয়, এই ক’টা দিন বাজার ভাল আছে, যতটা পারা যায় কামিয়ে নেওয়া যাক। ব্যবসা চালাতে গেলে এমন হিসেবনিকেশ করতেই হয়।
কিন্তু কর্মীদেরও অভিজ্ঞতা কম নয়, এবং হিসেব করার ক্ষমতাতেও তাঁরা বঞ্চিত নন। তাঁরা জানেন, এই বাজারে কাজ বন্ধ করলে কোম্পানিও বিপাকে পড়বে, এখন এক একটা দিন মানে সোনার খনি, উৎসব চলে গেলে ব্যবসার এই সুবর্ণসুযোগ আর মিলবে না। অতএব ডেলিভারি সংস্থাটির কর্মীরা সমবেত এবং সংগঠিত প্রতিবাদ শুরু করলেন, মাসখানেকের কাছাকাছি চলল সেই আন্দোলন, সবাই না হলেও কর্মীদের একটা বড় অংশ তাতে শামিল হলেন, কলকাতা শহরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্যবসা ধাক্কা খেল। পরিচালকদের উদ্বেগ বাড়তে থাকল। শেষ পর্যন্ত সদর দফতর থেকে বড়কর্তারা সুদূর কলকাতায় এসে বিক্ষুব্ধ কর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন, অনুমান করা যায় যে বিস্তর দর কষাকষি হল। শেষ পর্যন্ত পারিশ্রমিকের হার ৫ টাকা বাড়ানো হল— ঘণ্টায় ২০ থেকে ২৫। এবং বলা হল, কোনও কর্মী যদি যথেষ্ট সংখ্যক অর্ডার পৌঁছে দিতে পারেন, তাঁর আয় বেড়ে ৪০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছনোর সুযোগ থাকবে। কর্মীরা মেনে নিলেন। বাজারের হাল তাঁরা জানেন, জানেন যে এই মরসুমে বেশি দিন কাজ বন্ধ রাখলে তাঁদের কাজটাই চলে যাবে, অথবা প্রতিযোগী সংস্থাগুলি সংস্থার বাজার দখল করে নেবে, সেখানে কাজের সুযোগ না-ও মিলতে পারে, তা ছাড়া তারা হয়তো আরও কম পারিশ্রমিক দেবে— যে ডালে বসে আছি সে-ডাল কেটে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তা ছাড়া, পুজোর সময়, বাড়িতে মানুষগুলো শুকনো মুখে বসে আছে, কত দিন কাজ বন্ধ রাখা যায়? অতএব ঘণ্টায় ২৫ টাকাতেই রফা হল।
এই হারেই চলছিল। কিন্তু যা চলছে, যেমন চলছে, দুনিয়াটাকে সেভাবেই চলতে দেওয়া পুঁজির স্বধর্ম নয়। উদ্বৃত্ত তথা মুনাফা নিরন্তর বাড়িয়ে যেতে না পারলে সে আর ‘পুঁজি’ থাকে না, থাকতে পারে না। উদ্বৃত্ত বাড়িয়ে চলার সব রকম উপায় খুঁজতে হয় তাকে। বিশেষ করে কর্মীরা যখন সংগঠিত ভাবে আয় কমানোয় বাধা দেন, তখন সেই বাধা এড়ানোর অন্য উপায় উদ্ভাবন করা পুঁজিমালিকের একটা বড় দায় হয়ে পড়ে। এটা কোনও একটি সংস্থা বা বিশেষ কিছু ব্যবসায়ীর আচরণের ব্যাপার নয়, পুঁজির স্বধর্ম। সেই ধর্ম পালন করতেই ব্যবসায়ীকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিতে হয়। ব্লিংকিট সম্প্রতি এক নতুন বর্গের কর্মী নিয়োগে উদ্যোগী হয়েছে। এই বর্গের কর্মীদের পারিশ্রমিক হবে ঘণ্টা-প্রতি ১৫ টাকা। পুরনো বর্গটিকে তুলে দেওয়া হবে, এমন কথা বলা হয়নি। এই আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে যে, নতুন বর্গের কর্মীরা বেশি দূরে ডেলিভারি দিলে তুলনায় বেশি হারে বোনাস পাবেন। অর্থাৎ, আপাতদৃষ্টিতে, দু’রকম কর্মীই পাশাপাশি কাজ করবেন, এক দল ২৫ টাকা ঘণ্টায়, অন্য দল ১৫ টাকায়, সঙ্গে বাড়তি আয়ের কিছু বিশেষ সুযোগ।
এই অবস্থায় ডেলিভারি কর্মীরা নতুন করে আন্দোলন শুরু করেছেন। তাঁদের দাবি: খিড়কির দরজা দিয়ে উপার্জনের হার কমানো চলবে না, নতুন বর্গের গোটা ব্যবস্থাটাই বাতিল করতে হবে। কোম্পানির পাল্টা বক্তব্য: নতুন বর্গের কর্মী নিয়োগ করা তাদের ব্যবসার জন্য দরকারি। ইতিমধ্যেই ‘ধর্মঘটে সাহায্য করা’ বেশ কিছু কর্মীর পুরনো ‘আইডি’ আটকে গিয়েছে, তাঁরা কাজ ফেরত পেতে চাইলে নতুন আইডি-র জন্য আবেদন করতে হবে, এবং সেটা হবে ১৫ টাকার কাজের জন্য। কর্মীরা এখনও নানা অঞ্চলে লড়াই করছেন। সম্প্রতি দিল্লির কিছু এলাকা সহ দেশের নানা জায়গায় আন্দোলন ছড়িয়েছে। কোম্পানিও কিছু কিছু স্টোর বন্ধ করেছে। কোথাও কোথাও অন্য ডেলিভারি কোম্পানির কর্মীরা এই আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছেন, সংহতির কথা বলেছেন। টানাপড়েন চলছে। সম্ভবত, চলবে।
পুঁজি ও শ্রম
এই ঘটনাবলি থেকে কতকগুলো বৃহত্তর প্রশ্ন উঠে আসে। কেবল একটি কোম্পানির ক্ষেত্রে নয়, কেবল এক ধরনের ব্যবসার ক্ষেত্রে নয়, প্রশ্নগুলি সামগ্রিকভাবেই পুঁজির কারবারের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। যেমন, প্রথমত, একই ধরনের কাজের জন্য পারিশ্রমিকের একাধিক হার কি বজায় থাকতে পারে? সস্তার কাজ কেউ করবে কেন? এর একটা উত্তর হতে পারে এই যে, কম পয়সার কাজে যে সব সুবিধে (বেশি হারে বোনাসের মতো) মিলবে, তার আকর্ষণে অনেকে সেই কাজটাই স্বেচ্ছায় বেছে নিতে পারেন। এই যুক্তি কতটা সত্য বা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে, কিন্তু সেই প্রশ্নে না গিয়েও একটি মৌলিক এবং প্রাথমিক প্রশ্ন তোলা দরকার। কোন বর্গের কাজ করবেন, সেটা কি কর্মপ্রার্থীরা সত্যই নিজেরা বেছে নিতে পারবেন?
পাশাপাশি দু’টো আলাদা গোত্রের কাজের সুযোগ খোলা থাকবে, কর্মপ্রার্থীরা নিজেদের পছন্দমতো বেছে নেবেন কে কোন গোত্রে নাম লেখাতে চান— কাজের বাজার এমন সহজ সরল হয় না। কোনও ব্যবসায়িক সংস্থা যদি দেখে যে কম টাকায় কাজ করিয়ে, এমনকি বোনাস ইত্যাদি বাড়তি সুবিধে দিয়েও মুনাফা বেশিই থাকছে, তা হলে ওই গোত্রের কাজই তারা ক্রমশ বাড়াবে, অন্য গোত্রের কাজের সুযোগ কমে যাবে, এক সময় বন্ধও হয়ে যেতে পারে। দু’ভাবে এটা ঘটতে পারে। এক, নতুন কর্মী নেওয়ার সময় শুধু নতুন বর্গটিতে নাম লেখানোর সুযোগ দেওয়া হবে, ফলে সেই বর্গের কর্মীর অনুপাত ক্রমে বাড়বে। দুই, কাজের অর্ডার বণ্টনের সময় এই কম টাকার কর্মীদেরই তুলনায় বেশি অনুপাতে কাজ দেওয়া হবে। দু’দিক থেকেই কর্মীদের উপর কম টাকায় কাজ করার চাপ বাড়বে। ক্রমশ দেখা যাবে, কম পারিশ্রমিকটাই কর্মীদের শ্রম-শক্তির ‘স্বাভাবিক’ দর সাব্যস্ত হয়েছে। বলা বাহুল্য, এটা কেবল একটি কোম্পানির ক্ষেত্রে সীমিত থাকবে এমন নয়, অন্যান্য ডেলিভারি কোম্পানির— এবং বৃহত্তর পরিসরে অন্য ধরনের অনেক কোম্পানির— কর্মীদের প্রাপ্য কমানোর প্রবণতাও জোরদার হবে, ‘প্রতিযোগিতা’র নীতি তো তেমনটাই বলে দেয়।
মোদ্দা কথা একটাই। শ্রমের বাজারে কর্মীর চাহিদার তুলনায় যদি কর্মপ্রার্থীর জোগান বেশি থাকে, তা হলে পারিশ্রমিকের হার কমানোর জন্য চাপ পড়বেই। এই প্রক্রিয়ার মূলে আছে পুঁজির বুনিয়াদি স্বার্থ। ক্রমাগত মুনাফা অর্থাৎ উদ্বৃত্ত আহরণের মাত্রা বাড়িয়ে চলাই তার লক্ষ্য, সুতরাং সে শ্রমের দর ক্রমাগত কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েই যাবে। প্রচলিত অর্থশাস্ত্রে মজুরিকে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতার ‘মূল্য’ হিসাবে দেখবার যে রীতি জারি আছে, তা পুঁজির অন্তর্নিহিত এই প্রক্রিয়াকে স্বীকার করে না, কারণ উদ্বৃত্ত মূল্যের (সারপ্লাস ভ্যালু) ধারণাকেই সে স্বীকার করে না। অথচ উদ্বৃত্ত বাড়ানো এবং তার যথাসম্ভব বড় অংশ আহরণ করার তাগিদ থেকেই পুঁজি প্রযুক্তি এবং ব্যবসা-পদ্ধতিতে ক্রমাগত সংস্কার ঘটিয়ে চলে। প্রযুক্তির উন্নতি বা ব্যবসা সংগঠনের নতুন কৌশল শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা যত বাড়ায়, পুঁজিমালিক ততই তা থেকে বেশি উদ্বৃত্ত আহরণের চেষ্টা চালান। শ্রমের দর কমানোর উদ্যোগ সেই চেষ্টার একটি অঙ্গ। অর্থাৎ, পুঁজির স্বার্থ থেকে দেখলে, প্রযুক্তি ও পদ্ধতির উন্নতি এবং মজুরি কমানোর চেষ্টা— দু’টোই একই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দিক। সেটা হল পুঁজিমালিকের তহবিলে যথাসম্ভব উদ্বৃত্ত আহরণের প্রক্রিয়া। এটাই পুঁজির সত্য। পুঁজিতন্ত্রের সত্য।
ডেলিভারি কর্মীদের দাবি ও প্রতিবাদের জবাবে কোম্পানির পরিচালকদের প্রদত্ত একটি যুক্তি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সেটা এই যে, দু’রকম কর্মী-বাহিনী তৈরি করা এবং তাদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দেওয়ার গোটা ব্যবস্থাটাই পরিচালনা করে প্রযুক্তি-চালিত ‘সিস্টেম’, আইডি নির্ধারণের কাজও সেই অনুসারেই সম্পন্ন হচ্ছে, এখানে পরিচালকদের নিজস্ব কোনও ভূমিকা নেই, আলাদা করে কিছু করারও নেই। ‘সিস্টেম’ যেমন কর্মীদের মোবাইল টেলিফোনে জানিয়ে দেয় কোন পণ্য কোথা থেকে তুলে কোথায় কার কাছে পৌঁছে দিতে হবে, সেইভাবেই এই দুই বর্গের কাঠামোটিকে চালনা করবে ‘নৈর্ব্যক্তিক’ প্রযুক্তি। এটাই এই ব্যবসার ‘স্বাভাবিক’ নিয়ম। অর্থাৎ, সিস্টেম যেমন চালাবে, তেমনই চলতে হবে।
প্রতিবাদী কর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন: সিস্টেমকে কারা চালাচ্ছে? উত্তর সহজ। কিন্তু ওই সহজ উত্তরের মধ্যেই নিহিত আছে জটিল এবং গভীর এক সত্য। পুঁজি এবং পুঁজিতন্ত্র কীভাবে প্রযুক্তি ও ব্যবসা পরিচালনার কৌশলকে কাজে লাগায় ও তার রূপান্তর ঘটায়, সেই সত্য। দুনিয়া জুড়ে ঝড়ের গতিতে ‘প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতি’র যে বিস্তার ঘটছে, খাবারদাবার ও অন্য যাবতীয় পণ্য ক্রেতার অর্ডার মাফিক তার কাছে পৌঁছে দেওয়ার আয়োজন তার একটি অংশ। প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই কর্মীরা সেখানে কেবল অস্থায়ী নন, তাঁদের কাজটাই আলাদা আলাদা অর্ডার-ভিত্তিক। পরিভাষায় ‘গিগ ওয়ার্ক’ বলতে যা বোঝায়— নির্দিষ্ট এবং বিচ্ছিন্ন এক একটি কাজ করে চলা ও তার ভিত্তিতেই রোজগার করা— এই কাজগুলি সেই গোত্রের। কিন্তু, শুরুতেই বলেছি, আইনের ভাষায় তাঁরা সচরাচর ‘শ্রমিক’ বা ‘কর্মী’ বলে গণ্য হন না, তাঁদের রোজগারও ‘মজুরি’ বা ‘বেতন’-এর স্বীকৃতি পায় না। এর কারণ হল সেই স্বীকৃতি দিতে কোম্পানির পরিচালকদের, অর্থাৎ পুঁজিমালিকদের ঘোর অনীহা। তাঁদের বক্তব্য— ওঁরা হলেন ‘পার্টনার’, অর্থাৎ অংশীদার বা সহযোগী, অর্ডার সরবরাহ করে কোম্পানির যে আয় হয়, ওঁরা তার ভাগ পান ‘কমিশন’ হিসেবে, কখনও বা ‘বোনাস’ বাবদ।
অংশীদার? সহযোগী? শব্দগুলোর মানে কী? যাঁদের কাজটা কেবল শ্রমিকের নয়, চূড়ান্ত রকমের ঠিকা কর্মীর, যাঁদের উপার্জনের কোনও স্থিরতা নেই, আজকের কর্মসংস্থান কাল থাকবে কি না তার বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা নেই, যে ‘সিস্টেম’ তাঁদের কাজ করাচ্ছে তার উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, তাঁরা শ্রমিক নন, পার্টনার? এমন বিসদৃশ ব্যবস্থার পিছনেও কাজ করছে পুঁজির স্বার্থ। কর্মীদের শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি দিলে তাঁদের নানা অধিকারের প্রশ্ন ওঠে, কোম্পানির উপর অনেক রকমের দায়দায়িত্ব এসে পড়ে। এ ধরনের ব্যবসায় সেই দায়দায়িত্ব বাস্তবে কে কতটা পালন করেন সেটা অবশ্য আমাদের বিলক্ষণ জানা আছে, কিন্তু খাতায়-কলমে কোনও আইনি দায়িত্ব না থাকলেই পুঁজিমালিকের সবচেয়ে সুবিধে হয়। দুনিয়া জুড়ে বিভিন্ন ধরনের গিগ কর্মীদের শ্রমিক হিসাবে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে বড় আকারের আন্দোলন চলছে কয়েক বছর ধরে। কোথাও কোথাও সেই আন্দোলনের ফলও মিলেছে, যেমন ক্যালিফর্নিয়ায় আদালত এই দাবির সপক্ষে রায় দিয়েছে। আবার উচ্চতর আদালতে আপিল করেছেন কোম্পানির চালকরা এবং সফল হয়েছেন— সেই রায় নাকচ হয়েছে। আমাদের দেশে, বিশেষত কেন্দ্রে এবং অধিকাংশ রাজ্যে সরকারি কর্তারা এ ধরনের দ্বন্দ্বে কোন দিকে ঝুঁকে আছেন, সে কথা কারও অজানা নয়। সুতরাং ‘পার্টনার’দের লড়াইটা ভয়ঙ্কর কঠিন। কিন্তু কঠিন বলে তাঁরা লড়াইয়ের ময়দান ছাড়েননি। নানা দেশে নানা পরিস্থিতিতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছেন।
কেন সংগঠন জরুরি
প্রশ্ন হল, শ্রমিক সংগঠন এবং রাজনৈতিক দল, বিশেষত বামপন্থী দলগুলি এই লড়াইয়ে কতটা শামিল হবেন এবং কীভাবে শামিল হবেন। প্রযুক্তির গোত্র পাল্টেছে, ব্যবসার কৌশল পাল্টেছে, সুতরাং লড়াইয়ের ধারণা এবং তার পদ্ধতি-প্রকরণেও পরিবর্তন জরুরি।। কীভাবে সেই পরিবর্তন সাধন করা যায়, তা বোঝার জন্য অন্য নানা দেশের কর্মীদের, বিশেষত গিগ অর্থনীতির কর্মীদের সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। শিক্ষা নেওয়া মানে অনুকরণ করা নয়। বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক বাস্তব বিভিন্ন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রেও বিস্তর স্বাতন্ত্র্য আছে, সুতরাং প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট বাস্তব পরিস্থিতি থেকে শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের রসদ সংগ্রহ করা দরকার। কিন্তু শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার পারস্পরিক লেনদেনের সুযোগও বিপুল।
একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। আমেরিকার বেশ কিছু এলাকায় গত কয়েক বছরে ছোট রেস্তরাঁ, স্থানীয় লন্ড্রি, ভাড়াগাড়ি সরবরাহ ইত্যাদি পরিষেবার ক্ষেত্রে বন্ধ-হয়ে-যাওয়া ব্যবসা চালানোর ভার শ্রমিক-কর্মীরা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন এবং সমবায় বা অন্য ধরনের সংগঠনের ভিত্তিতে সেই ব্যবসা চালাচ্ছেন। এমন উদ্যোগ অন্য বহু দেশেই আছে, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকায় কয়েক দশক ধরে এর বহু নজির তৈরি হয়েছে। কিন্তু মার্কিন উদাহরণটি এই মুহূর্তে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বড় পুঁজির শাসন সেখানে অস্বাভাবিক জোরদার। সেই পরিস্থিতির মধ্যেও কর্মীদের পরিচালিত উদ্যোগগুলি গড়ে উঠতে পারছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই টিকে যাচ্ছে, এর তাৎপর্য বিরাট। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল, এই সাফল্যের পিছনে প্রযুক্তির একটা বড় ভূমিকা আছে। যে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ডেলিভারি কোম্পানির পুঁজিমালিক নতুন কৌশল উদ্ভাবন করে উদ্বৃত্ত আহরণের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে, সেই একই প্রযুক্তির কল্যাণে শ্রমিক-কর্মীরা নিজেদের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে পারছেন এবং সেই ব্যবসাকে দক্ষতার সঙ্গে চালাতে পারছেন। এই সুযোগ আগে ছিল না, কারণ প্রযুক্তি এই পর্যায়ে পৌঁছয়নি। এই কারণেই পরিবর্তনকে কাজে লাগানো জরুরি। পুঁজি এ ব্যাপারে সতত তৎপর। শ্রমজীবীদের, এবং তাঁদের স্বার্থে আন্দোলনকারীদের, পাল্টা তৎপরতা চাই।
শেষ কথা হল, পুঁজি বনাম শ্রমজীবীর দ্বন্দ্বে যত রকমের পরিবর্তনই ঘটুক না কেন, একটা মৌলিক সত্যের কোনও পরিবর্তন হয়নি, তার গুরুত্ব এক আনাও কমেনি। সেই সত্যটি উচ্চারণ করেছিলেন কার্ল মার্ক্স। ক্যাপিটাল প্রথম খণ্ডের ‘কর্মদিবস’ নামক দশম অধ্যায়ে তিনি লিখেছিলেন: “Between equal rights, force decides.” আইনের চোখে পুঁজিমালিক এবং শ্রমিক, দুই তরফেরই নিজ নিজ অধিকার আছে। মালিকের ব্যবসা চালানোর অধিকার, শ্রমিকের কাজ না করার (এবং না খেয়ে মরবার) অধিকার। দুই তরফের ‘অধিকার’ সমান হলে তাদের আপেক্ষিক শক্তিই জয়পরাজয় নির্ধারণ করে— অর্থাৎ, যার জোর বেশি সে-ই যেতে। পার্টনারই বলা হোক, আর শ্রমিক-কর্মীই বলা হোক, সংগঠনই তাঁদের শক্তির প্রকৃত উৎস।
তথ্য-সূত্র: www.facebook.com/DeliveryVoiceIndia