বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
নতুন বছর। দেদার আনন্দ উৎসবে ভেসে যায় নিখিলভুবন। আতশবাজির আলোরা ঠিকরে আসে অযুত আনন্দের নিমিত্তে। আর তারই মাঝে অনির্বাণ মহানগরের সায়ন্তনে হাঁটতে হাঁটতে এক তিমিরাচ্ছন্ন কোণ থেকে গানটা কানে ভেসে আসে। ‘মধুর ধ্বনি বাজে, হৃদয় কমল মন মাঝে’। ফোনেই বাজছে মনে হয়। কাছে যেতেই ছবিটা স্পষ্ট হল। বহুদিন পর বাবাকে কাছে পেয়ে আনন্দে নাচ দেখাচ্ছে মেয়ে।
বসন্ত বারিক। সুদীর্ঘ একবছর সুদূর পাথর কারখানায় কাজ সেরে এইমাত্র ঘরে ফিরেছেন। বসন্তের সংসারে অবশ্য এ মুহূর্তে মধুর ধ্বনিতে মনে মনে হারিয়ে যাবার পরিস্থিতি নয়। বস্তির পঞ্চাশজন পুরুষ রাজস্থান গিয়েছিলেন গত পৌষে। কিন্তু সারা বছর যা মজুরি পেয়েছেন, তার অর্ধেকই দালাল কমিশন হিসেবে নিয়ে নিয়েছে। তাই কোনও মতে বাঁচিয়ে আনা নশো টাকাই এখন বসন্তের সম্বল।
পঞ্চাশজন গেলেও ঘরে ফিরেছেন মাত্র উনিশজন। বাকিরা কোথায় কেউ জানে না। এবং এক মাস হল ঐ উনিশজনই কর্মহীন। সরকারি খাতায় নাম না থাকায় তাঁরা পরিযায়ী শ্রমিকের সুবিধে পাননি। কেননা যে দালাল ঠিকাদার সংস্থার প্রয়োজন মেটাতে তাঁদের রাজস্থান নিয়ে গিয়েছিল তারা কেউই চায়নি ওঁরা এ সম্মান পান। ওঁদের মতোই, দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক খাতায় নাম না ওঠানোর খেসারত দিচ্ছেন প্রতিদিন। দেশের বিভিন্ন শপিং মল, সেতু, বহুতল নির্মাণে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে যাওয়া অনেকেই নির্মাণ কাজের জন্য চিকিৎসা, মৃত্যুকালীন ক্ষতিপূরণ সহ পেনশনের জন্য নির্বাচিত হন না। ১৯৯৬-এ এই অসহায় অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য বিশেষ আইন চালু করতে ‘নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ’ গঠিত হলেও তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাঁদের সুরক্ষার জন্য বরাদ্দ সেস ঠিকঠাক খরচই হয় না বছর বছর। এক সংসদীয় প্রতিবেদন বলছে, বিগত কুড়ি বছরে দেশে সেস হিসেবে ৩৭ লক্ষ কোটি টাকা জমা পড়লেও খরচ হয়েছে মাত্র ৭.৫ লক্ষ কোটি। এই শ্রমিকদের বেশির ভাগই অসংগঠিত। যাদের ইউনিয়ন নেই, তাদের হয়ে বলার কেউ নেই। আর সেই সুযোগ নির্লজ্জের মতো গ্রহণ করছে ঠিকাদার সংস্থাগুলো।
মূলত তিনটি দিক আছে এই সমস্যার। এক, সেসের আওতায় শ্রমিকদের যথাযথভাবে নথিভুক্ত না করা। দুই, সেস ফাঁকি দিচ্ছে সংস্থাগুলো। তিন, সেসের অর্থ ঠিকঠাক খরচ হচ্ছে না। তাই দেখা যাচ্ছে যে, সরকারি খাতায় প্রায় ৪ কোটি শ্রমিকের নাম নথিভুক্ত থাকলেও সেসের সুবিধে পেয়ে থাকেন বাস্তবে প্রায় ২.৫ কোটি শ্রমিক। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন বলছে দেশে নির্মাণ শ্রমিকের সংখ্যা বারো কোটিরও বেশি। তার মানে প্রতি তিনজনে দু’জনের নামই সেসের জন্য নথিভুক্ত হয় না। যে নির্মাণে ১০০০ থেকে ১৫০০ শ্রমিক কাজ করেছেন, ঠিকাদার সংস্থাগুলো খাতায় কলমে সেখানে মাত্র ৫০ থেকে ৬০ জন দেখাচ্ছে। প্রশাসন নির্বিকার। কোথাও সেসের টাকা জন প্রতি মজুরদের মজুরি থেকে কাজ দেওয়া বাবদ কমিশন হিসেবে কেড়ে নেওয়ার দৃষ্টান্ত আছে। কোথাও বা পায়ের বুড়ো আঙুলে মাস্টার রোলে ছাপ দিয়ে ভুয়ো বিল হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। সরকারি সমীক্ষায় দেখা গেছে সরকারি নির্মাণে বরাত পাওয়া ঠিকাদার সংস্থা বা কোনও বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠী ছাড়া বেশির ভাগ ঠিকাদার সংস্থাই সেসের টাকা ফাঁকি দেয়। ফলে, সরকারি সেসের যে টাকা বৃহৎ সংখ্যার শ্রমিকদের সঞ্জীবনী সুধা হতে পারত, তা হয়নি। একটা সিস্টেমকে নিজেদের স্বার্থে ভেঙে দেওয়ার ফল যা হবার তা-ই হয়েছে। নিয়মানুসারে শ্রমিকদের মাত্র ত্রিশ টাকা খরচ করে নাম নথিভুক্তকরণের যে ব্যবস্থা, সেখানেই গয়ংগচ্ছ মনোভাব প্রকট।
আসলে নির্দিষ্ট পরিযায়ী শ্রম আইন থাকায়, সরকার থেকে ঠিকাদার সংস্থা কেউই চায় না নির্মাণ শ্রমিকদের নাম খাতায় উঠুক। কেননা পরিযায়ী শ্রমিক হলেই দায়বদ্ধতা বাড়বে সরকারের। বিপদে আপদে তাঁদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে হবে, মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সর্বোপরি কাজের নির্দিষ্ট সময়পঞ্জীর বাইরে কাজ করানো যাবে না। এত সাতসতেরো মেনে নিয়ে সেসের টাকা তাঁদের জন্য ব্যয় হলে চলবে কেন!
এসব ভাবতে ভাবতে বাইরে তাকিয়ে দেখি, একটা মিছিল এগিয়ে আসছে এদিকেই। ঠিক দেখছি তো? কোনও পতাকা নেই। ধর্মের রঙ নেই। কেউ বলছে না ‘খেলা হবে’! বিজয় মিছিল হয়। কিন্তু হেরে যাওয়ার পর মিছিল হয়? হয়। কারণ এরা হেরে যাওয়ার পরেও অপরাজিতা। যেমন সামনের নীল চুড়িদার। লাবণী। ক্লাস নাইনেই প্রথম প্লেনে ওঠা বস্তির মেয়ে। গবেষক দম্পতির ছেলেকে সারাদিন চোখে চোখে রাখতে স্ট্যাচু অব লিবার্টির দেশে উড়ে গেল। স্বাধীনতা বিসর্জনের পাঁচ বছর পূর্ণ হল ক্রমে। চুক্তি হয়েছিল পঞ্চাশ হাজারে। বাচ্চা বড় করে লাবণী ফিরেছিল ঠিক দোলের আগের দিন। বন্ধুরা তখন কলেজ পেরিয়ে অনেক দূর। লাবণীর মাধ্যমিক পাশ হয়নি। এও এক নারীপাচার। ইচ্ছের ইচ্ছেমৃত্যু। জবাব চাই? পাই না। মিছিল শুরু তিনটায়।
ঐ পাশের যে মেয়েটি চুপচাপ আকাশ দেখছে, শপিং মলের দরজায় একটানা দাঁড়িয়ে আগতদের ব্যাগের তল্লাশি চালাত। পাশে চেয়ার থাকলেও ব্যবহার ছিল না। দীপু তামাং। সিকিমের মেয়ে। সকাল নটা থেকে বিকেল পাঁচটা। বারোমাস দাঁড়াতে দাঁড়াতে এখন আর দাঁড়াতেই পারে না। শিরদাঁড়ার টুকরো সরে গেছে সেই কবে। তরতাজা মেয়েটি বাতিল ঘড়ির মতো পড়ে থাকে পাহাড়ের নির্জন গাঁয়ে। কেউ কথা রাখে না। মল ম্যানেজার অপেক্ষা করেনি। তাড়িয়ে দিয়েছিল। চিকিৎসার কানাকড়িও দেয়নি। দীপুও এইমাত্র পাহাড় থেকে নেমে হুইল চেয়ারে বসে মিছিলে যোগ দিয়েছে মায়ের সঙ্গে।
ঐ যে, ওড়নায় মুখ ঢেকে এগিয়ে আসছে আরেকটি মেয়ে। এক যৌনকর্মী। খদ্দেরের ইচ্ছের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। পুরুষ মানুষের রাগ অ্যাসিড হয়ে শবনমের ফুলের মতো মুখটাকে পুড়িয়ে দিয়েছিল। ৬ বছর কেস চলার পর খদ্দের বেকসুর খালাস। আজ শবনম জংশনে ফুল বিক্রি করে। ওর জুঁই, বেলি দিয়ে সেজে ওঠে উৎসববাড়ি থেকে শেষযাত্রায় মৃতদেহের খাট। শবনমও বিচার চাইতে মিছিলে শামিল হয়েছে।
বিকেল হয়ে আসে শহরের মাথায়। হোমের গাড়ি নামিয়ে যায় তমন্না সোরেনকে। কী হয়েছিল? পরিচারিকার কাজ করত। সোনার দুল চুরির অপবাদে জামা খুলে ‘তল্লাশি’ চালালেন মালিককাকু। ফ্রক জুড়ে রক্তাক্ত হয়ে অজ্ঞান দু’দিন পড়েছিল তমন্না। ঘেন্নায় নাকি লজ্জায়, বাড়ি মেয়েকে ফিরিয়ে নেয়নি আর। এখন হোমই তমন্নার ঘর ও বাহির। সেও জাস্টিস চাইতে এসেছে মিছিলে।
ভিড় বাড়ে। সাহস বাড়ে মেয়েদের। লক্ষ্য করুন মিছিলের শেষে হাঁটছে শ্যামলা বর্ণের এক মেয়ে। মাথার বেণীতে লালফুল। অনাবিল হাসি। টু-হুইলার শোরুমের রিসেপশনে বসা হতভাগ্য মানবী। আচমকা একদিন শটসার্কিটের আগুনে ঝলসে গেল ক্রেতা সামলানো দু’হাত। এমএ পাশ কন্যা এখন নিজের নামটিও সই করতে পারে না। থেবড়ে গেছে অনামিকা। মধ্যমা ঝলসে হয়েছে নিথর মাংসপিণ্ড। প্রতিষ্ঠান ক্ষতিপূরণ দেয়নি।একটা পরাভবের মিছিল। এগিয়ে যায় নগরের দিকশূন্যপুরে। কেউ দেখতে পায় না। আপনার ডাইনিং টেবিলের ডানদিক ঘুরে, বেডরুমের চড়াই উতরাই বেয়ে, বারান্দা হয়ে রোজ স্টাডিটেবিলের পাশে ফুল ওঠা পর্দাঢাকা জানলা দিয়ে এমন একটা মিছিল ছুটে যায়। আপনি দেখতে পান না।
অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা যোজনার আওতায় আসতে হলে বয়স ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে হতে হয়। নির্মাণ এবং পরিবহণ ক্ষেত্রের শ্রমিকেরা ছাড়া অন্য অসংগঠিত শ্রমিকের পারিবারিক মাসিক আয় সাড়ে ৬ হাজার টাকার মধ্যে থাকতে হয়। নির্মাণ ও পরিবহণ ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য অবশ্য মাসিক পারিবারিক আয়ের কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। শ্রম দফতর সূত্রে খবর, আগে অসংগঠিত ক্ষেত্রে নথিভুক্ত কোনও শ্রমিকের মৃত্যু হলে রাজ্য সরকার তাঁর পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা সহায়তা দিত। তা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা হয়েছে। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে সহায়তার পরিমাণ এক লক্ষ থেকে দু’দফায় বেড়ে দু’লক্ষ টাকা হয়েছে। একই ভাবে বাড়ানো হয়েছে অবসরভাতা এবং চিকিৎসা, শিক্ষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্যের পরিমাণও। দুর্ঘটনায় একটি চোখের দৃষ্টি হারালে, একটি হাত অথবা পায়ের কর্মক্ষমতা হারালে এক লক্ষ টাকা সহায়তা মেলে।
এ প্রসঙ্গে এক ডেপুটি লেবার কমিশনার জানান, সামাজিক সুরক্ষা যোজনার সুবিধাগুলো অসংগঠিত শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে দিতে একটি সুরক্ষিত ও তথ্যসমৃদ্ধ পোর্টাল রয়েছে। সেখানে অনলাইনে নাম নথিভুক্তির জন্য আবেদন করা যায়। যাচাইয়ের পরে আবেদনকারী অসংগঠিত শ্রমিক হিসেবে এই যোজনায় নথিভুক্ত হন। নথিভুক্তির বার্তা তাঁর মোবাইলে পাঠানো হয়। ব্লক এবং পুরসভা স্তরে নাম নথিভুক্তির জন্য রয়েছে শ্রমিক কল্যাণ সহায়তা কেন্দ্র। তা ছাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত এবং ওয়ার্ডে স্বনিযুক্ত শ্রম সহায়কের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। কিন্তু খাতায় কলমে থাকলেও বাস্তবে তা খায় না মাখে, সে সম্পর্কে সরকারের কোনও প্রচার নেই। ফলে এমন সব অলীক অজ্ঞাতবাসে যুগে যুগে বসবাস করছেন এই অধিকারহীন শ্রমিকরা। বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন এআইটিইউসির এক জেলা সম্পাদকের কথায় বললে— ‘‘শ্রমিক মেলা করে কী হবে, যদি শ্রমিকেরাই তাতে সুযোগ না পান?”