বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

মুক্তিকামী প্যালেস্তাইন ও উপনিবেশবাদ

মুক্তিকামী প্যালেস্তাইন ও উপনিবেশবাদ

কমল দাস

photo

৭ অক্টোবর হামাসের অতর্কিতে আক্রমণের পর ইজরায়েল আত্মরক্ষার অজুহাতে ‘হামাসবিরোধী অভিযান’–এর নামে প্যালেস্তাইনের গাজা অঞ্চলের সাধারণ মানুষের উপর নারকীয় অত্যাচার নামিয়ে এনেছে। এই বর্বরোচিত আক্রমণে গাজায় মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, আশ্রয়ের অধিকার, হাসপাতালে আহত মানুষের চিকিৎসার অধিকার, খাদ্যের অধিকার, পানীয় জলের অধিকার, জ্বালানি ও বিদ্যুতের অধিকার, ফোন ও ইন্টারনেটের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে নির্মমভাবে। গাজা কার্যত পৃথিবীর বৃহত্তম কারাগার বা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। ইজরায়েলের নয়া নাৎসি বাহিনী গাজাসহ সমগ্র প্যালেস্তাইনকে উপনিবেশে পরিণত করতে যুদ্ধে নেমেছে।

৭ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত ইজরায়েলি সেনার একতরফা আক্রমণে গাজায় নিহত হয়েছেন ১১,২৪০ জন। নিহতের তালিকায় ৪৬৩০ জন শিশু এবং ৩১৩০ জন নারী। তিনদিক অবরুদ্ধ করে ইজরায়েল গাজায় যে নারকীয় হত্যালীলা চালাচ্ছে তাতে ২৩ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। গাজায় ধ্বংস্তূপের নীচে এখনও পর্যন্ত ৩২৫০ জন মানুষ চাপা পড়ে আছেন, যাদের জীবিত থাকার সম্ভাবনার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারছে না। এদের মধ্যে ১৭০০ জন শিশু। গাজার ৭০ শতাংশ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। প্যালেস্তাইনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেও ইজরায়েলের আক্রমণ অব্যাহত। সেখানেও ইতিমধ্যে ১৮৬ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৪ জন শিশুকে নিশানা করা হয়েছে। আহত অন্ততপক্ষে ২,৪০০ জন। সেখানে ইজরায়েলি সেনা ২৮৬০ জন সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে। ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্স গাজায় ঢুকে বেছে বেছে হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র, স্কুল-কলেজ, উপসনালয়, দোকানপাট বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে যাতে সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাপন তছনছ হয়ে যায়। অন্যদিকে হাজার হাজার প্যালেস্তিনি শ্রমিকদের ইজরায়েল ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১৫ লক্ষ প্যালেস্তিনিকে গাজা ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। ইজরায়েল গাজায় ২৫ হাজার টনের বেশি বোমা নিক্ষেপ করে ফেলেছে, যা হিরোসিমা–নাগাসাকির পারমাণবিক বোমার সমতুল্য। গাজায় কর্মরত রাষ্ট্রপুঞ্জের ১০৮ জন স্বেচ্ছাসেবক নিহত হয়েছেন।

৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণে ইজরায়েলের ১২০০ মানুষ নিহত হন। হামাসের হাতে বন্দি হয় ২০০ জনের বেশি ইজরায়েলি। এ কথা ঠিক যে, হামাসের আক্রমণে ইজরায়েলের এত বড় ক্ষয়ক্ষতি এর আগে কখনও হয়নি। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ হামাসের এই আক্রমণের প্রতিবাদ জানিয়েছে। তবে, একই সঙ্গে আমাদের এ কথা মনে রাখতে হবে, জন্মলগ্ন থেকে ইজরায়েল রাষ্ট্র যুদ্ধ ও সন্ত্রাস চালিয়ে যত সংখ্যক মুক্তিকামী প্যালেস্তিনিকে হত্যা করেছে, তার তুলনায় এই ক্ষয়ক্ষতি অত্যন্ত নগণ্য। হামাসের এই ইজরায়েল আক্রমণের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতকে উপেক্ষা করা যায় না।

গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত গাজার শাসক হামাসকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে ইজরায়েল প্যালেস্তিনিদের ওপর আক্রমণ অত্যাচার চালিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। প্যালেস্তিনি মুক্তিকামী গোষ্ঠীগুলি ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে বা বিমান অপহরণ করে, ইজরায়েলের প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের কারারুদ্ধ করে মুক্তিপণ দাবি করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে আসছে। ৭৫ বছর ধরে ইজরায়েল সরকার প্যালেস্তিনিদের উপর নারকীয় আত্যাচার নামিয়ে এনে তাদের খিদে এবং রাগ বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ ১৯৪৮ সালের আগে পৃথিবীর মানচিত্রে ইজরায়েল নামে কোনও দেশের অস্তিত্বই ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা অত্যন্ত সুকৌশলে এই অঞ্চলকে দখল করে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে। আবার এই ব্রিটিশরাই আরব দুনিয়াকে কোনঠাসা করার জন্য এই অঞ্চলে ইহুদিদের স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন ও ব্রিটিশরা ইউরোপ ও অন্য জায়গা থেকে ইহুদি ধর্মাবলম্বী মানুষদের নিয়ে এসে সংখ্যাগুরু আরবদের মতামতকে কোনও মূল্য না দিয়ে ইহুদিদের জন্য ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। শুধু রাষ্ট্র নয়, আজব রাষ্ট্র এই ইজরায়েল। প্রতিষ্ঠার দিন থেকে এই রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সীমানা লঙ্ঘন করে আরব ও প্যালেস্তিনিদের জমি দখল করে নিয়েছে বার বার। স্বভূমি থেকে উৎখাত হয়ে তারা জীবন জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। প্যালেস্তাইনের অপেক্ষাকৃত উর্বর জমি জায়নবাদীরা দখল করে সেখানে বসবাস শুরু করে। জেরুজালেমের আশেপাশের জমি দখল করে জায়নবাদীরা প্যালেস্তাইনের মধ্যে নিজস্ব কলোনি গড়ে তোলে। ইজরায়েল সরকারের প্রচ্ছন্ন মদতে কট্টরপন্থী জায়নবাদীরা প্যালেস্তিনিদের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ চালিয়ে এসেছে দীর্ঘদিন ধরে। খুন, জখম, রাহাজানি, অবরোধ তাদের নিত্যসঙ্গী। গাজা স্ট্রিপকে ইজরায়েল মুক্ত জেলখানায় পরিণত করেছে। তিন দিক অবরুদ্ধ গাজার ২৩ লক্ষ প্যালেস্তিনিয়দের উপর ইজরায়েল দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ চালিয়ে আসছে। খাবার, বিদ্যুৎ, জল বন্ধ করে গাজাবাসীকে তিল তিল করে মেরে ফেলার সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে গাজা পৃথিবীর বৃহত্তর মুক্ত জেলখানা।

ইজরায়েল নামক দেশটি গঠিত হওয়ার ঘোষণা পর্ব থেকেই প্যালেস্তাইনের জনগণ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ এই প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন বারেবারে। আরব দুনিয়ার আদি অধিবাসীদের উৎখাত করে ভুঁইফোড় ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠন করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছ পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ। একই সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার কর্তৃত্বমুক্ত স্বাধীন, সার্বভৌম প্যালেস্তাইন গঠনের দাবিও তীব্র থেকেই তীব্রতর হয়েছে। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর প্যালেস্তাইন জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে ‘প্যালেস্তাইন লিবারেশন আর্গানাইজেশন’–কে মান্যতা দিয়ে রাষ্ট্রসংঘ প্যালেস্তাইনকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। পৃথিবীর ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৩৯টি দেশ প্যালেস্তাইনকে রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিয়েছে। ইজরায়েল-আমেরিকা এই স্বীকৃতি মানতে নারাজ। তারা আন্তর্জাতিক নিয়ম অগ্রাহ্য করে প্যলেস্তিনিয়দের উপর শোষণ, নিপীড়ন, গুপ্তহত্যা, প্রকাশ্য অপহরণ, অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে বহু দিন ধরে। প্যালেস্তিনিরা এই নির্যাতন থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেন। শুধু স্বীকৃতি নয়, স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণ তাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য তারা প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সামিল হন। সেই প্রতিবাদ কখনও শান্তিপূর্ণ হয়, কখনও আবার রক্তাক্ত হয়। প্যালেস্তাইনের বিবেক, কবি মাহমুদ দরবিশের কবিতায় আরবদের জীবন যন্ত্রণার কথা ব্যক্ত হয়েছে…

লিখে রাখুন, আমি একজন আরব।
আপনি তো আমার বাপ পিতামহের আঙুর খেত দখল করেছেন, জমিও কেড়ে নিয়েছেন, যা চাষ করতাম আমি আর আমার ছেলেরা মিলে। আমার জন্য আমার নাতিপুতিদের কিচ্ছুটি ফেলে রাখেননি, পাথর ছাড়া। আপনাদের সরকার সেটাও কেড়ে নেবে, এখন তো এ-সবই বলছেন, তাই না? বাস্তুহারা, স্বজনহারা প্যালেস্তিনিরা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে চায়। ফলে ইজরায়েল আর গাজার লড়াই, ইহুদি আর মুসলিম সম্প্রদায়ের লড়াই হিসেবে দেখলে অত্যন্ত ভুল করা হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর সহযোগিতায় আরব দুনিয়া জুড়ে ইজরায়েলের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার গভীর এবং গোপন ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ এই যুদ্ধ। অন্যদিকে মুক্তিকামী প্যালেস্তিনিরা কাঙ্খিত স্বাধীনতার জন্য আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের দ্বি-রাষ্ট্রের যুক্তি মেনে স্বাধীন এবং সার্বভৌম প্যালেস্তাইন গঠনই পশ্চিম এশিয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতির একমাত্র কার্যকরী সমাধান হতে পারে। অন্য কোনও পথ খোলা নেই।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.