বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

ছাত্র-রাজনীতি ও র‍্যাগিং

ছাত্র-রাজনীতি ও র‍্যাগিং

কমল দাস

photo

কেউ বলছেন নেশার আঁতুর ঘর। কারো মতে আতঙ্কপুর। কেউ কেউ বলছেন উচ্ছৃঙ্খলতার উপবন। কারো মতে বেয়াদব, বখাটে, বেপরোয়া ছেলেমেয়েদের নির্বিঘ্নে নেশা করার জায়গা হল যাদবপুর। কেউ আবার এক ধাপ এগিয়ে বলছেন, পুলিশ ঢুকিয়ে আচ্ছা করে রাম ধোলাই দিল সব সোজা হয়ে যাবে। শাসন নেই বলেই এতো বাড়াবাড়ি। জুতো দেখিয়ে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকিও দিচ্ছে কেউ কেউ। আরো অনেক অনেক ধমকানি-চমকানি চলছে প্রতিনিয়ত।

প্রথম বর্ষের ছাত্রের স্বপ্নদ্বীপের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর টেলিভিশনে, কাগজে, সমাজ মাধ্যমে, রাস্তা-ঘাটে, অফিস-আদালতে, মিছিল-মিটিংএ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সম্পর্কে আক্রমণ আছড়ে পড়ছে। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে কলকাতায় পড়তে আসা এক তরতাজা যুবকের ভয়ঙ্কর মৃত্যু সংবেদনশীল মানুষকে বিচলিত করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত পড়ুয়াকে যেভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অপরাধীর তকমা সেঁটে দেওয়া হচ্ছে, তাকে স্বাভাবিক বলা যায় কিনা তা একটু ভেবে দেখার অনুরোধ করছি। গত কয়েকদিন ধরে হোস্টেলে ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রতিবাদ করতে গিয়ে যা যা ঘটল বা ঘটানো হল, তাও কি সহিংসতা এবং অসহিষ্ণুতার অন্য রূপ নয়!

যাদবপুরের প্রাক্তনী এবং হোস্টেলের প্রাক্তন আবাসিক হিসেবে স্বপ্নদীপের মৃত্যুতে আমিও মর্মাহত, যন্ত্রণাদীর্ণ এবং বিচলিত। কিন্তু বিশ্বাস করুন, যাদবপুর আমাদের কাছে কোনওদিন আতঙ্কপুর ছিল না। বরং ছিল স্বপ্নপুর। হোস্টেল ছিল আমাদের কাছে আবেগের অন্ত:পুর। অফুরন্ত আনন্দের উৎস। আজও হোস্টেল জীবনের কথা মনে পড়লে উদ্বেলিত হই। তখন র‍্যাগিং ছিল না, একথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। তবে তা কোনও সময় ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হয়ে ওঠেনি। নবীন আবাসিকদের সঙ্গে সিনিয়রদের আচরণ ঠাট্টা-তামাশার সীমা ছাড়িয়ে বল প্রয়োগের নিদর্শন হয়ে উঠতে কোনওদিন দেখিনি। কোনওদিন দেখিনি জুনিয়রকে নিয়ে সিনিয়রা যূথবদ্ধভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করছে। বরং নবীন-প্রবীণদের মধ্যে ছিল সৌহার্দ্যের পরিবেশ। হোস্টেলের নতুন আবাসিক কোনও সমস্যায় পড়লে পুরাতনদের নির্দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি। ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি নিজেদের সংকটে বা বৃহত্তর সামাজিক সমস্যায়। যূথবদ্ধতা থেকে যৌথতায় উত্তীর্ণ হওয়ার একটা তাগিদ ছিল সেদিনের ছাত্র সমাজের মধ্যে। গত তিন দশকে ছাত্র-মননে এমন কি পরিবর্তন ঘটল যা তাকে এতোটা হিংস্র করে তুললো।

সবল সহপাঠীর কাছে দুর্বল সহপাঠীর হেনস্তা হওয়ার দৃষ্টান্ত আমাদের সাহিত্যেও পাওয়া যায়। মহাভারতে দরিদ্র দ্রোণাচার্যের পুত্র অশ্বথামাকে তার ধনী সহপাঠীরা পিটুলি গোলা খাইয়ে মস্করা করেছিল। এও তো এক ধরনের র‍্যাগিং। এখানে বলে রাখা দরকার, র‍্যাগিং ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার মাত্র। অপেক্ষাকৃত দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার। র‍্যাগিং হল সমাজ-মনে লালিত হওয়া এক ধরনের ক্ষমতার প্রদর্শনের রাজনীতি যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চারিয়ে যায় গোপনে গোপনে। সৌরভ চৌধুরীরা মঙ্গল গ্রহ থেকে খসে পড়া কোনও ভিনগ্রহের প্রাণী নয়; আমাদের পরিবারের সন্তান। পরিবারে, প্রতিবেশে, সমাজের সর্বত্র আধিপত্য বিস্তারের নগ্নরূপ এবং ক্ষমতা দখলের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা নেতাদের দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা একজন মানুষের চেতনায় ক্ষমতা দখলের বীজ বপন হয়ে যায়। নারীর উপর পুরুষের, দরিদ্রের উপর ধনীর, দুর্বলের উপর সবলের, সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যা গুরুর দখলদারিত্বের যে ছবি সমাজেই জায়মান, তারই কিছুটা প্রভাব ছাত্র সমাজে চারিয়ে যাবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

“ছাত্রাং অধ্যয়নং তপ” বৈদিক এই উচ্চারণ স্মরণে রেখেও একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, রাজনীতির সঙ্গে ছাত্র জীবনের একটা গভীর সংযোগ রয়েছে। বর্তমান ছাত্ররাই দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক। তাদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে, দেশ গঠনের গুরু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে আগামী দিনে। আবার অন্যরা সমাজ-অর্থনীতি-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বহুবিধ ক্ষেত্রে দেশ ও জনহিতের কাজে যুক্ত হবে। ছাত্রাবস্থাতেই বৃহত্তর সামাজিক-গণতান্ত্রিক পরিমন্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠলে ছাত্রদের মধ্যে দেশ-সমাজ-রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। দেশে ও মানুষের প্রতি এই পথ বেয়ে গড়ে ওঠে দায়িত্ববোধ। তাই ছাত্রদেরকে রাজনীতি বিযুক্ত করার অপচেষ্টা দেশ ও দেশের মানুষের পক্ষে মঙ্গলকর নয়। তবে এ ক্ষেত্রে একটা কথা মনে রাখা খুবই জরুরি, মহান আদর্শ এবং দেশ ও জনহিতের বৃহত্তর গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে, সমাজিক সমস্যার অংশীদার হয়ে ছাত্র সংগঠনকে পরিচালিত করতে না পারলে, তা রাজনীতির কানাগলিতে ঘুর পাক খায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সমস্ত ছাত্র সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে ইউনিয়ন দখল করে আছে, তাদের সিংহ ভাগের সঙ্গে দেশে ও রাজ্যের বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরের সঙ্গে সংযোগ নেই। তারা ক্যাম্পসের বাইরে, সমাজের অন্যান্য সমস্যা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়। এরা ফ্যাসিস্ট মোদি-মমতার বিরুদ্ধে গাল ভরা স্লোগান আওড়ায়। কিন্তু লক্ষাধিক শিক্ষকের পদ শূণ্য থাকার জন্য রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলির শিক্ষা যখন কার্যত শিকেয় ওঠার রাস্তায় যায়, গরীব-প্রান্তিক মানুষের শিক্ষার অধিকার কার্যত কেড়ে নেওয়া হয়, তখন তারা চুপ করে থাকে। দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সম্পর্কহীন বলেই তারা ক্যাম্পাসের ক্ষুদ্র পরিসরে দখলদারি কায়েম রাখতে চায়। অপেক্ষাকৃত দুর্বল আবাসিকের উপর র‍্যাগিংএর নাম করে নামিয়ে আনে অকথ্য অত্যাচার। ডিএসএফ, ডব্লিউটিআই, ফ্যাসের মত সংগঠন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মধ্যে ছাত্র রাজনীতির নাম করে যে বিমূর্ত রাজনীতি ও ছাত্র সংগঠন পরিচালনা করে, তা শুধুমাত্র ছাত্র সমাজের উপর আধিপত্য কায়েম রাখার চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। এরাই পরবর্তী জীবনে দেশ-সমাজ-রাজনীতি থেকে উদাসীন থেকে বিদেশে চলে যায় অথবা দেশে থেকে নয়া উদারবাদে জারিত হয়ে আত্মসর্বস্ব জীবন কাটায়। এরাই কর্মক্ষেত্রে অধস্তনদের উপর আধিপত্য চালায়। হোস্টেলে নবাগত ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে, এখনও পর্যন্ত যে সমস্ত ছাত্র পুলিশ হেজাতে আছে, তারাদের মধ্যে কেউ এসএফআই বা বাম মূলধারার ছাত্রকর্মী নয়। সবাই ডিএসএফ, ডব্লিউটিআই, ফ্যাসের কর্মী।

শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছাত্র আন্দোলন সমাজ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তখনও চীনা কমিউনিস্ট তৈরি হয়নি, চীনের ১৯১৯ সালের ৪ঠা মে-র ছাত্র আন্দোলন সমস্ত চীনকে আন্দোলিত করেছিল সামাজ্যবাদীদের স্বার্থবাহী ভার্সাই চুক্তির বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ শাসকদের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ অকুতভয়ে সামিল হয়েছেন। সুভাস চন্দ্র বোস, ভগৎ সিং, ক্ষুদিরামের মতো মহান দেশপ্রেমিকেরা ছাত্রাবস্থা থেকে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন। চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট দশকের ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে কাতারে কাতারে শ্রমিক-কৃষককে সংগঠিত করার গুরু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। বিদেশ থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসে জ্যোতি বসু শ্রমিক সংগঠনের কাজে নেমে পড়েছিলেন। জাতীয় স্তরের অনেক প্রতিষ্ঠিত নেতার ছাত্রাবস্থায় রাজনীতির হাতে খড়ি হয়েছিল। ছাত্র আন্দোলনের এই পরম্পরা থাকা সত্বেও আজকের ছাত্র সমাজ এতোটা রাজনীতি বিমুখ কেন? ব্যক্তি স্বার্থকে জীবনের ধ্রূব তারা করে, যে কোনও প্রকারে অন্যকে পিছনে ফেলে, অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছানোই তার জীবনের লক্ষ্য করে তুলছে কেন? কেনই বা সহপাঠী বা সহ-আবাসিকের প্রতি এতোটা নিষ্ঠুরতা জমা হচ্ছে তাদের মনে? নয়া উদারনীতি পর্বে শিক্ষা পণ্যে পরিণত হয়েছে। আর্থিক স্বচ্ছলতা সম্পন্ন পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা অর্থের জোরে বাজার থেকে শিক্ষা কিনে নিয়ে জীবনকে পল্লবিত করে তুলতে সক্ষম হলেও মেধাবী অথচ দরিদ্র ঘরের ছাত্রটিকে অর্থের অভাবে সেই সুযোগ না পেয়ে উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে। নয়া উদারনীতির কল্যাণে ছাত্র সমাজের মধ্যেও শ্রেণী বিভাজন ও বৈষম্য তীব্র হয়ে উঠেছে। গ্রাম ও শহরের দরিদ্র-নিম্নবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছাত্ররা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়তে যেতে না পেরে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভিড় জমাচ্ছে। প্রতিযোগিতা হচ্ছে তীব্রতর। এই প্রতিযোগিতা ছাত্র সমাজকে আরো অসহিষ্ণু করে তুলছে কিনা তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.