বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার পুরনো রোগ মোকাবিলায় চাই নতুন-পুরনো দাওয়াইয়ের মিশেল

স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার পুরনো রোগ মোকাবিলায় চাই নতুন-পুরনো দাওয়াইয়ের মিশেল

সুমিত মজুমদার

photo

করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের অভিঘাত কতটা মারাত্মক, সর্বগ্রাসী হতে পারে তার পুলিশী ঘেরাও দমনের মুখে প্রমাণ আজ সবার সামনে। স্বাধীন ভারতবর্ষে তো বটেই, স্মরণাতীত কালে মারি-মন্বন্তরের ইতিহাসের যতটুকু সুলুকসন্ধান আমরা পাই কোনখানেই এই বিপর্যয়ের সমকক্ষ তুলনা মেলা কঠিন। এই অতিমারির মোকাবিলায় দিনরাত এক করে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন ডাক্তার-নার্স সহ অসংখ্য স্বাস্থ্যকর্মী, পাড়ায় পাড়ায় ছুটে চলেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যরা। তবুও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ওঠা-নামার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলা এই অনিশ্চিত রেখচিত্রের সামনে, ক্রমবর্ধমান ওষুধ-অক্সিজেন-ভ্যাকসিনের চাহিদার সামাল দিতে গিয়ে সরকারি বন্দোবস্তের নাভিশ্বাস ওঠার ছবিই কিন্তু বারবার সামনে এসেছে।
বিশ্বব্যাপী এই অতিমারি কমবেশি সব দেশকেই নাড়া দিয়ে গেছে, আপেক্ষিক ভাবে জনবহুল উন্নয়নশীল দেশগুলিতে খানিকটা বেশিই, কিন্তু ভারতের মতো এতটা নাজেহাল অবস্থার নজির খুব একটা নেই। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে হয়ত আত্মবীক্ষণের চাইতে বাস্তব সমস্যার মোকাবিলায় কি করণীয় তা নিয়েই আলোচনা-পরিকল্পনা করা উচিত, তবুও খামতির ব্যাধিগুলিই যখন পুরনো তখন তার দাওয়াইয়ের খোঁজ একটু অতীত-ভবিষ্যৎ ঘেঁটেই পেতে হবে, উপায় নেই! স্বাস্থ্যব্যবস্থা-পরিকল্পনার ক্রমশ বড় হতে থাকা এই ছিদ্রগুলি মেরামত না করতে পারলে এই ধরনের সংকট ভবিষ্যতেও এড়ানো মুশকিল।
সরকারি ব্যয় বরাদ্দের নিম্নমুখী খতিয়ান
প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে স্বাস্থ্যখাতে এত নগণ্য সরকারি অর্থবরাদ্দ ভারতের সঙ্গে আয়তনে বা আর্থসামাজিক মাপকাঠিতে তুলনা করা যায় এমন কোনও দেশই করে না। যেখানে ব্রাজিলে মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি-র সাড়ে নয় শতাংশ, চীন বা মেক্সিকোতে প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে খরচ করা হয় – যায় অধিকাংশই আসে সরকারি তহবিল থেকে – ভারতে তা মেরেকেটে সাড়ে তিন শতাংশ। এর বেশিরভাগটাই (প্রতি একশ টাকায় প্রায় পঁয়ষট্টি টাকার মত) অবশ্য আমার-আপনার পকেট থেকে চিকিৎসার জন্যে খরচ করা টাকা। শুধুমাত্র সরকারি অর্থবরাদ্দ ধরলে এই হিসেব কমে দাঁড়ায় আমাদের জিডিপি-র এক শতাংশের কাছাকাছি। গত বাজেটে অবশ্য পানীয় জল, পয়ঃপ্রণালী, আইসিডিএস-এর মত বিষয়ে অর্থবরাদ্দকে স্বাস্থ্যের আওতায় দেখিয়ে এই হিসেবটাকে একটু ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে – তবুও তা দেড় শতাংশ ছাড়ায় নি। মাথাপিছু হিসেব ধরলে গত প্রায় দু’দশক ধরে দেশের সরকার জনপ্রতি বছরে খরচ করেছে চল্লিশ ডলারের আশেপাশে, অর্থাৎ আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা মাত্র। জাতীয় আয়ের অন্তত চার শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে সরকারি খরচের দাবি বহুদিনের – নিয়ম করে সরকারি স্বাস্থ্যনীতিগুলি এমনকি সর্বশেষ আর্থিক সমীক্ষাও এর থেকে খানিকটা নেমে এসে আড়াই-তিন শতাংশ (অর্থাৎ বর্তমান খরচের অন্তত দ্বিগুণ) করবার প্রতিশ্রুতি আউড়ে গেছে, ফল হয়নি কিছুই। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে চাইলে এই প্রাথমিক শর্তটি এড়িয়ে যাবার কিন্তু উপায় নেই।
কিন্তু কেবল অর্থের সংস্থান করলেই কি সুরাহা হবে? কি ভাবে খরচ করা যেতে পারে, বা করা উচিত এই প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অর্থের? এই উত্তরের সঠিক হদিস পাবার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সুস্থভাবে চলবার দাওয়াই।
অস্বীকার করবার উপায় নেই যে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি যেটুকু নির্ভরতা এখনো রয়েছে তা মূলত শহুরে, বড় হাসপাতাল-কেন্দ্রিক। বুনিয়াদি বা প্রাথমিক এবং মাঝারি পরিকাঠামোর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবহেলা করে, নানাভাবে পঙ্গু করে রেখে এই মাথাভারী ব্যবস্থা সাধারণ সময়েই ভিড় সামলাতে হাঁসফাঁস, মহামারির সময়ে তার ধসে পড়া আশ্চর্য নয়। নীচের তলার সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির পরিকাঠামোগত ঘাটতির কথা নিয়ে নতুন করে আলোচনা করবার অবকাশ-প্রয়োজন কোনওটাই নেই। ইদানীং নানা রাজ্যে ভোটপ্রার্থী সরকার আধা-ছোট শহর এলাকায় কিছু ঝাঁ-চকচকে হাসপাতাল বানিয়েছে বইকি, কিন্তু যে ধরনের উদ্যোগ-পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে এগুলিতে চিকিৎসা-চিকিৎসকের প্রয়োজনীয় রসদের যোগান ধারাবাহিক ভাবে সুনিশ্চিত করা যায় তার ঘাটতি থেকে গেছে। তাই কেবল বেশি খরচ করাই কিন্তু উন্নয়নের কোন স্বয়ংক্রিয় গ্যারান্টি নয়, প্রয়োজন খরচ-খয়রাত না ভেবে বিনিয়োগের চোখে দেখা, সদর্থক পরিকল্পনা দিয়ে তা বাঁচিয়ে রাখা।
চাই উপযুক্ত সংখ্যায় প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী
আমাদের দেশে – সরকারি বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই – ডাক্তার তো বটেই, অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা চোখে পড়বার মোট কম। সদ্য প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে অনুপ করণ ও সহযোগীরা হিসেব করে দেখিয়েছেন যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মী মিলিয়ে যেখানে প্রতি ১০০০০ জনসংখ্যায় ৪৫ জনের মতো প্রশিক্ষিত কর্মী থাকা আবশ্যিক, আমাদের দেশে সেখানে সংখ্যাটা মাত্র এগারোর মতো। এর মধ্যে বেশিরভাগই আবার দক্ষিণ এবং উত্তর ভারতের বড় শহরগুলিতে সীমাবদ্ধ; নার্স বা ফার্মাসিস্টদের মত পেশার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশেরই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ বা স্বীকৃত যোগ্যতা নেই। জেলাস্তরের নীচে বেশিরভাগ সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে ডাক্তার-নার্স-প্যাথলজিস্টদের বহু পদ দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে, আবার অনেক জায়গায় নানারকম সার-অসার কারণ-অজুহাতে হাজিরা অনিয়মিত। এই অসামঞ্জস্যের অন্যতম প্রধান কারণ দীর্ঘদিন ধরে প্রয়োজনের তুলনায় সারা দেশেই অস্বাভাবিক রকমের কম মেডিক্যাল, নার্সিং, ফার্মেসি বা অন্যান্য প্যারামেডিক্যাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। সরকারি উদ্যোগে দেশজুড়ে এই ধরণের প্রতিষ্ঠান চালু করবার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ রাজ্যেই একটা গয়ং-গচ্ছ মনোভাব চলে এসেছে – অধুনা সময়ে মূলত এই ধরনের কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে বটে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা মোটেও যথেষ্ট নয় – এইসব জায়গায় পড়বার বা প্রশিক্ষণ নেবার খরচও বহু মানুষের আয়ত্তের বাইরে। বিস্তারিত কারণ বা তার সমাধান খুঁজবার সুযোগ এই পরিসরে নেই, তবে এই ধরনের প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর অবিলম্বে বেশ কয়েক গুণ বৃদ্ধি যেমন জরুরি, তেমনই প্রয়োজন এক্ষেত্রে বর্তমান ভৌগোলিক এবং আর্থসামাজিক ব্যবধানগুলো খেয়াল রাখা।
ওষুধপত্রের লাগামছাড়া দাম নিয়ন্ত্রণ
কোভিডের চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে যে আরেকটি বিষয় আলোচনায় উঠে এসেছে তা হলো প্রয়োজনীয় ওষুধের পর্যাপ্ত যোগান এবং তার দাম সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে থাকা। বিশ্বের অন্যতম অগ্রগণ্য ওষুধ প্রস্তুতকারক দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাজারে বেশিরভাগ জীবনদায়ী ওষুধের দাম আমাদের দেশের গড় আয়ের সাপেক্ষে রীতিমত চড়া, এবং ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। একদিকে বিভিন্ন স্তরে নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও বেশিরভাগ ডাক্তারবাবুদের কোম্পানির নামে এবং অনেকক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মাত্রায় ওষুধ প্রেস্ক্রিপশান লেখা, একই ওষুধ বিভিন্ন কোম্পানির নানা দামে বিক্রি করা, অন্যদিকে ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানী আর খুচরো ওষুধ বিক্রেতার মধ্যে কমিশনভোগী বিস্তৃত চক্র, ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া – সমস্যা নানাবিধ। নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন একথা অনস্বীকার্য, আবার তা নতুন কোনও কথাও নয়। প্রশ্ন উপযুক্ত কর্মপন্থা ও কৌশলের। ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি, এক শ্রেণীর চিকিৎসক, বেসরকারি হাসপাতাল ইত্যাদি প্রভাবশালী লবির চাপ তো আছেই, তার ওপর এই বেপরোয়া প্রতিপক্ষকে লাগাম পড়ানোর মতো প্রয়োজনীয় ঢাল-তরোয়াল-সেপাই-সান্ত্রী সবই সরকারের অকুলান। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত অবশ্যই আছে - যেমন কিছু রাজ্যে সরকারি হাসপাতালগুলিতে জেনেরিক বা কোম্পানির নাম ছাড়া ওষুধ প্রেস্ক্রিপশান করবার ব্যাপারে খানিকটা বেশি কড়াকড়ি করা, তামিলনাডুর মতো কিছু রাজ্যে কমদামে ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলির কাছ থেকে ওষুধ কিনে প্রত্যন্ত হাসপাতালগুলিতেও নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বিতরণ করার নির্ভরযোগ্য পরিকাঠামো। কিন্তু সারা দেশজুড়ে কোনও সামগ্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা না গেলে এক্ষেত্রে স্থায়ী কোনও সমাধান হওয়া মুশকিল।
উন্নত পরিসংখ্যান, উন্নততর প্রশাসন
যে কোনও দেশেই জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সঠিক সময়ে পাওয়া নির্ভরযোগ্য তথ্য। পরিচিত অসুখবিসুখ বা অচেনা মহামারির বিবরণ ও ওঠানামার হিসেব, চিকিৎসাব্যবস্থার প্রয়োজনীয় লোকবল, যন্ত্রপাতি, বা ওষুধপত্রের যোগান সবকিছুই সুষ্ঠুভাবে বোঝা এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া একমাত্র সম্ভব একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে উঠে আসা, সঠিক ভাবে সঙ্কলিত তথ্যের ভিত্তিতে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এইরকম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক আমাদের দেশে অধিকাংশ রাজ্যেই অত্যন্ত অবহেলার পাত্র হয়ে রয়ে গিয়েছে। এই অতিমারির সময়েও বহুক্ষেত্রে স্বচ্ছ, নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানের অভাবের ফলে সরকার-প্রশাসনকে নানারকমের সমস্যার সন্মুখীন হতে হয়েছে, নানারকম গুজবও সুযোগ পেয়েছে ডালপালা মেলবার। মহামারি আইনকে কাজে লাগিয়ে কোনওরকমে জোড়াতালি দিয়ে হয়ত আপাতকালীন একটা ব্যবস্থা খাড়া করা গিয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে না আছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালগুলির তথ্যভাণ্ডারকে একটা সামগ্রিক ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসার উদ্যোগ পরিকল্পনা, অথবা এলাকায় এলাকায় সঠিক ভাবে জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন দিকগুলি নিরীক্ষণের ব্যবস্থা। এমনকি নির্দিষ্ট আইন থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুর প্রকৃত কারণ, মৃত ব্যক্তি সম্বন্ধীয় প্রয়োজনীয় আর্থসামাজিক তথ্য ইত্যাদি অনেক সময়েই সঠিকভাবে নথিভুক্ত করা হয় না – তাঁর সঙ্গে হারিয়ে যায় পরবর্তীতে জনস্বাস্থ্যের গতিপ্রকৃতি বুঝবার এক অন্যতম উপযোগী সূত্রের। স্বাস্থ্যব্যবস্থার অন্য আরও অনেক পুরনো রোগের মতোই এই অবস্থার পরিবর্তনেও চাই সঠিক পরকল্পনা, এবং প্রয়োজনীয় অর্থ-লোকবল- মেধার সংমিশ্রণ। উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে বিপুল তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা, এবং সেই তথ্যের সাহায্যেই নানা নির্দিষ্ট কর্মসূচি নেওয়ার উপযোগিতা আজকাল সারা বিশ্ব জুড়েই স্বীকৃত এবং প্রমাণিত। তা অগ্রাহ্য করে, মান্ধাতার আমলের ত্রুটিপূর্ণ পরিসংখ্যানের ব্যবস্থাকে চালিয়ে গেলে ভবিষ্যতে আরও কঠিন মূল্য চোকাতে হবে।
স্বাস্থ্য-গবেষণার গুরুত্ব
করোনা-মোকাবিলার অভিজ্ঞতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে চেনা-অচেনা রোগের উৎসসন্ধান, রোগজীবাণুর রকমফের বোঝা এবং সেইমত সঠিক চিকিৎসাপদ্ধতি নির্দিষ্ট করা সবেতেই - এবং হয়ত সবচাইতে বেশিই – প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ পরামর্শের। তা কেবলই সম্ভব একদিকে এই ধরনের গবেষণার উপযোগী অত্যাধুনিক সুবিধাযুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং অপরদিকে সেই গবেষণার ফল সঠিক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থায় সামিল করা। আমাদের দেশে এখনও খুব অল্প রাজ্যেই প্রয়োজনীয় এবং উন্নত গবেষণা – পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগ রয়েছে, বহু মেধাবী ছাত্রছাত্রী হয় গবেষণাকে পেশা হিসেবে দেখতে আকৃষ্ট হয় নি, অথবা পা বাড়িয়েছে বিদেশের পথে। এখানেও সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে, রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে দিতে হইবে গবেষণার সুযোগ-পরিকাঠামো, আকর্ষণ করতে হবে মেধাবী ছেলেমেয়েদের। একমাত্র তবেই কমবে পরনির্ভরশীলতা, এড়ানো যাবে সঠিক মোকাবিলার পন্থা নির্দিষ্ট করবার ক্ষেত্রে অহেতুকু অপেক্ষা, ভুলভ্রান্তি।
...এবং রাজনীতি
ভারতের মত এত বিরাট এবং আঞ্চলিক তারতম্যের দেশে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে একঢালা জাতীয় নীতি-নিরূপণ অসম্ভব, অবাস্তবও বটে। যদিও সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বাস্থ্যকে অনেকাংশেই রাজ্যগুলির ওপর ছেড়ে দেওয়া আছে, কিন্তু স্থানীয় লোকবলের অভাব, প্রশাসনিক ক্ষমতার গোলমেলে বিন্যাস, জেলা বা ব্লকস্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং রূপায়নের ক্ষমতা ইত্যাদি নানারকমের প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে যথাযথ স্বাধীন ভাবে কতটা স্থানীয় দাবি-চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করা যায় তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তার ওপর আবার রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের এক্তিয়ার-বহির্ভূত ছড়িঘরানো, সঙ্কীর্ণ রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে এক সঙ্গে কাজ করবার মানসিকতার অভাব অনেকক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে তার খামতিগুলো ছাপিয়ে উঠতে দেয় না, আটকে রাখে গতানুগতিক নেই রাজ্যে। একটা দেশব্যাপী মহামারি এসে সাময়িকভাবে অনেকক্ষেত্রেই ব্যক্তি এবং সামগ্রিক উদ্যোগের একটা যুদ্ধকালীন তৎপরতা এনে দেয়, কিন্তু দীর্ঘদিনের জমে থাকা অবহেলা-গাফিলতির পাঁক সরিয়ে ফেলতে পারে না।
জনস্বাস্থ্য গণস্বাস্থ্য হয়ে না উঠলে তা সম্ভবও নয়।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.