বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জুলাই, ২০২২— ‘মাগ্গি’ শব্দটা প্রায় জ্ঞান হওয়ার বয়স থেকেই শুনে আসছি। চটকল এলাকায় বেড়ে ওঠার সুবাদে মাগ্গি কলের সঙ্গে পরিচিতি ছিল। জানতাম সাধারণত বিলাসপুরী মহিলাদের জন্যই এই শব্দটি ব্যবহার হয়, শব্দটির মধ্যে অসম্মান লেগে আছে কিনা জানা ছিল না সেই বালিকাবেলায়, বিলাসপুরী যুবতী নারীদের ‘মাগ্গি’ এবং কাছা দিয়ে শাড়ি পরা মারাঠি প্রৌঢ়াদের ‘বাঈ’ বলে ডাকার রেওয়াজটা চটকল এলাকায় খুবই প্রচলিত ছিল। সাধারণত বিলাসপুরী এই রমণীরা চটকলে সেলাই ঘরে কাজ করতেন এবং বাঈরা কাজ করতেন মহল্লার বিভিন্ন ঘরে পরিচারিকা হিসেবে। অর্থাৎ মাগ্গি বা বাঈ শব্দটি যে কোনও মহিলার জন্য নয়, শুধুমাত্র কর্মরত মহিলা শ্রমিকদের জন্যই ব্যবহৃত হতে দেখেছি আজ থেকে পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে থেকেই। এই শব্দগুলোর অসম্মান বোঝার অনুভব এসেছে আরও অনেক পরে, ততোদিনে দেখেছি রেগে গেলে কর্মরতা নারীদের ‘মেয়েছেলে’ বলে রাগ দেখানোর মধ্যেও এক ধরনের পৌরুষ প্রকাশ করা হয়।
ধান ভাঙতে শিবের গীত গাইলাম এই জন্যই যে আজ থেকে পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে উদারনৈতিক সময়েই যদি নারী শ্রমিক সম্পর্কে এই ভাবনা সমাজে থেকে যায় সেখানে আজকে দক্ষিণপন্থার বাড়বাড়ন্তের সময়ে নারী শ্রমিক কি দশায় পৌঁছতে পারে। দক্ষিণপন্থীরা নারীকে রান্নাঘর আর আঁতুড়ঘরে আটকিয়ে রাখার কথা ভাবে, আজকে তাদের শাসনকালে একজন নারীশ্রমিককে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে এতটা আশা করার কোনও কারণ নেই। দু’বছরের করোনা পর্ব পেরিয়ে সমস্ত কর্মক্ষেত্রেই যেখানে মন্দা চলছে সেখানে নারী শ্রমিকদের প্রতি বঞ্চনার ছবিটা দেখলে চমকে উঠতে হয়।
নারীর অধিকার, নারীদের মজুরি সহ নানা বিষয়ে সমঅধিকার নিয়ে অনেক সভা-সেমিনার হয়ে থাকে। কিন্তু সম্মান বা অধিকারের প্রশ্ন তো দূর অস্ত একজন নারী শ্রমিক, পুরুষ শ্রমিকের সমান মজুরি পাওয়ার সীমানাতেই পৌঁছতে পারল না। লকডাউন উত্তর সময়ে এই বৈষম্যের ছবিটা আরো অনেকটা প্রকট হয়ে উঠেছে।
পুরুষ শ্রমিকের সমান কাজ করেন নারী। কিন্তু তাদের অর্ধেক মজুরি দেওয়া হয়। শুধুমাত্র আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীর বহু দেশেই এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। হিসেবটা অনেকটা এই রকম— একজন পুরুষ শ্রমিকের দিনভর কাজের মূল্য যদি ৪০০ টাকা হয়, তবে নারী শ্রমিকের জন্য এই মূল্য ২০০-২৫০ টাকা। এর বিরুদ্ধে গিয়ে প্রতিবাদের পথটাও প্রায় আটকানো। ভয় দেখিয়ে বা সম্মানের গল্প বলে নারী শ্রমিকের অসম্মানের যে প্লাটফর্মটা তৈরি করা হয়েছে সেটাকে ব্যবহার করেই প্রতিদিন একেকজন নারী শ্রমিককে শোষণ-পীড়নের শিকার হতে হয়। আনুষ্ঠানিক খাতে নারী-পুরুষের বেতন-বৈষম্য অনেকটা কম হলেও অনানুষ্ঠানিক খাতে বৈষম্য তীব্র। গবেষক, নারী উদ্যোক্তা এবং সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে— সর্বস্তরের আয়বৈষম্য নিরসন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
কাজের মধ্যে পুরুষরা বিশ্রামের বিরতি নিলেও নারীরা তা তেমন নেন না; কিন্তু পুরুষরা ৪০০ টাকা মজুরি পেলে নারীরা পান অর্ধেক। নারীরা ইটভাটায় কাজ করেন। ইট বহন কষ্টকর কাজ। পুরুষ শ্রমিকরা দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা পেলে, নারীরা সর্বোচ্চ পান সেখানে ৩০০ টাকা। সমান টাকা চাইলে কাজ থেকে বাদ দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় পুরুষ শ্রমিকরা মাটি কেটে দেন, সেই মাটি বহন করেন একজন নারী শ্রমিক। তারপরও নারী শ্রমিকরা বেশি মজুরি-বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। পাথর ভাঙা, প্রক্রিয়াকরণ, সমতল ভূমিতে চাষ করা, চায়ের পরিচর্যা, চা-পাতা সংগ্রহ, চা-কারখানা, নির্মাণ ক্ষেত্র ও কৃষিকাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমানতালে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিনই পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে কাজে অংশ নিচ্ছেন নারী শ্রমিকরা; কিন্তু মজুরি সমান নয়। প্রতিদিন সকালে পুরুষ সদস্যদের অন্তত এক ঘণ্টা আগে কাজে যোগ দেন নারীরা। দিন শেষে আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পরে কর্মস্থল ত্যাগ করতে হয় তাদের। এরপরও তাদের মজুরি বৈষম্যের শিকার হতে হয়। কাজের ধরন ও সময় অনুসারে মুজরি নির্ধারণ করা হলেও নারীরা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকের অর্ধেক কিংবা তার চেয়েও কম মজুরি পান। পরিবারের ক্ষুধা নিবারণে বৈষম্য উপেক্ষা করে কাজ করতে হয় তাদের। অসুস্থ হলে কিংবা কাজে একটু ত্রুটি ধরা পড়লে বেতন কাটা থেকে শুরু করে কাজ হারাতে হয়। অনেক সময় কটূক্তির শিকার হলেও মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। কাজে যোগ দিতে এক ঘণ্টা দেরি হলে দেড় ঘণ্টা শ্রম দিতে হয়। অনেকসময় বাচ্চা কোলে নিয়েও তাদের কাজ করতে হয়। এ জন্য ‘কাজের ক্ষতি হচ্ছে’ অভিযোগে অতিরিক্ত আরো এক থেকে দেড় ঘণ্টা কাজ আদায় করে নেওয়া হয়।
মজুরি বৈষম্য কেবল ব্যক্তিমালিকানাধীন বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই নয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানেও এমন ঘটনা দেখা যায়। করপোরেশনের সাফাইকর্মীদের অনেক সময় দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি নারী শ্রমিকদের নিয়োগও হয় এই পদ্ধতিতে। এ ক্ষেত্রে দু’টি ক্যাটাগরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। দক্ষ ও অদক্ষ। এ ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের বেশির ভাগই অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নারীরা কাজে কোনও ফাঁকি দেন না। যথাসময়েই কাজে হাজির হন। কর্মজীবী নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জীবিকার তাগিদে কর্মক্ষেত্রে মজুরিবৈষম্য মেনে নিয়েই কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকতে হচ্ছে তাদের। ঘরের কাজ সেরে বাইরের কাজে শরিক হচ্ছেন তারা। এভাবে পুরুষের পাশাপাশি সংসারে আর্থিক সহায়তা দিতে অবদান রাখছেন তারা। এ জন্য তাদের তেমন কোনও অভিযোগ নেই। তবে এই নারীদের ভাষ্য থেকেই জানা যায় যে, কারণে-অকারণে কর্মচ্যুতির শিকার হন তারা। অনেক সময় নির্যাতনের শিকারও হতে হয়। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এ বৈষম্য আরো বেশি। অনেক সময় মানরেগার ১০০ দিনের কাজেও এই বৈষম্য প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
মালিকদের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সস্তা শ্রমে কাজ আদায় করা। নারীদের কাছ থেকে সস্তা মূল্যে শ্রম আদায় করা যায়, সে জন্যই তারা এমন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। রাষ্ট্র্রীয়ভাবে ন্যূনতম মজুরি কাঠামো রয়েছে, তবে তা খাতায় কলমে। পরিচারিকা সহ এমন অনেকগুলো ক্ষেত্র আছে যেখানে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণের হার ৭০ শতাংশ। তার মানে এই কাজে নারী শ্রমিকরাই দক্ষ। নারীরা দক্ষ ও সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করেন। সে হিসেবে নারীদের অংশশ্রহণ বাড়ছে। কিন্তু এরপরও পুরুষের চেয়ে তাদের মজুরি কম দেওয়া হয়। তাদের ঠকানো যায়। এটা আমাদের দেশে নারীদের প্রতি চরম বৈষম্য। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণেই এটা হচ্ছে। মালিক শ্রেণীর মুনাফা বাড়াতে নারী শ্রমিকরা মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
তবে এখন প্রতিবাদ হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তনও হয়েছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, নারী-পুরুষ সমন্বয়ে কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই, এ ধরনের মানসিকতা ও বৈষম্য থেকে সমাজ মুক্তি পাক। সমাজে নারী ও পুরুষের মজুরি বৈষম্য দূর হয়ে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হোক।