বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
‘মানবিক মূল্যবোধ’ কি নেহাতই একটা কথার কথা? নাকি সত্যিই তার কোনও মানে আছে? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা প্রথম বর্ষের ছাত্র স্বপ্নদীপ কুন্ডুর বীভৎস হত্যাকান্ড প্রশ্নটাকে আরও জোরালো করে তুললো।
প্রচলিত রাজনীতির জগতে এক আশ্চর্য মানসিকতা কাজ করছে। “খুঁজে দ্যাখ কোন দলের সঙ্গে অভিযুক্তের যোগাযোগ ছিল। যদি অন্য কোনও দলের সঙ্গে যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া যায়, চেপে ধর। আর যদি আমাদের দলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে, চেপে যা। কিম্বা ঘুরিয়ে দে।”
ব্যক্তিগত এবং সামাজিক অধঃপতনের সঙ্গে এই কদর্য অপরাধের যেন কোনও যোগাযোগ থাকতেই পারে না! সবই যেন কোনও-না-কোনও রাজনৈতিক ‘দল’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই ঘটে! আসলে সামাজিক সুস্থতা এবং মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে কোনও অ্যাজেন্ডাই নেই রাজনৈতিক দলগুলোর। শুধুই ‘রাজনৈতিক’ এবং ‘অর্থনৈতিক’ ভাষণ। দিনের শেষে, পরবর্তী ‘ভোট’-এ সম্ভাব্য আসন সংখ্যাই মূল লক্ষ্য। অতএব, সেই অনুযায়ী হিসেবী পদক্ষেপ করাতেই তো ‘রাজনৈতিক’ বুদ্ধিমত্তার পরিচয়! ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগের বন্যা বইছে এখন, তার কোনটা নতুন? দীর্ঘদিন ধরে সকলে সবকিছুই তো জানতো। কেউ কোনওদিন কিচ্ছুটি বলেনি কেন? আজ যেন সকলেই হঠাৎ আকাশ থেকে পড়ে এগুলো জানছে!
যত দিন যায়, রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বেড়েই চলে। সকলেই যেন ‘জনগণের ভালো’ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ! নেতা-নেত্রীদের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। মিটিংয়ে মিছিলেও লক্ষলক্ষ মানুষ জড়ো হয়। পাশাপাশি, সামাজিক অপরাধও বেড়েই চলেছে! ‘খুন’ হয়ে উঠেছে অতি পরিচিত, অতি স্বাভাবিক, দৈনন্দিন ব্যাপার! ‘ধর্ষণ’-এর ঘটনাবলীও গা-সওয়া হয়ে উঠছে! ‘জালিয়াতি’ যে কোনও শাসকগোষ্ঠীর আপাদমস্তক মুড়ে ফেলতে পারে, তা ছিল কল্পনারও বাইরে। “মিথ্যা বই সত্য বলিব না” - যেন হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক মোড়লদের শপথবাক্য।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, ফুলের কুঁড়ি স্বপ্নদীপের হত্যাকান্ড অনেক কিছুকেই ধীরেধীরে সামনে আনছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চরম অপদার্থতা। বিভিন্ন ‘ভাল ছাত্র’-দের বিকৃত মানসিকতা। নানা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের কদর্য ধান্দাবাজি। রাজ্য প্রশাসনের এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির তরফ থেকে “সব ব্যাটাকে ছেড়ে দিয়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর” মানসিকতা— যেভাবেই হোক কমিউনিস্ট রাজনীতির দিকে আঙুল তোলা। কিছু বিপ্লবী আপ্তবাক্যের মধ্যেই আত্মতুষ্টি পাওয়া। ইত্যাদি। বিশেষ করে উদ্বেগজনক, গভীর এবং ব্যাপক সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দিকটিকে সকলেই উপেক্ষা করার চেষ্টা।
পশ্চিমবঙ্গের বুকে শিশু-কিশোর-তরুণ-যুবদের উপর বীভৎস অত্যাচার এবং নির্মম হত্যাকাণ্ড নতুন কিছু না। অতীতে বহু ঘটেছে। বীভৎস সেইসব হত্যাকান্ডের কাহিনী এবং আলোকচিত্র ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হয়ে আছে। রাজনৈতিক কুশীলবরা সেই রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের ঘটনাবলীকে ভুলিয়ে দিতে চায়। থানার মধ্যে অত্যাচারিত ও মৃত ১৬ বছরের কিশোরের দেহ দেখে, ময়নাতদন্তের সময় ডোম হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছে— ছেলেটার পাঁজর, লিভার, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড সব ফাটা! পুলিশের হাতে সিগারেটের ছ্যাঁকার মালা পরেছে গলায়, এমন অনেকে আজও বেঁচে আছে। স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগটুকুও যে কেড়ে নেওয়া হয়েছে কতোজনের, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এসবই ছিল রাজনৈতিক আদর্শে উদ্ধুদ্ধ তারুণ্যকে পিষে মারার রাষ্ট্রীয় প্রয়াস।
স্বপ্নদীপের কী অপরাধ ছিল? সে তো ছিল নিষ্পাপ, পড়াশুনা করতে চাওয়া একটি ফুলের কুঁড়ি! তাকে কেন সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া হল? স্যাডিস্ট মজা! তাকে কেন মরতে হল? তথাকথিত ‘শিক্ষিত’-দের বেলাগাম স্পর্ধার আস্ফালন! এক্ষেত্রে অপরাধীদের একমাত্র প্রাপ্য ক্ষমাহীন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। ‘মানবাধিকার’ মানুষের জন্য, এইসব অ-মানুষের জন্য না।
অত্যাচারিত কিশোর স্বপ্নদীপের মৃত্যুর জন্য অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অপদার্থতাও বহুলাংশে দায়ী। এবং তার পিছনে ‘রাজনৈতিক’ যোগাযোগের ভূমিকাও যথেষ্ট। কিন্তু তার মানে কখনোই এই না, ‘ছাত্র’ শব্দটা জুড়ে গেলেই ‘ধোয়া তুলসি পাতা’ হয়ে গেল । ষাট-সত্তর দশকের উত্তাল সময়ে আমরাও জীবন বাজি রেখে ছাত্র আন্দোলনের শরিক ছিলাম। মদ-গাঁজা-চরসের সংস্কৃতিতে ছাত্রছাত্রী সমাজ প্লাবিত হবে, আমরা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি! মূল্যবোধের এতো ব্যাপক ও গভীর অবক্ষয় আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। রাজনৈতিক কারণে আমাদের বন্ধু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়ে বহিস্কৃত হয়েছে। কিন্তু মূল্যবোধহীনতার দায় কখনোই আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেনি। বিকল্প মূল্যবোধের পুঁজিই ছিল আমাদের গর্ব। একের পর এক বন্ধুরা বাইরে গণহত্যা কিম্বা জেলে বন্দীহত্যার বলি হয়েছে। নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছে। অপর ছাত্রকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু কোনও ‘স্বপ্নদীপ’কে হত্যার কলঙ্ক বইতে হয়নি। বিকল্প ও সুস্থ মূল্যবোধের দাপটে সবকিছু তছনছ হয়ে যাওয়াই ছিল যুগধর্ম।
আজ পরিবার, প্রতিবেশ, সমাজ, রাজনীতি— সবকিছুই অবক্ষয়ের শিকার। সেই পরিবেশ থেকেই উঠে আসছে পডুয়াদের দল। ফলে, অবক্ষয়ের দুর্গন্ধযুক্ত পাঁক তাদের মনেও থেকে যায়। সকলেই তার প্রভাবমুক্ত হতে পারে না। আজ শুধু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আঙুল তুললে সমগ্র শিক্ষাজগতের ক্লেদ মোছা যাবে না; সারা পশ্চিমবঙ্গ রক্ষা পারে না। এই গভীর সামাজিক সত্যকে আমাদের উপলব্ধি করতেই হবে। শুধু রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঠেঙাঠেঙি, একে-তাকে দোষারোপ বা গালাগালি, কয়েকটি ছাত্রকে ‘শাস্তি’ দিয়েই আনন্দ — এই সহজ রাস্তায় হাঁটলে আখেরে লাভ কিছুই হবে না। ভবিষ্যতে হয়তো আরও ‘স্বপ্নদীপ’-রা তাঁদের স্বপ্নের বৃন্ত থেকে খসে পড়বে।
আমাদের দায়ের বোঝা আরও বাড়বে!