বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
১৬ এপ্রিল, ২০২০, শ্রমজীবী ভাষা— করোনার সংক্রমণ রুখতে ২৪শে মার্চ, ২০২০ ভারতে লকডাউন শুরু হয়।এর পরেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের অন্যান্য আঠারোটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি লিখে সেই সব রাজ্যে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের গ্রাসাচ্ছাদনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন। অন্য প্রদেশে আটকে-পড়া বাংলার শ্রমিকদের জন্য আপৎকালীন হেল্পলাইন নাম্বার এবং ওয়েবডেস্কও চালু হয়। আটকে-পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্যার্থে রাজ্য প্রশাসন অন্য রাজ্যের সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে।
প্রশ্ন উঠবে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ রাজ্যে আটকে পড়া ভিনরাজ্যের শ্রমিকদের জন্য কী করছে? ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, প্রায় ২.২ লক্ষ শ্রমিক বাংলায় কাজ করতে আসেন। এ ছাড়া, বহু শ্রমিক জেলা থেকে কলকাতায় আসেন কাজের সন্ধানে, বিশেষত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে। ২২ মার্চ-এর 'জনতা কার্ফু' ও ২৪শে মার্চ থেকে শুরু হওয়া লকডাউন এই সব পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার ফুরসৎটুকু দেয়নি।
এই অবস্থায় কী পরিষেবা আর সুযোগসুবিধা পাচ্ছেন কলকাতায় আটকে-যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকরা? আমরা পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে আসা দুই ধরনের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। প্রথম দলটি বড়বাজার অঞ্চলে কুলির কাজ করেন, দ্বিতীয় দলটি মেটিয়াবুরুজের বস্ত্র উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। লকডাউনের সময়ে তাঁদের যে অভিজ্ঞতা হচ্ছে তেমনটা আগে কখনও হয়েছে কি না, প্রশাসনের তরফে পরিযায়ী শ্রমিকদের কী কী সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, কী তাঁদের প্রাপ্য, সে বিষয়ে তাঁরা কতটা জানেন— এই প্রশ্নগুলি তাঁদের করা হয়। এছাড়া এই নিবন্ধে এ রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রসঙ্গে সরকারী নীতির সঙ্গে কেরল প্রশাসনের নীতির একটা তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। কেরল ইতিমধ্যেই নানা মহল থেকে প্রশংসিত, সে রাজ্যে আটকে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধে দেওয়ার জন্য। এই নিবন্ধে আমরা দেখাতে চাই যে, আপৎকালীন পরিস্থিতি সামাল দিতে যে সব চটজলদি ব্যবস্থা নিতে হয় প্রশাসনকে, তা অনেকটাই নির্ধারিত হয় প্রচলিত ব্যবস্থার দ্বারা। সেই ব্যবস্থা, অর্থাৎ সরকারি নীতি এবং পরিষেবা পৌঁছনোর কাঠামো, যদি দুর্বল হয়, তা হলে যাঁরা সঙ্কটের মুখে সর্বাধিক বিপন্ন (যেমন কোভিড ১৯ অতিমারিতে পরিযায়ী শ্রমিক), তাঁদের কাছে পৌঁছনো কঠিন হয়। এর ফলে সমগ্র জনগোষ্ঠীই বিপন্ন হতে পারে।
বড়বাজার
বড়বাজার প্রকৃত অর্থেই বৃহত্তম পাইকারি বাজার, শুধু এই শহরের নয়, এই দেশেরও। মধ্য কলকাতার হাওড়া ব্রিজের পাশে এই বাজারের মধ্যে রয়েছে ছোট ছোট অনেকগুলি বাজার। কী না পাওয়া যায় এখানে, জামাকাপড়-জুয়েলারি-জুতো-ফল-খাদ্যশস্য-মসলা প্রভৃতি রকমারি জিনিস। সরু সরু গলিতে সারি সারি দোকান, মাল-বওয়া মুটেদের সঙ্গে মাথা ঠুকে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে সন্তর্পণে চলাফেরা করতে হয়। জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্রে এখন অপার স্তব্ধতা। ভূতের নগরীর মতো ঝাঁপ-ফেলা দোকান এখন ক্যানিং স্ট্রীট, বাগরি মার্কেট, আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে। ফুটপাথে শুয়ে-বসে, আলস্যে যাঁরা দিন কাটাচ্ছেন, তাঁরা প্রধানত পরিযায়ী শ্রমিক। অধিকাংশই দশকের পর দশক দিন গুজরান করেছেন এই বাজারে মাল বয়ে। এ রকমই একটি দঙ্গলের কিছু মধ্যবয়স্ক মানুষে জানালেন, বিহারের দ্বারভাঙ্গায় তাঁদের বাড়ি। কয়েক দশক আগে কাজের সন্ধানে কলকাতায় আসা ইস্তক ফুটপাথই তাদের আস্তানা। করোনার প্রকোপের পর কোনও 'নাইট শেল্টার'এর ব্যবস্থা এঁদের জন্য হয়নি। মাল ওঠা-নামা ও পরিবহনের কাজ করেন তারা, দৈনিক মুটেগিরি করে আয় গড়ে তিনশো থেকে ছয়শো টাকা, বিভিন্ন মরসুমে আয় বাড়ে-কমে। চৈত্র সেলের বাজারে ভাল আয় হবার সম্ভাবনা ছিল, করোনার জন্য সে আশা ফুরিয়েছে। আগে ফুটপাথেই একসঙ্গে রান্না খাওয়া-দাওয়া হত, কিন্তু বর্তমানে দোকান বন্ধ থাকার কারণে, ও হাতে পয়সার অভাবে, সে সব বন্ধ। দেশের বাড়িতে পরিবারের রেশন কার্ড রয়ে গিয়েছে, তাই এখানে বিনামূল্যে বিতরিত রেশনের চালও পাবেন না। কলকাতা পুলিশের দেওয়া খিচুড়ি দুই বেলা খাচ্ছেন - কখনো নাখোদা মসজিদ বা আশেপাশের মসজিদের লঙ্গরখানাতেও পাত পেড়ে বসছেন।
ক্যানিং স্ট্রীটের পরিযায়ী মুসলিম শ্রমিক পুলিশের খাবারের প্যাকেট নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, প্যাকেট নাকি ছোট হচ্ছে দিনকে দিন, খিচুড়িতে খালি চাল আর হলুদ - রুটিতে অভ্যস্ত মজুরের ওই খিচুড়ি পোষাচ্ছে না।
এই শ্রমিকদের প্রায় সকলেরই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে, নিয়মিত বাড়িতে টাকা পাঠাতে ব্যবহারও করেন, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষিত দিনমজুরদের জন্য যে একহাজার টাকা অনুদান, তা এঁরা পাওয়ার আশা করছেন না। কারণ তাঁরা এই রাজ্যের বাসিন্দা নন (যদিও শ্রম দফতরের এক আধিকারিক জানালেন যে এই ঘোষিত প্রকল্প, যার নাম'প্রচেষ্টা,' তার কোনও নির্দেশিকাই এখনও প্রকাশিত হয়নি, তাই পরিযায়ী শ্রমিকরা অন্তর্ভূক্ত নন, এ কথাও নিশ্চিত বলা সম্ভব নয়)। এঁরা স্বাস্থ্যসাথী বা ওই ধরনের কোনও বিমা বা সুরক্ষা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে পাননি কখনো। যে হেতু এঁরা কোনও নির্দিষ্ট মালিকের অধীনে কাজ করেন না, যাঁর যখন মাল তোলা-নামানোর দরকার তাঁর জন্য তখন কাজ করেন, ফলে এই অসময়ে কোনও মালিকের সাহায্য মেলেনি। উপরন্তু কোনও শ্রমিক সংগঠনকেও এই দুঃসময়ে দেখা যায়নি বলে সকলেই খানিক মর্মাহত। লাল ঝান্ডার আমলে কখনো সখনো ব্রিগেডে হাজিরা দিতে হয়েছে, কিন্তু কখনোই মজুরি নিয়ে অথবা অধিকার, ইমান নিয়ে আন্দোলনে শ্রমিক সংগঠনগুলো বিশেষ উদ্যোগী নয়। স্থানীয় ভোটে এই শ্রমিকদের কোনও ভূমিকা নেই বলে হয়তো এই নিষ্পৃহতা। তাঁদের নালিশ, একজন নেতাকেও আসতে দেখা যায়নি লকডাউনে। ক্যানিং স্ট্রীটে একজন শ্রমিক উত্তেজিত হয়ে বলছিলেন, কাকেদেরও দলনেতা থাকে, একসঙ্গে হাল্লাগুল্লা করে, কিন্তু মুটেদের কোনও নেতা নেই, তাই তাদের কথা বলার কেউ নাই। পুলিশও তাই অখাদ্য খাবার দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে।
লকডাউনের পর কয়েকজন গাড়ি ভাড়া করে দেশে ফেরার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় আটকে দিয়েছে, ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। সবাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, লকডাউন খুললেই যে ভাবে হোক বাড়ি যাবেন। গ্রামে অন্তত চাল, জোয়ার, বাজরা, আনাজ জুটে যাবে, এই তাঁদের ভাবনা। খবরে শুনেছেন, বহু শহরে শ্রমিক বাড়ি ফেরার জন্য শয়ে শয়ে কিলোমিটার হাঁটছে, পুলিশের লাঠি খাচ্ছে, মারা যাচ্ছে - সেই নিয়ে সরগরম আলোচনা। কেন লকডাউনের আগে বাড়ি যাবার সময়, সুযোগ দেওয়া হল না, সেই নিয়ে ক্ষোভ। আবার হেঁটে ফেরাদের দলে শিশু-নারীদের উপস্থিতি নিয়ে সেই সব শ্রমিকদের উপর ক্ষোভও জানালেন। বাচ্চাদের নিয়ে কেন মায়েরা দূর দেশে কাজ করতে গিয়েছিল? তাঁরা তো পরিবারকে কাজ করতে শহরের কঠিন ফুটপাতে আছড়ে ফেলেননি! তাঁরা বছরে দুবার বাড়ি যান, পরিবারকে প্রতি সপ্তাহে টাকা পাঠান, নিজেদের জন্য কিছু রেখে।
বয়স্ক মানুষগুলি জানালেন এই লকডাউনের পরিস্থিতি তাদের পরিযায়ী জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা।বিরানব্বই সালে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পরবর্তী দাঙ্গা বা অন্যান্য গুরুতর পরিস্থিতিতে শহরে কার্ফু ঘোষিত হওয়ার পরে তাদের এরকম দুরাবস্থা ছিল না, সেনার সামনে দিয়ে অন্তত দুহাত মাথার উপরে উঠিয়ে বাজার-খাবার দোকান যেতে পারতেন। কার্ফু ছিল মাত্র কয়েক দিনের জন্য। এ বারের দীর্ঘ লকডাউন পেটে চেপে বসেছে, পুলিশের খিচুড়ির দয়ায় বাঁচতে হচ্ছে। দাঙ্গার সময়ে আকস্মিক হানা আসার ঝুঁকি বেশি, কিন্তু দীর্ঘ দিনের অর্ধাহার, অনাহার আরও যন্ত্রণার।
লকডাউনে বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন 'সোস্যাল ডিস্টেন্সিং' এর কথা, কিন্তু আটকে যাওয়া বড়বাজারের কুলিমজুরদের সে সব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। ঝাঁক বেঁধে থাকাটাই তাঁদের দীর্ঘ অভ্যাস, ফুটপাথের খোলা উনুনের ধারে খেতে খেতে গল্পগুজব করা তাঁদের অবসর। পুলিশ কমদামী মাস্ক দিয়েছে, কেউ পরছেন কেউ পরছেন না, স্যানিটাইজার নেই - কর্পোরেশনের জলেই তেষ্টা মিটছে, সুলভ শৌচাগার ব্যবহার করছেন।
ধরা-বাঁধা রোজগার না থাকা সত্ত্বেও, কোনও সামাজিক সুরক্ষা না থাকা সত্ত্বেও কেন প্রতি বছর কলকাতা ফিরে আসেন তারা? দিল্লি-বম্বেতে তো দৈনিক আয় বেশি, কেরলে সরকারি সুযোগ সুবিধা আছে! 'আদত পড় গ্যায়া কলকাত্তা মেঁ' - দীর্ঘ দিন এক জায়গায় কাজ করে চেনা হয়ে গেছে এই শহর। অনিশ্চিত নতুন যায়গায় যাওয়ার চেয়ে এই ভাল, মনে করেন তাঁরা। তা ছাড়া বিহার-উত্তরপ্রদেশের মানুষ এখানে কাজ করতে আসেন দেশোয়ালি পরিচিতের সাহায্যে, আত্মীয়তার সূত্রে - ঠিকাদার ধরে কাজের খোঁজ কম। কোন রাজ্য কী কী সামাজিক সুরক্ষা দিচ্ছে, সে কথা তাঁদের জানা নেই, জানানোরও কেউ নেই।
মেটিয়াবুরুজ
কলকাতা বন্দর অঞ্চলে অবস্থিত মেটিয়াবুরুজ, মুসলমান ঘেটো হিসেবে পরিচিত। মেটিয়াবুরুজে আনুমানিক ১৫ হাজার ছোটো ছোটো গৃহভিত্তিক বস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে, মহেশতলায় প্রায় তিন হাজার। এখানকার উৎপাদিত বস্ত্র মূলত স্বল্প ক্রয়ক্ষমতার ক্রেতাদের জন্য -- লাভের হার খুবই কম থাকে। ছোটদের পোষাক বেশি তৈরি হয়।অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করলে ছোট ওস্তাগর, বড় ওস্তাগরদের খোঁজ পাওয়া যাবে। ওস্তাগর অর্থাৎ দক্ষ দর্জি। বড় ওস্তাগরদের পুঁজি বেশি, ছোটদের কম। এমব্রয়ডারি, সেলাই, রঙ ও প্যাকিং-এর কাজ ছোটো ছোটো ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটগুলিতে হয়, যেখানে আট-দশ জন শ্রমিক কয়েক মাসের জন্য আস্তানা গড়েন, রান্নাবান্না করে খান। 'ওয়াশে'র কাজের ধরনও প্রায় অনুরূপ। অন্যান্য কাজগুলি ঘরে ঘরে হয়, মহিলা ও শিশুরা বেশি অংশ নেন।
লকডাউনের পর বস্ত্র উৎপাদন শিল্পও স্তব্ধ। বাইরের রাজ্য/জেলা থেকে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের একটা বড় অংশ মহেশতলা, মেটিয়াবুরুজে আটকে আছেন, বাড়ি ফিরতে পারেননি। খবর পেয়ে আমরা একটি কারখানায় গেছিলাম, যেখানে ফ্রেট মেশিনে জিন্স রঙ করা ও শুকানো হয়। কর্মী সংখ্যা আট, দুই জন স্থানীয়, এখন কারখানায় রয়েছেন চার জন বিহারের বৈশালি জেলার বাসিন্দা, একজন জয়নগর (দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা), একজন তারকেশ্বরের (হুগলি)। বিহার থেকে আসা চার জনেই 'রুইদাস' জনগোষ্ঠীর (চামার), পদবী লেখেন কুমার।
এরা সকলেই এক ছাদের তলায় রান্নাবান্না করে খাচ্ছেন, মালিক চাল-ডাল, তেল, ডিম, মাংস সবই জোগাচ্ছে। শুনে আমরা চমকে গেলাম। এরকম মালিক হয় নাকি! তারপর জানা গেল, এ কেবল মানবিকতার তাগিদে নয়। এই শ্রমিক যদি এখন বাড়ি ফেরার জন্য পুলিশের কাছে যায় পাস বানাতে, এবং কোন কারখানায় কাজ করে তার খুঁটিনাটি জানায়, মালিক বিপদে পড়ে যাবে, কারণ কারখানাটিই বেআইনি। ফলে লকডাউন অবধি মালিক ফেরেস্তার ভূমিকা নিয়ে বন্দী শ্রমিকদের খাওয়াচ্ছে, ফের কারখানা খুললে এদের কাজে পেতেও সুবিধা হবে।মালিক প্রায় বন্ধু, শ্রমিকদের সঙ্গে একপাতে বসে খাবার খায়, বিড়ি টানে, গল্প করে। ঈদের আগে যে বিপুল পরিমাণ কাজ ধরার কথা ছিল, তা বন্ধ হওয়ায় মালিকের অবস্থাও সঙ্গীন - গাদা করা জিন্সের প্যান্টের স্তুপে বসে সকলের সঙ্গেই কথা হচ্ছিল।
শ্রমিকরা বারো ঘন্টা কাজের আট হাজার বেতন পান, চাহিদার সময় এক্সট্রা টাইমে উপরি ইনকাম হয় -শ্রমিকদের মধ্যে আবার ১৭-১৮ বছরের তিন ছোকরা আছে, ষাট বছরের বুড়িও আছেন। এক ছোকরা,গিয়াসুদ্দিন পুরকাইত জানাল, ক্লাস এইটে পড়তে পড়তেই সে মাস দুতিনেকের জন্য কাজে এসেছিল মেটিয়াবুরুজে, টাকার স্বাদ পেতেই তার আর পড়ায় মন বসেনি, পড়া ছেড়ে চলে এসেছে। বাড়ি জয়নগরে, কিন্তু সে ফেরেনি কারণ বাড়ি গেলেই চোদ্দ দিন ঘরে বন্দি রাখছে গ্রামের লোক। লকডাউন উঠলে এবার সে যাবেই।বিহারি রুইদাসদের মধ্যে যিনি একটু বয়সে বড়, মধ্য তিরিশের তিনি জানালেন তিনি সতের বছর এই কাজ করে এখন ম্যানেজার, পদোন্নতি হয়েছে, পনের হাজার টাকা বেতন পান। তারাও সকলে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়, কারণ কাজ না হলে বেতন মিলবে কিনা সন্দেহ। পাশেই রয়েছে আরেকটি ফ্রেট মেশিনের কারখানা, সেখানে রয়েছে বিহার থেকে আসা তিনজন, একই জাতের, একই গ্রামের, বন্ধু বা আত্মীয়তার সূত্রে এখানে পাড়ি দেওয়া।
দিনমজুরদের জন্য ঘোষিত সাহায্য সম্বন্ধে এরা জানেনও না, পাওয়ার আশাও করেন না। গোটা মেটিয়াবুরুজ শিল্পাঞ্চলে কোনও শ্রমিক ইউনিয়ন নেই, লক্ষ লক্ষ শ্রমিক থাকা সত্ত্বেও। মালিক, শ্রমিক কেউই জানে না শ্রম আইন ও অধিকারের কথা। পুরো ব্যবস্থাটাই মৌখিক প্রতিশ্রতি আর আত্মীয়তার ঢং-এ চলেছে - শ্রমনীতি, সে স্থানীয় শ্রমিক হোক বা পরিযায়ী, এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এখানে শ্রমিক ও ছোট মালিক সকলেই ধুঁকছে। লকডাউনের পর কাজ শুরু হলে আগের বেতন হয়তো কমে যাবে এই শিল্পটি টিকিয়ে রাখতে।
অনাহূত অতিথি
এই সব কথা থেকে এইটা আঁচ করা যায় যে, শহরে আটকে পড়া এই পরিযায়ী শ্রমিকদের কিছু রান্না-করা খাবার দেওয়া ছাড়া রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আর বিশেষ কোনও বন্দোবস্ত করা হয়েছে বলে এঁরা জানেন না।সরকারি সুযোগসুবিধা সম্বন্ধে খবরাখবর পৌঁছানোর কোনও ব্যবস্থা নেই।
শ্রম দফতরের অফিসারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এ রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সরকারি বরাদ্দ কিছু নেই বললেই চলে। অসংগঠিত শ্রম ক্ষেত্রের 'সামাজিক সুরক্ষা যোজনা' তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। 'সামাজিক সুরক্ষা যোজনা'-র মধ্যে প্রভিডেন্ট ফান্ড, দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ, ছেলেমেয়েদের লেখা পড়ার সুযোগ, স্বাস্থ্যবিমা, ইত্যাদি সুবিধে রয়েছে। কিন্তু এই প্রকল্পের অন্যতম শর্ত, নাম লেখাতে গেলে এই রাজ্যের বাসিন্দা হতে হবে। কলকাতা গেজেট-এ প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে (৬ এপ্রিল, ২০১৭) এমনই বলা হয়েছে।
আমরা এখানে কেরলের সরকারের নীতি স্মরণ করতে পারি। যেখানে কেরল মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কারস ওয়েলফেয়ার স্কিম ২০১০ যোজনায় নথিভূক্ত পরিযায়ী শ্রমিক চার ধরনের সুবিধা পানঃ দুর্ঘটনা/চিকিৎসা সংক্রান্ত ২৫,০০০ টাকার সাহায্য, মৃত্যু হলে পরিবারকে এক লক্ষ টাকার অনুদান, সন্তানের লেখাপড়ার আর্থিক সাহায্য, অন্তত পাঁচ বছর কাজের পর ছাঁটাই হলে এককালীন ২৫,০০০ টাকার অনুদান। কর্মরত শ্রমিকের মৃত্যু হলে দেহ সংরক্ষণ ও বিমানে দেহ নিয়ে যাওয়ার টাকাও পরিবার পাবে। এক কথায় যে সব সুবিধাগুলি কেরলের শ্রমিকরা পান, পরিযায়ীরাও সেগুলি পাবেন। কেরল প্রায় পঁচিশ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের ঠিকানা, যাঁরা পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িশা, ঝাড়খন্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে কাজের সন্ধানে গেছেন।
কেরল সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের অভিহিত করে 'অতিথি শ্রমিক' বলে। এই শব্দবন্ধটি দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন কেরলের অর্থমন্ত্রী টমাস আইস্যাক, ২০১৮ সালের রাজ্য বাজেট বক্তৃতায়, কেরলের অর্থনীতিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবদান উল্লেখ করতে গিয়ে। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হবার পর রাজ্যে আটকে-পড়া শ্রমিকদের আশ্বস্ত করতে মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন ফের একই শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন।
লকডাউনের পরবর্তী সময়ে, যখন বিভিন্ন শহর থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন, কেরল সরকার আটকে-পড়া শ্রমিকদের আশ্রয় দেবার অত্যন্ত সময়োপযোগী ব্যবস্থা শুরু করেছে। ৪৬০৩টি আশ্রয়ে প্রায় ১,৪৪,১৪৫ জন ভিন রাজ্যের ‘অতিথি শ্রমিক’কে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে, ৩৫টি অন্য ক্যাম্পে ১,৫৪৫ জন গৃহহীন ও ভবঘুরেদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। খাবার, মাস্ক, সাবান, স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করা হয়েছে ক্যাম্পগুলিতে - প্রয়োজনে আরো স্কুলকে ক্যাম্প বানানো হবে বলে জানিয়েছে কেরল সরকার। উল্লেখ্য, কেরলে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সুলভে আবাসন প্রকল্পের সুবিধাও বর্তমান।
এ রাজ্যের চিত্রটা কী? কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা অনুযায়ী পরিযায়ী শ্রমিকদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন সাতাশটি কেন্দ্র চালাচ্ছে। কিছু অস্থায়ী কেন্দ্রও বানানো হয়েছে। কিন্তু উপচে-পড়া ভিড়ের কারণে তথাকথিত 'সোস্যাল ডিস্টেন্সিং' ও সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা অসম্ভব। এপ্রিল ৯ তারিখের টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবর অনুযায়ী, প্রায় দশ হাজার ফুটপাতবাসী এই শেল্টারগুলিতে রয়েছেন, একটি শেল্টারেই রয়েছেন প্রায় চার হাজার জন। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের আধিকারিকরা চিন্তিত, শেল্টারগুলি সংক্রমণের 'হটস্পট' হয়ে উঠতে পারে। এ রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের আবাসনের বিষয়ে কখনওই চিন্তা করা হয়নি, অবৈধ বস্তি না হলে ফুটপাথই তাদের চিরকালের আশ্রয়। আন্দাজ হয়, সেই জন্যই এই আপৎকালে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।
অবশ্য কেরলের শিবিরগুলিতেই বা পরিযায়ী শ্রমিকরা কতটা নিরাপদ ও নিশ্চিত রয়েছেন সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে ক্যাম্পের সংখ্যা যে অনেক বেশি সেটা বোঝা যাচ্ছে, এবং সেখানে কী কী সুবিধে পাওয়ার কথা সে কথাও কেরলের আধিকারিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বারবার ঘোষণা করছেন। এ-ও মনে রাখতে হবে যে কেরলে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সুলভে আবাসন প্রকল্প অনেক আগে থেকে রয়েছে, যদিও তার সুবিধা কম শ্রমিকই পান। যাই হোক, এটা আমাদের মেনে নিতে অসুবিধা নেই যে পশ্চিমবঙ্গে পরিযায়ী শ্রমিক, যারা অনেক অংশে গৃহহীন, তাদের জন্য কোনও সুস্পষ্ট নীতি রাজ্য সরকারের নেই, ফলে এই কঠিন পরিস্থিতিতে এই শ্রমিকদের নিয়ে বর্তমানে সরকার বিব্রত।আমাদের সাক্ষাৎকারগুলি থেকে আমরা বুঝতে পারি পরিযায়ী শ্রমিক ও প্রশাসনের মধ্যে কোনও সংযোগ ও আদানপ্রদান নেই, এমনকী তার রাস্তাও তৈরি হয়নি। সরকারি প্রকল্প ও উদ্যোগের অভাবের জন্য পরিযায়ী শ্রমিকরা প্রশাসনকে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখে। এই নেতিবাচক মনোভাবের কারণে যেটুকু সুযোগ-সুবিধে পাওয়ার কথা ছিল, সেগুলির দিক থেকেও শ্রমিকরা মুখ ফিরিয়ে রাখেন। আপৎকালীন ব্যবস্থাগুলি তখনই কার্যকর হয় যখন আগে থেকে কিছু পরিকল্পনা থাকে, পরিষেবার কাঠামো তৈরি হয়। কোভিড ১৯ অতিমারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকারের প্রতি চোখ বুজে রাখা, মৌলিক সুবিধা থেকে তাদের বঞ্চনা, কী ভাবে সঙ্কটকালে গোটা সমাজকে বিপন্ন করতে পারে। 'কেরল মডেল' হয়তো খানিকটা চোখ খুলতে সাহায্য করবে।