বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

সে অন্নে যে বিষ দেয়

সে অন্নে যে বিষ দেয়

স্বাতী ভট্টাচার্য

photo

নিটোল বেগুনটি। বাড়ি এনে বেশ করে ধুয়ে যত্ন করে কাটলেন। দেখলেন, নরম সাদা বিছানায় দিব্যি শুয়ে নড়াচড়া করছে নধর একটি পোকা। কখনও বা একাধিক। তখন গজগজ করতে করতে সেই অংশটা খুবলে ফেলে দিয়ে বাকি বেগুনটা টুকরো করতে হয়। যদিও পোকাই বেগুনের আদি বাসিন্দা। আজকের সাড়ে তিনশো গ্রাম বেগুন যখন ছিল ফিনফিনে বেগুনি রঙের ফুল, তখনই গাছের পাতার পিছনে ডিম পেড়ে গিয়েছিল মা মথ। কড়ে আঙুলের মাপের সাদাটে এই পতঙ্গের ডিম থেকে সন্তান (লার্ভা) বেরিয়েছিল ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। বেগুন গাছের নরম ডাল খেতে খেতে এগিয়ে, শেষে শিশু বেগুনের বোঁটার দিক থেকে ঢুকে গিয়েছিল ফলের মধ্যে। তারপর নিশ্চিন্তে বড় হচ্ছিল সে, যত দিন না পড়েছে বঁটি কিংবা ছুরির কোপ।
পোকা বিরক্তিকর, কিন্তু পোকা মারতে চাষি যা করেন, তা ভয়ঙ্কর। ঘনঘন ছড়ান কীটনাশক, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার বিধিকে বহুগুণ ছাপিয়ে গিয়ে। তাতে খরচও বাড়ে, বাড়ে চাষির পরিশ্রম, আর তাঁর নিজের স্বাস্থ্যের ঝুঁকিও। তবু চাষি কখনও এক দিন অন্তর, কখনও বা প্রতিদিন, কীটনাশক তেল ছড়াতে বাধ্য হন, কারণ ব্যবহার করতে করতে পোকাও অভ্যস্ত হয়ে যায় বিষে, সয়ে যায়।
তা হলে চাষি পোকাহীন বেগুন ফলাবে কী উপায়ে? উপায় পরকীয়া। না না, চাষির নয়, পতঙ্গের। পুরুষ মথের সঙ্গে স্ত্রী মথ মিলিত না হলে ডিম হবে না। কিন্তু মিলনের আগেই যদি নিকেশ করা যায় পুরুষকে? সেই উদ্দেশে ‘ফেরোমন ফাঁদ’ তৈরি করা হয়। ফেরোমন হল যৌন মিলনের হর্মোন। স্ত্রী মথেরা সবাই ‘যোজনগন্ধা,’ দূর থেকে তাঁদের গন্ধ পেয়ে মিলনের জন্য উড়ে আসে পুরুষ মথ। খেতের মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্বে একটা বহু ছিদ্রযুক্ত টিউবের মধ্যে স্ত্রী মথের গন্ধ-ছড়ানো রাসায়নিক রেখে দিলে পুরুষরা সে দিকে ধেয়ে আসে, এবং ফাঁদে পড়ে প্রাণটি হারায়। সঙ্গীহারা স্ত্রী মথ আর ডিম পাড়তে পারে না, বেগুন থাকে সুরক্ষিত।
এই পদ্ধতিতে চাষ করে এক কুইন্টাল বেগুনে মাত্র চারটিতে পোকা পেয়েছেন গোবিন্দ বিশ্বাস। গাইঘাটার এই চাষি বছর তিনেক আগে রাসায়নিক কীটনাশক দেওয়া বন্ধ করেন। খরচে আর কুলোচ্ছিল না — তাঁর দশ কাঠা জমিতে কেবল কীটনাশকের খরচ পড়ছিল ১৪ হাজার টাকা। ফেরোমন ফাঁদে পোকা নিয়ন্ত্রণের খরচ সেখানে মাত্র সাতশো টাকা খরচ হর্মোনের জন্য। আর যে মেশিনগুলোতে লাগাতে হয় সেগুলো (গোবিন্দবাবু সোলার ল্যাম্প-সহ কাঠামো ব্যবহার করছিলেন) কিছু বেশি দামে কিনতে হলেও, বছর চার-পাঁচ ব্যবহার করা যায় স্বচ্ছন্দে। ২০১৯ থেকে পরপর তিন বছর বেগুন চাষ করছেন এই পদ্ধতিতে। গরম-বর্ষায় পোকার উৎপাত বেশি বলে, সে সময়টা তার সঙ্গে বাজার থেকে কিনে জৈব কীটনাশকও ব্যবহার করছেন।
আবার একটি ফসলের সঙ্গে অন্য ফসলের চাষও পোকার আক্রমণ কমাতে পারে। যেমন, টমেটোর সঙ্গে গাঁদা ফুলের চাষ করলে সবজিতে পোকার আক্রমণ কম হয়, ফুলের প্রতি যে হেতু পোকার আকর্ষণ বেশি। বেগুনে মথের আক্রমণ কমাতে পারে কাছাকাছি ভুট্টার চাষ। তাই টমেটোর খেতের চারপাশ ঘিরে গাঁদাফুল, বেগুনের সারির মাঝেমাঝে বেবি কর্নের সারি দেখা যায় বাংলার প্রশিক্ষিত, সতর্ক চাষির খেতে। জৈব ও প্রাকৃতিক উপায়ে যথাসম্ভব কীট নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে, রাসায়নিক কীটনাশক দিতে হবে ততটুকুই, যতটুকু না দিলে নয়।
কীটপতঙ্গের নিবিড় নিয়ন্ত্রণের ধারণায় কিন্তু পোকার বংশ নির্মূল করার কথা বলা হয় না। তা সম্ভবও নয়। পোকার সঙ্গে গাছের এক রকম জেনেটিক দাবা খেলা চলে। এ একটা চাল দিলে, ও দেয় পালটা চাল। তখন আবার নতুন চাল বের করতে হয়। তাই রাসায়নিক কীটনাশকের নতুন মলিকিউল বের করারও দরকার আছে। কিন্তু চাষিকে তা ব্যবহার করতে হলে তার বিধি অনুসারেই ব্যবহার করবেন, এটাই হল নিয়ম। অনেকটা ছড়িয়ে সব পোকা শেষ করে দেব, এই মনোভাব ভুল। সহাবস্থানে থেকেও, নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে কীটপতঙ্গকে। একশো শতাংশ জৈব চাষ ভারতের মতো জনবহুল দেশে কঠিন, তাতে সুলভ ও যথেষ্ট খাদ্যের চাহিদা মেটানো সহজ হবে না। রাসায়নিক কীটনাশকও প্রয়োজন, কিন্তু তা হতে হবে চাষি, ক্রেতা, পরিবেশ, সব পক্ষের জন্য নিরাপদ।
ভারতের কৃষি এখনও সেই আদর্শ থেকে দূরে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যে সব কীটনাশক তাদের বিষক্রিয়ার জন্য ‘ক্ষতিকর’ প্রতিপন্ন হওয়ায় নিষিদ্ধ হয়েছে, ভারতে তেমন বেশ কিছু কীটনাশক এখনও চলছে। সেগুলো ধাপে ধাপে বাতিল করার নীতি নিয়েছে সরকার। সেই অনুসারে কেন্দ্র ২০১৮ সালে ১৮টি, আর ২০২০ সালে ২৭টি বিপজ্জনক কীটনাশক নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু এখনও আরও প্রায় ৪৫টা এমন কীটনাশক রয়ে গিয়েছে যেগুলো আন্তর্জাতিক মান অনুসারে বাতিলের যোগ্য, তার মধ্যে অন্তত ১০টি ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ শ্রেণিতে পড়ে।
আর একটা সমস্যা, ভেজাল কীটনাশক। দামী ব্র্যান্ডের বোতল হুবহু নকল করে, ভিতরে দু’নম্বরি জিনিস ভরে দিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। “ভারতে ২৫ হাজার কোটি টাকার পেস্টিসাইড মার্কেট, তার ১৫-২০ পার্সেন্ট নকল,” বললেন জয়ন্ত চক্রবর্তী। তিনি কীটনাশক প্রস্তুতকারক একটি সংস্থার সঙ্গে দীর্ঘ দিন যুক্ত। আর একটি হিসেব বলে, ভারতে তিনটে কীটনাশকের একটা নকল। এবং ভেজাল কীটনাশকে অপরীক্ষিত, বিষাক্ত রাসায়নিক থাকার সম্ভাবনা বেশি।
জয়ন্তবাবু অবশ্য মনে করেন, আসল সমস্যাটা কীটনাশকের মান নিয়ে নয়। বিধি মেনে তার প্রয়োগ করেন না চাষি, এটাই বড় সমস্যা। কোন ফসলের কোন ধরনের সমস্যায়, কত পরিমাণে প্রয়োগ করতে হবে কীটনাশক, তেরোটি ভাষায় তা বিশদে লিখে ভরা থাকে প্রতিটি প্যাকেটে। কিন্তু প্রয়োগ করার সময়ে চাষি প্রায়ই সে সব নির্দেশ মানেন না। এক ফসলের পোকা কমাতে যে কীটনাশক কাজ করেছে, তা দিয়ে দেন অন্য ফসলেও। যত বার কীটনাশক দেওয়ার কথা, তার চাইতে বেশি, বেশ ঘনঘন স্প্রে করে দেন বাড়তি কাজের আশায়। দ্রবণে জলের পরিমাণ কম রেখে ওষুধ মেশান বেশি।
চাষিকে বোঝানোর কাজটা করবে কে? চাষিকে সার-কীটনাশকের ঠিক ব্যবহার, চাষের বৈজ্ঞানিক প্রকরণ সম্পর্কে বোঝানোর কথা সম্প্রসারণ কর্মীদের। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত জ্ঞানের, সরকারের গৃহীত নীতির প্রসার করবেন তাঁরা। সরকারি পদটির নাম হল ‘কৃষি প্রযুক্তি সহায়ক।’ কেপিএস পদের অধিকাংশই ফাঁকা। যাঁরা আছেন, তাঁরাও চাষের খেতে যাওয়ার চাইতে চেয়ার-টেবিলে কাজ করেন বেশি। তাঁদের এখন কৃষকবন্ধুর তালিকা তৈরি, মাটির স্বাস্থ্যের কার্ড বিলি, প্রাকৃতিক দুর্য়োগের ক্ষতিপূরণের চেক বিতরণেই সময় চলে যায়।
একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা (২০২০) দেখিয়েছে, ভারতে প্রতি বছর অন্তত সাড়ে ছ’হাজার চাষি ও খেতমজুর মারা যান কীটনাশকের বিষক্রিয়ার জন্য। কয়েক লক্ষ চাষি ভুগছেন কীটনাশকের দীর্ঘমেয়াদী কুফল থেকে, যার মধ্যে আছে স্নায়ুতন্ত্রের রোগও। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চাষিরা জানেন না, কীটনাশক থেকে তাঁদের রোগ হয়েছে। সরকার যদি চাষির কাছে তথ্য না পৌঁছয়, যদি ভেজাল কীটনাশক, মন্দ মানের কীটনাশক নিষিদ্ধ না করে, তা হলে চাষিকে বাঁচাবে কে? কে-ই বা বিষাক্ত নবান্ন থেকে বাঁচাবে দেশবাসীকে?

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.