বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১— [আমপান, ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের পর সুন্দরবনে চাষ ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধ ভেঙে নদীর জল ঢুকেছে, জলের নুন মাটিকে অনুর্বর করেছে। মাটির স্বাভাবিক উৎপাদনশক্তি ফিরে পেতে অন্তত বছর তিনেক লাগবে। পুকুর, ভেড়ি ভেসে যাওয়ায় ক্ষতি হয়েছে মাছ চাষেরও। তার উপর শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস জুড়ে বারবার অতিবৃষ্টি হয়েছে, তাতে দ্বিতীয়বার বোনা ধানের বীজতলা ফের ডুবেছে। গ্রামের চাষ থেকে সম্বৎসরের খাবার সংস্থানের আশা ছেড়ে সুন্দরবনের চাষিরা অন্যান্য রাজ্যে কাজের খোঁজে যাচ্ছেন। এঁদের একটি অংশ অন্য রাজ্যে ক্ষেতমজুর হিসেবে কাজ করতে যাচ্ছেন, বছরে দুই থেকে চার বার।
হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের যোগেশগঞ্জ দ্বীপে সাড়ে চারটে গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। এই এলাকা থেকে প্রতি বছর বেশ কিছু মানুষ গোদাবরী উপত্যকায় ক্ষেতমজুরের কাজ করতে যান। এই সাক্ষাৎকারটি এমন চার জন চাষির সঙ্গে কথা বলে তৈরি। তাঁদের নাম সুব্রত বর্মন, নিতাই মণ্ডল, বিকাশ ঘরামি এবং দিব্যেন্দু গায়েন। কারও গ্রাম পাটঘরা, কারও শ্রীধরকাটি। এঁরা ২০২১ সালের মার্চ মাসে অন্ধ্রপ্রদেশের নানা জেলায় কাজ করতে গিয়েছিলেন, অগাস্টে গ্রামে ফিরেছেন।]
আমার নাম সুব্রত বর্মন। আমি আজ ছ’বছর বাইরে কাজ করতে যাই, এখন আরও দশ-বারোজনকে নিয়ে যাই। আমাদের যোগেশগঞ্জে বছরে একবারই ধান হয়, বৃষ্টির জলে চাষ। মাটির নীচের জল নোনা, তাই সেচ পাম্প কাজ দেয় না। সবজি ভাল হয় না, কারণ এখানে এঁটেল মাটি, বেলে মাটি নয়। আগে আমরা ক্ষেতমজুরির কাজে যেতাম হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুরে। বছরে অন্তত দু’বার — আলু তুলে পাট বুনতে, আর পাট কেটে ধান বুনতে। কিন্তু এখন এখান থেকে লোকে যাচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশ আর কর্ণাটকে। কত লোক যাচ্ছে? তা ধরুন, যোগেশগঞ্জের চারটে পঞ্চায়েত মিলিয়ে হাজার দশেক লোক তো বটেই। এখন মেয়েরাও অনেক যাচ্ছে, ৩০-৪০ পার্সেন্ট মেয়ে তো হবেই।
না, মজুরির রেট ওখানে বেশি নয়, রেট এখানেই বেশি। এখানে বিঘে প্রতি ১৫০০-১৬০০ টাকা রেট। আর ওখানে বিঘেয় ৯০০-১০০০ টাকা। তবে সার দেওয়ার জন্যে ধানের মাঝে মাঝে ফাঁক বেশি রাখতে হয় বলে কাজটা একটু কম। কিন্তু আসল কথা হল, বাংলায় সম্পত্তি কম বলে দশ বিঘে জমিতে ক্ষেতমজুরের কাজ পেতে দশটা লোকের কাছে ছুটতে হয়। আর ওখানে এক প্লটে দেড়শো বিঘে। একবার গেলে দেড়-দু’মাসের কাজ বাঁধা, থোক টাকা মেলে ৩০-৩৫ হাজার। এ রাজ্যে খুব বেশি হলে দিন কুড়ি কাজ মেলে, টাকা মেলে দশ-পনেরো হাজার। তাই এখন হুগলি, মেদিনীপুর আর কেউ যাচ্ছে না। টাকা বেশি দিয়েও বাংলার চাষিরা আর মজুর পাচ্ছে না।
ওখানকার সিস্টেমটা এত দিনে আমরা খানিকটা বুঝে গিয়েছি। অন্ধ্রপ্রদেশের জমি লিজ়ে নেয় কর্ণাটকের ঠিকাদার, তাদেরকেই আমরা ‘মালিক’ বলি। তাদের চেনা এমন বাঙালি লোক থাকে, যারা কন্নড়, তেলুগু, বাংলা, সবই গড়গড় করে বলতে পারে। ওরাই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, জিজ্ঞেস করে কতজনকে নিয়ে আসতে পারবে একজন। এই ঠিকাদাররা মালিকের কাছ থেকে একর প্রতি ৩৮০০-৪০০০ টাকা নেয়, আমাদের একর প্রতি তিন হাজার টাকা দেয়, মানে ওই হাজার টাকা বিঘে (তিন বিঘেতে এক একর, এই হিসেবে)। গোদাবরীর জলে চাষ। ওখানে মেশিনের ব্যবহার কম, মানুষ লেবার দেয় বেশি। ওরা দেখেছে, মেশিনের চাইতে বাংলার চাষিরা রুইলে বেশি ধান পাওয়া যাচ্ছে। ওদের ধান হয় অনেক, কিন্তু আমাদের মুখে ওদের চাল বিস্বাদ লাগে।
ওদের ওখানে কাজও অনেক রকম — পোলট্রি, নারকোল, কলা বাগানে কাজ মেলে। ওখানে পাম অয়েল উৎপাদন হয়, এখানকার লোকে কল্পনা করতে পারবে না, একটা গাছে কত ফল হয়। আর একটা সুবিধে, ওখানে মালিক থাকার জায়গা ফ্রিতে দেয় তো বটেই — থাকার জায়গায় মানে বাঁশের মেরাপ বেঁধে উপরে ত্রিপল টাঙানো — সেই সঙ্গে রান্নার গ্যাস আর চালও ফ্রি দেয়। গ্যাসটা পাওয়ায় আমাদের খুব সুবিধে হয়, চালটা অবশ্য আতপ চাল দেয় বলে খেতে কষ্ট হয়, অনেক সময়ে বেশ দাম দিয়ে আমরা সেদ্ধ চাল কিনে খাই। এ বছর আমরা এখান থেকে বস্তা করে চাল নিয়ে গিয়েছিলাম। বাজারে মাছ ভালই মেলে। আর একটা জিনিস পাওয়া যায়, তা হল জমিতে প্রচুর কচ্ছপ। দু’আড়াই কিলোর কচ্ছপও পাওয়া যায়। ওরা কচ্ছপকে পুজো করে, মারতে বারণ করে, পাশের জমিতে ছেড়ে দিতে বলে। আমরা তাই করি, তবে কচ্ছপের মাংসও খাই, ওদের না জানিয়ে।
ওখানে জমিতে পাথর বেশি, খুব কাঁকর, বালি। কাজ করতে গিয়ে হাত ছড়ে যায়, তখন রাগ হয়, কেন এই কাজ করছি? লেখাপড়া করে চুক্তির কোনও ব্যাপারই নেই, পুরো ব্যবস্থাটাই চলে ভরসার উপর। লক্ষ লক্ষ টাকার মজুরি কেবল ঠিকাদারের উপরে ভরসা করে রেখে দিয়ে চলে আসে মজুররা। ওই টাকা ঠিকাদারের লোক পরে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেয়। যাওয়ার টিকিট ঠিকাদারই কেটে দেয়, আমাদের মজুরি থেকে পরে পয়সা কেটে নেয়। টিকিট কাটা হয়ে যাওয়ার পর, রওনা হওয়ার দিন আষ্টেক আগে থেকে আগাম কিছু টাকা চাইলে মেলে। হাজার দুয়েক টাকা, বা আর একটু বেশি। আমরা সে টাকাটা পরিবারের হাতে দিয়ে যাই, যাতে আমরা বাইরে থাকার সময়ে খরচ চলে যায়। যে মজুররা যাচ্ছে, সকলের আধার কার্ডের কপি রেখে দেয়, ঠিকানা ফোন নম্বর সব থাকে ওদের কাছে, কারও আগাম টাকা নিয়ে পালাবার উপায় নেই।
পাওনা নিয়ে বচসা হয় না, এমন নয়। আমরা হয়তো দেখতে পাচ্ছি মোবাইল অ্যাপে, জমির পরিমাণ পাঁচ বিঘে। কিন্তু ওরা বলবে, না, পাঁচ বিঘে নয়, সাড়ে চার বিঘে জমি রয়েছে। কাজ করতে হলে করো, না হলে অন্য কাজ দেখে নাও। তখন বাধ্য হয়েই ওরা যেমন বলে তেমন করতে হয়। আর একটা সমস্যা, মজুর সঙ্গে কিছু টাকা নিয়ে ফিরছে টের পেলে তার উপর চোটপাট করে টাকা কেড়ে নেয় লোকে। একবার ট্রেন থেকে এ ভাবে টাকা গিয়েছে কামরার সব শ্রমিকের। পুলিশও যেমন ইচ্ছে বাহানা করে টাকা নেয়। এখন কোভিড টিকার সার্টিফিকেট দেখতে চেয়ে পাঁচশো টাকা কেড়ে নিচ্ছে। এক সঙ্গে থোক টাকা মিলছে, এটা লোকে দেখছে, কিন্তু ওই টাকার উপর নির্ভর করেই যে আমাদের তার পরের কয়েকটা মাস চালাতে হয়, সেটা দেখছে না।
আমাদের এখানে চাষ করে সারা বছরের খাবার জোটানোও এখন অসম্ভব হয়ে গিয়েছে। আয়লার পর জমি থেকে নুন সরতে তিন বছর লেগেছিল। এ বার আমপান, ইয়াস হল পরপর, বাঁধ ভেঙে নোনা জল ঢুকে জমি ফের নোনা হয়ে গিয়েছে,কবে নুন সরবে আমরা জানি না। দ্বিতীয়বার বীজতলা করেছিলাম, অতিরিক্ত বৃষ্টি হওয়ার পর এত দিন ধরে জল দাঁড়িয়ে রইল যে সব পচে গেল। আমাদের এখানে নিকাশি ব্যবস্থা নেই, খালগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে, গেটগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমাদের পাশাপাশি গোসাবা, মোল্লাখালিতে বন্যা হলেও জল তিন দিনে বেরিয়ে যায়। এখানে পনেরো দিনেও জল যেতে চায় না। নিকাশি ঠিক কাজ করলে বন্যা হলেও আমাদের ফসল মার খেত না।
আমাদের সকলের ছোট ছোট জমি, আর জমি ঠিকা নিয়ে কাজ করতে চাইলে ঝুঁকি বেশি, পরিশ্রম বেশি, লাভ কম। তাই আমাদের বাইরে যেতেই হচ্ছে। বছর দশেক আগে বাগদার মীন ধরা লাভজনক ছিল, কারণ তখন বাংলাদেশে রফতানি হত। তখন হাজার মীন আড়াই হাজার টাকাও দর গিয়েছে। এখন হাজার মীনের দর দু’শো টাকা। তাও এখন আরও বেশি করে মহিলা-পুরুষ নামছে মীন ধরতে। বহু মেয়ে কলকাতায় কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরেছে, তারাও এখন মীন ধরছে। কাঠিতে নেট আটকে টেম্পু জাল বানিয়ে জলে নেমে মীন ধরছে মেয়েরা। অনেকে আবার ডিঙি করে নদীর মাঝখানে জাল ফেলেও ধরছে। ভোরবেলা এলে দেখবেন, ছোট ডিঙিতে কুড়ি পঁচিশদিনের জন্য বেরিয়ে পড়ছে স্ত্রী-পুরুষ, কাঁকড়া ধরে আনবে। ছইয়ের নীচে কাঁকড়া ভরে ফিরবে। সঙ্গে শুধু খাবার নয়, পঁচিশ দিন খাওয়ার মতো জলও নিতে হয়। বনের মধ্যে মিষ্টি জল কই? যে সব পুকুরে বাঘ, হরিণের জন্য জল ভরে রেখেছে ফরেস্টের লোক, সেখানেই শুধু মেলে। সেখান থেকে জল নিতে যেতে হয়। প্রাণ হাতে নিয়ে কাঁকড়া, মধু আনতে যায় লোকে। দেখছেন না, কতজন বাঘের পেটে যাচ্ছে?
আমাদের গ্রামে অনেকে পুকুর লিজ় নিয়ে মাছ চাষ করছিল, বন্যা আর অতিবৃষ্টিতে তাদের পুকুর ভেসে গিয়েছে। এ বছর সম্বৎসর ধান হবে না। চাল না হয় রেশনে খানিকটা মিলবে, খড় মিলবে কোথা থেকে? গরুতে খাবে কী? খড় তো এখানকার বাজারে কিনতেও পাওয়া যাবে না। এখন টাকার জন্য আরও বেশি করে লোক বাইরে যাচ্ছে কাজ করতে। আগে লেবুখালি থেকে দিনে চারটে বাসও ছেড়েছে, অন্ধ্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু যাওয়ার জন্য। এখন ছাড়ছে দিনে দুটো। গ্রামে আর লোক কোথায়, যে যাবে?