বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

শ্রমিক মেয়ের শক্তি

শ্রমিক মেয়ের শক্তি

স্বাতী ভট্টাচার্য

photo

বাইরের জগৎটা যখন গেট ঠেলে ঢুকে আসে বাড়ির ভিতরে, তখন সে এক ব্যাপার হয়। এ বাড়ির কথাই ধরুন। বাড়িতে নতুন কেয়ারটেকার নেওয়া হবে, এক মাঝবয়সী দম্পতি এসে কথা ফাইনাল করে গেলেন। বললেন, বাপ-মা গ্রামে, ছেলেমেয়ে যে যার সংসারে, তাঁরা ঝাড়া হাত-পা। পুরুষটি গেট পাহারা দেবেন, ফ্ল্যাটওয়ালাদের গাড়ি ধোবেন, মহিলা ঘর মোছা-বাসন মাজার কাজ কবেন বিবিধ ফ্ল্যাটে। এই হল এ পেশার চেনা ছক। কিন্তু কাজে যোগ দেওয়ার দিন দেখা গেল, স্বামী-স্ত্রীর পিছন থেকে উঁকি দিচ্ছে এক শীর্ণ, কৃষ্ণাঙ্গী তরুণী, তার হাত ধরে বছর তিনেকের এক শিশু, আর তাদেরও পিছনে এক বয়স্কা, যাঁর অবশিষ্ট ক’টি দাঁতে দোক্তার গাঢ় ছোপ। জানা গেল, তরুণীটির বয়স কুড়ি, শিশুটি তারই কন্যা সন্তান, স্বামী তাদের ‘ছেড়ে দিয়েছে।’ বৃদ্ধা হলেন চাকরিপ্রার্থীর মা, মাসান্তে টাকা নিতে এসেছেন। কেন, টাকা ব্যাঙ্কে পাঠানো যায় না? “সে ছোট ছেলে তুলে নিজেই নিয়ে নেবে, আমার হাতে কি দেবে? আমি আর ওর বাবা এসে দু’এক রাত থাকব, ছেলে-বউয়ের সেবা নিয়ে, টাকা নিয়ে চলে যাব।”
ব্যাপার দেখে-শুনে ফ্ল্যাটবাড়ির সেক্রেটারির চুল খাড়া হচ্ছে, চোখ ঠিকরে আসছে। গ্যারেজ-ফ্লোর কেটে তৈরি এক চিলতে ঘর আর আধ-হাত বাথরুমে পাঁচ-ছ’জন? তাঁকে দ্বিধা করতে দেখে মুখ খুললেন বছর পঁয়তাল্লিশের গেটকিপার-গৃহিনী। “বাবা-মাকে কি ফেলে দেব, কী বল তুমি দাদা? আর আমরা না রাখলে মেয়েটা দাঁড়াবে কোথায়?” স্বামী ইঙ্গিতে তাকে চুপ করতে বলছেন, কিন্তু কে কাকে থামায়। “বাচ্চা নিয়ে কোথায় ভেসে যাবে মেয়েটা, তুমিই বলো? আমরা যেখানে থাকব, সেখানেই থাকবে তো!” ক্ষয়া, পাকিয়ে-যাওয়া চেহারা মহিলার, কিন্তু গলাটি বেশ জোরালো। নিজে একটু পা টেনে হাঁটেন, কিন্তু যেমন করে হোক দাঁড় করাবেন আরও তিনটি মেয়েকে — বৃদ্ধা শাশুড়ি, তরুণী কন্যা, বালিকা নাতনি। তার নিজের বাপ-মাকে তার ভাইয়েরা দেখে কিনা, কে জানে? না হলে তাঁরাও মেয়ে-জামাইয়ের সেবা-আত্তি নিতে আসবেন হয়তো। তক্তপোশ-মেঝে মিলিয়ে আরও দু’জনের শোওয়ার জায়গা হয়ে যাবে।
কী সামান্য ক্ষমতা, অথচ কী অসীম শক্তি এ সব মেয়ের! নিজে বাঁচার সংস্থানের খোঁজ করছে, কিন্তু সবাইকে বাঁচিয়ে রাখার ভার নিয়েছে। এই মুখরা, রাগী মেয়েটির কথা পঁয়ত্রিশ বছর আগে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শব্দগুলোকে যেন ফের জীবন্ত করে তুলল। ‘শ্রমশক্তি’-র ভূমিকায় এলা ভট্ট লিখেছিলেন, “দেশের সর্বত্র আমরা দেখেছি, মেয়েরা আমাদের ভবিষ্যতের প্রতি সব চাইতে দায়বদ্ধ। পরে কী হবে, সে চিন্তা তাদের সবার মধ্যে অত্যন্ত প্রবল। এই মেয়েদের হাতেই দেশের ভবিষ্যৎ।” গত বছর ৮৯ বছর বয়সে চলে গিয়েছেন এলা ভট্ট, রয়ে গিয়েছে তাঁর অবিস্মরণীয় নানা কাজের একটি, ‘শ্রমশক্তি’। ১৯৮৭ সালে রাজীব গান্ধী সরকার ‘জাতীয় স্বনিযুক্ত মহিলা কমিশন’ তৈরি করে এলাকে তার চেয়ারপার্সন নিয়োগ করে। স্থির হয়, দেশের স্বনিযুক্ত মেয়েদের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা হবে। সাত মাস ধরে সতেরোটি রাজ্যে ঘুরে এলা ও অন্যান্য সদস্যেরা কথা বলেছিলেন কয়েক হাজার শ্রমজীবী মেয়ে, ট্রেড ইউনিয়ন আর সমাজকর্মীদের সঙ্গে। সাড়ে চারশো পাতার রিপোর্ট বার করেছিলেন মাত্র এক বছরের মধ্যে, ১৯৮৮ সালের জুন মাসে।
আরও বড় কথা, সেই প্রথম মেয়ে শ্রমিকদের কাজ, জীবনযাপন, রাষ্ট্র আর বাজারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের এক নিবিড় চিত্র এল সকলের সামনে। ‘স্বনিযুক্ত মেয়ে’ বলতে এ দেশের গরিব, শ্রমজীবী মেয়ে, যাদের কাজের সময় দীর্ঘ এবং রোজগার অনিশ্চিত। এই মেয়েরা এক একজন ব্যক্তি তো নয়, এক একটি প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র, বাজার, মন্দির-মসজিদ-গুরুদ্বার থেকে ইস্কুল-ইউনিভার্সিটি, ক্রেশ-বৃদ্ধাশ্রম, ভারতে দরিদ্র মানুষের অভাবের সংসারটিতে সে এই সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিভূ হল একজন — মা। তা বলে ঘরে-বাইরে তার খাতির নেই একটুও, বাড়িতে সে বরের হাতে মার খায়, বাজারে মহাজন অতি সামান্য দামে তাকে জিনিস বেচতে বাধ্য করে, ঠিকাদার বাধ্য করে অতি অল্প দামে শ্রম বিক্রি করতে। তার নিজের দেশের সরকার মেয়েদের জন্য জরুরি পরিষেবা জোগানোর কাজকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দেয় না। এমনকি যাদের জন্য সে খেটে মরে, সেই সমাজ-সংসারও মেয়েদের ‘কর্মী’ বলে স্বীকৃতিটুকুও দেয় না।
এলা ভট্ট সে দিকে নজর টেনেছিলেন। রিপোর্টের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “সাধারণ ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলতে হয়, প্রতিটা মেয়েই এক এক জন কর্মী। তার কাজ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। সে কেবল সন্তানের জন্মই দেয় না, তাকে মানুষ করে, ট্রেনিং দেয়, দক্ষতা তৈরি করে, যাতে সে দেশের ভবিষ্যৎ কর্মীবাহিনীর সদস্য হতে পারে। সে পরিবার প্রতিপালন করে এবং পরিবারকে নানা পরিষেবা দেয়। বাজার থেকে যে সব অসম্পূর্ণ অথবা অর্ধসম্পূর্ণ সামগ্রী বাড়িতে আসে, সেগুলোকে পরিশোধন করে, তাতে মূল্য যোগ করে সে তা ব্যবহারযোগ্য করে তোলে। এবং এই সব কিছুর মধ্যে সে পণ্য বা পরিষেবার উৎপাদনে হাত লাগিয়ে পরিবারের রোজগারে সাহায্য করে। বেশির ভাগ গৃহ-অর্থনীতিতে মহিলাদের শ্রমই পরিবারকে বাঁচিয়ে রেখেছে, এবং তাদের শ্রমার্জিত অর্থ অবধারিত ভাবে পুরোটাই যায় সেই উদ্দেশে, যেখানে পুরুষরা তাদের রোজগারের কিছু অংশ, কিংবা সম্পূর্ণটাই, রেখে দেয় নিজের খরচের জন্য, যার মধ্যে রয়েছে বিড়ি, সিগারেট, মদও।”
কমিশন দেখিয়েছিল, এই অসাম্য আরও তীব্র অন্যায়ের রূপ ধারণ করে মেয়েদের মজুরির হার কম করে রাখা হয় বলে। নানা রাজ্যে জনশুনানি করে যত মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন কমিশনের সদস্যরা, তাঁদের মধ্যে ষাট শতাংশই ছিল পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য। “অথচ তারা রোজগার করছিল পুরুষের অর্ধেক। পূর্ব গোদাবরীতে একটি মেয়ে দিনে বারো ঘণ্টা কাজ করে রোজগার করে কুড়ি পয়সা,” বলছে রিপোর্ট। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথার উল্লেখ মেলে — “কমিশনের নিজস্ব মূল্যায়ন হল, মহিলা-প্রধান গেরস্তালির সংখ্যা সাম্প্রতিক কালে বেড়ে গিয়েছে, যদিও সরকারি তথ্যে তা নথিবদ্ধ হচ্ছে না।” পঁয়ত্রিশ বছর আগে কমিশন যখন এই রিপোর্ট লিখছে, তখন গ্রামীণ ভারতে মেয়েদের কর্মনিযুক্তির হার তেইশ শতাংশ, শহরে আট শতাংশ।
সাড়ে তিন দশক ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে ফের বেরিয়ে আসছে সেই একই ছবি। মেয়েদের গড় দৈনিক মজুরি ছেলেদের চেয়ে এখনও কম — রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক প্রকাশিত তথ্য (২০১৯-২০) অনুসারে, সারা ভারতে পুরুষ শ্রমিকদের দৈনিক গড় আয় ৩৪৮ টাকা, মেয়েদের ২৭৮ টাকা। মেয়েদের কর্মনিযুক্তির হার বরং আগের চাইতেও কমে এখন কুড়ি শতাংশের নিচে নেমেছে। আর মহিলা-প্রধান গেরস্তালির প্রকৃত বিস্তার আধার কার্ড গুণে হওয়ার নয়। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে গ্রাম কে গ্রাম প্রায় শূন্য করে পুরুষরা যাচ্ছে দীর্ঘ সময় বাইরে কাজ করতে, তাদের অনুপস্থিতিতে রোজগার থেকে গৃহকাজ, সবই ঘাড় পেতে নিচ্ছে মেয়েরা। কলকাতার মতো শহরে যে বিপুল মহিলা কর্মীবাহিনী সস্তার শ্রম দিয়ে চালু রাখে অগণিত গেরস্তালি, দোকান-বাজার, কল-কারখানা, তাদের এক বৃহৎ অংশ — হয়তো অধিকাংশ — একক মা। পরিত্যক্ত, বহিষ্কৃত, উপেক্ষিত মেয়েরা সে দিনও একার জোরে সন্তান মানুষ করেছে, আজও করছে। তাদের কাজের অবমূল্যায়ন আজও অব্যাহত। কেবল তা নিয়ে আর তেমন কথা হয় না। ‘অমন তো হয়েই থাকে’ — এই হল আজ সরকার আর বাজারের মনোভাব।
এলা ভট্ট রিপোর্টের ভূমিকা শুরু করেছিলেন ভনিতাহীন ভাবে, মেয়েদের শ্রম আর আয়ের হিসাবটা তুলে দিয়ে। মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে তাঁরা পেয়েছিলেন আদিবাসী মেয়েদের, যারা বন থেকে ওষধিগুণসম্পন্ন গাছ-গাছড়া তুলে আনে। যদিও সে সব চিনতে, এবং কোনটা কখন তোলা উচিত তা বুঝতে, যথেষ্ট জ্ঞান-অভিজ্ঞতা দরকার হয়, তবু সারা দিনে তোলা ওষধি মেয়েরা মাত্র তিন টাকায় এক ব্যবসায়ীকে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছিল। রাজস্থানের উদয়পুরে তাঁরা পেয়েছিলেন একটি মেয়েকে, যার এক কিলোগ্রাম মধু সংগ্রহ করতে দু’দিন লাগত, যা সে বিক্রি করত দেড় টাকা থেকে দু’টাকায়। স্থানীয় বাজারে তখন এক কেজি মধুর দাম ছিল ষাট টাকা। কমিশন দেখেছিল, রাজস্থানের জঙ্গল-নির্ভর মেয়েরা আসলে খরাত্রাণে বিতরণ-করা শস্যের উপর নির্ভর করে বাঁচে। মেয়েরা দল বেঁধে এসে কমিশনের সদস্যদের হাত ধরে বলেছিলেন, “বহেনজি, আমাদের জন্য খরা পাঠিয়ে দিও।”
পশ্চিমবঙ্গেও এসেছিল কমিশন। বাঁকুড়ায় লতিকা পাল নামে এক মহিলার সঙ্গে কথা হয়েছিল এলা ভট্টের। সে জঙ্গল থেকে জ্বালানি কাঠ, দাঁতন, ফল কুড়িয়ে নিয়ে আসত, যদি না বনরক্ষীরা কেড়ে নেয়। “দেখে মনে হয়, এক সময়ে চকচকে তাজা বেগুনের মতো সুন্দর চেহারা ছিল তার। এখন সে কালো, শুকনো, নির্জীব।” কী সে চায়, কী হলে ভাল হয়, প্রশ্ন করতে লতিকা কেবল বিড়বিড় করেছিল, “আমার দুটো মেয়ে, দুটো মেয়ে।” মেয়ের বিয়ে ছাড়া তার কোনও চিন্তাই নেই। ভারী কৌতূহল হয়, সেই মেয়েরা — যাদের বয়স এখন চল্লিশের শেষ দিকে — কেমন আছে? তারা কি মায়ের চাইতে ভাল জীবন পেয়েছিল, একটু হলেও?
প্রাণীপালন, দুধ উৎপাদন, তসর উৎপাদন, খনি, তামাক ও বিড়ি শিল্প (যেখানে মেয়েরা ন্যূনতম মজুরির অর্ধেক পাচ্ছিল), তাঁত বোনা ও সুতো কাটা, লেস বোনা, পাঁপড় বেলা, বা কাঠের কাজের মতো হস্তশিল্প (রাজস্থানে টাই-অ্যান্ড-ডাইয়ে রোজগার ছিল মাথা-পিছু ১৬ টাকা), সব্জি বিক্রি ও হকারি (পুলিশের হয়রানি), নির্মাণ কাজ (সরকারি নির্মাণেও মেয়েদের কম মজুরি) — বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েদের কী পরিস্থিতি, সে সব একই সঙ্গে তথ্য এবং গল্প। মেয়েদের ঠকানো যে এত সহজ, এত ঝুঁকিহীন, সে দিকে চোখ খুলে দিল এই রিপোর্ট। এলা ভট্ট লিখছেন, শ্রম দফতরে তাঁদের শুনতে হতো, “আমাদের কাছে কোনও অভিযোগ আসেনি ম্যাডাম।” তিনি লিখেছেন, দফতর কি অভিযোগের জন্য বসে থাকবে, আর মেয়েরা কাজ খোয়ানোর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এসে অভিযোগ করবে? এ প্রশ্ন আজও করা যায়, কেউ করে না।
রিপোর্টের পঞ্চম অধ্যায়ে (শিরোনাম, ‘আইনি সুরক্ষা’) লেখা হয়েছিল বড় মূল্যবান কয়েকটি কথা — “আজ বিশ্ব অর্থনীতি দাঁড়িয়ে রয়েছে মজুরিহীন শ্রমের উপরে, বাহুবলে অপহৃত ও নিষ্ঠুর ভাবে ব্যবহৃত মানব সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে। এর এক প্রধান অংশ মেয়েদের শ্রম। এই বাস্তব সত্য চোখে পরে ফসলের খেতে, মাছের বাজারে, মিষ্টির দোকানে, কারখানায় এবং তৃতীয় বিশ্বের ‘এক্সপোর্ট প্রোমোশন জ়োন’গুলিতে। ... যত বেশি অর্থনীতি বিশ্বায়িত বাজারে অংশ নিচ্ছে, তত ঝোঁক বাড়ছে লাভ বাড়াতে খরচ কমানোর। ফলে কোপ পড়ছে সবচেয়ে সহজে শোষণযোগ্য সম্পদের উপর, মেয়েরা বাধ্য হচ্ছে নিম্নতম হারে উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে।”
এ কথা যখন লেখা হচ্ছে, তার তিন বছর পরে মুক্ত বাজারে প্রবেশ করবে ভারতের অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তনের ডঙ্কা বাজবে আরও। এই রিপোর্ট প্রকাশের আগে নীতি ও পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল ‘নারী কল্যাণ’ বা ‘নারী উন্নয়ন।’ অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৯২-৯৭) থেকে তা হয় ‘নারী ক্ষমতায়ন।’ জাতীয় মহিলা কমিশন তৈরি হয় (১৯৯২), মেয়েদের ঋণ দেওয়ার উদ্দেশে ‘রাষ্ট্রীয় মহিলা কোষ’ চালু হয় (১৯৯৩), ক্রেশ তৈরির তহবিল (১৯৯৪) গঠিত হয়। নবম পরিকল্পনায় গিয়ে সমাজ ক্ষেত্রের মন্ত্রকগুলির বরাদ্দের ৩০ শতাংশ মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট করার কথা বলা হয়। মেয়েরা যেন উন্নয়নের শরিক বলে স্বীকৃতি পায়, সে দিকে জোর দেয় কেন্দ্র।
সে সব উদ্যোগের ফলে কী পাওয়া গিয়েছে, কী যায়নি, আর কী পেয়েও হারিয়েছি আমরা, তার হিসাব না হয় থাক। মেয়েদের ক্ষমতায়ন (এমপাওয়ারমেন্ট) এখন অতি পরিচিত শব্দবন্ধ। মেয়েদের আইনি সহায়তার নানা ব্যবস্থা হয়েছে, সহজে ঋণ পাওয়ার, বা নিঃশর্তে আর্থিক অনুদান পাওয়ার নানা প্রকল্প চালু হয়েছে। কিন্তু পিতৃতন্ত্রে মেয়েদের অবমূল্যায়নের যা প্রধান লক্ষণ — মেয়েদের শ্রমের অবমূল্যায়ন, তার তেমন কোনও হেরফের হয়নি। দরিদ্র, শ্রমজীবী মেয়ের আয় আজও যৎসামান্য, তার কাজ নিরাপত্তাহীন। সরকার আজও মহাজন-ঠিকাদারের স্যাঙাৎ, মেয়েদের কেউ নয়। আর সে দিনের মতো আজও, নিজের নগণ্য আয়ের ভরসাতেই মেয়েরা সমাজ-সংসারের বৃহত্তম দায়গুলি স্বেচ্ছায় বহন করে চলেছে। নিজেদের ঘামে-অশ্রুতে লিখছে জাতির ভবিষ্যৎ। শুধু ‘শ্রমশক্তি’-র মতো এমন রিপোর্ট আর লেখা হয় না। আমরা ভুলতে বসেছি, নারীবাদ যখন ওই তীক্ষ্ণভাষী গৃহপরিচারিকার মতো মেয়েদের মুখ থেকে নিজের কথাকে আহরণ করে, তখনই সে হয়ে ওঠে এক স্পন্দমান আন্দোলন। আর ‘উইমেন্স স্টাডিজ়’-এর বাগাড়ম্বরের মধ্যে যদি অজান্তে, নিঃসাড়ে সরে যায় সেই মেয়েরা, তখন নারীদিবস পালন হয়ে ওঠে কেবল ফ্রায়েড রাইস-ফিশ ফ্রাই খাওয়ার অজুহাত। চকমকির ফুলকিহীন, নিষ্প্রাণ পাথরের কিছু কথা বলবার, আর বইবার কর্মসূচি।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.