বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
১ নভেম্বর, ২০২২, শ্রমজীবী ভাষা— সকাল সকাল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রাজ্য জুড়ে কতই না বঞ্চনার চুলচেরা আলোচনা করা হয়ে থাকে, অথচ হাতের কাপে থাকা চা উৎপাদক শ্রমজীবীদের বঞ্চনার ইতিহাস আমাদের কাছে অজানাই থেকে যায়। বাংলায় সরকার বদলায়, শ্রমজীবীদের পরিস্থিতি নয়। বাংলার রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এই শ্রমজীবীদের বঞ্চনার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন ঘটায় মাত্র। বাগিচা শিল্পের ক্ষেত্রেও এর কোনও ব্যতিক্রম ঘটে নি।
প্লান্টেশন বা বাগিচা বলতে মূলত বাগিচা মালিকদের প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীন বড় বড় খামারে চালানো কৃষিকাজকে বোঝায়। কিন্তু বাংলায় প্লান্টেশন বা বাগিচা বলতে শোষণের কতগুলি বাহ্যিক রূপ বোঝাত যা ছোট ছোট চাষিদের শ্বাসরোধ করে ফুলেফেঁপে উঠেছিল। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পুঁজির আনুকূল্যে ভারতে কৃষিনির্ভর কিছু শিল্পের বিকাশ ঘটে। এক্ষেত্রে জুট, কফি, রবার, নীলের পাশাপাশি চা বাগিচা শিল্প বিশেষ সমৃদ্ধি লাভ করে। ১৮৩৯ সালে আসামে কোম্পানি স্থাপনের মাধ্যমে ভারতে চা শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। যদিও মেজর রবার্ট ব্রুকস এর ১৬ বছর আগে ১৮২৩ সালে আসামের ঘন জঙ্গলে চা গাছের সন্ধান পান। ১৮৩৯ সালের পরবর্তী তিন দশকে আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ইউরোপীয় মালিকদের অধীনে চা বাগানের ব্যাপক প্রসার ঘটে। আসামের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি জমির দখল পর্ব শেষ হলে এবং সেখানে পতিত জমির অভাব ক্রমশ ঘনীভূত হলে ইউরোপীয় পুঁজির নজর পড়ে বাংলার উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ পাহাড়ী ভূমিতে। দার্জিলিঙের জলবায়ু ও ভূপ্রকৃতি চা উৎপাদনের অনুকূল হওয়ায় ১৮৪১ সালে ডা. ক্যাম্বেল উত্তরবঙ্গে চা চাষ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষা ব্যাপক ভাবে সফল হয় এবং পরবর্তী দু’দশকের মধ্যে দার্জিলিং এর পার্বত্য অঞ্চলে চা শিল্প বাণিজ্যিক রূপ ধারণ করে এবং বিশ্বের সম্ভ্রম আদায় করে ফেলে। ১৮৬০ এর দশকের মধ্যে দার্জিলিং এর পার্বত্য অঞ্চলে নতুন চা চাষের জমির অভাব দেখা দিলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পুঁজিপতিরা ক্রমশ পাদদেশীয় তরাই অঞ্চলে নেমে আসে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাগিচার সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দার্জিলিং অঞ্চলে ১৯৫০ এর দশকে চা শিল্প প্রসারে উদ্যোগ নেওয়া হলেও ১৮৭২ সালে ১৪০০০ একর জমিতে ৭৪টি চা বাগান গড়ে ওঠে, ১৮৮১ তে এই সংখ্যা ১৫৩তে পৌঁছায় যা প্রায় ৩০,০০০ একর জমি জুড়ে প্রসারিত ছিল, ১৮৯১ সালে প্রায় ৪৫,০০০ একর জমি জুড়ে ১৭৭টি চা বাগান গড়ে ওঠে।
চা বাগানের দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কিছু নতুন সমস্যা দেখা দিতে আরম্ভ করল। পার্বত্য অঞ্চলে চা বাগিচার সঙ্গে তরাই অঞ্চলের চা বাগিচার পরিবেশগত ব্যাপক পার্থক্য ছিল। ব্যাপক আকারে বন ধ্বংস তরাই অঞ্চলের পরিবেশকে আরও জটিল করে দেয়। ফলে দেখা যায় ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, ব্ল্যাকওয়াটার ফিবার এর মত ভয়ঙ্কর রোগের পাদুর্ভাব। পার্বত্য অঞ্চলে নেপালি শ্রমিকের অভাব না হলেও, তারা তরাই অঞ্চলে নেমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চা চাষে সম্মত হল না। এমতাবস্থায় ব্রিটিশরা শ্রমিক চাহিদা মেটানোর জন্য আড়কাঠির সাহায্য নিল। ব্যাপক সংখ্যা ধরে আনা হল ছোটনাগপুরের শ্রমিকদের। দেখতে দেখতে তরাই অঞ্চলের রূপ পাল্টে গেল। ওঁরাও, মুন্ডা, সাঁওতাল, ঘাসি, তুরি, বরাইক, মালপাহারি প্রমুখ আদিবাসীরা চা বাগানে কাজ নিল। বহু শ্রমিক ঘাতক রোগে মৃত্যুবরণ করেছিল। ইংরেজ বাগান মালিকদের সারা বছর শ্রমিক অপ্রতুলতা নিয়ে একটা উদ্বেগ থেকেই যেত। আড়কাঠিরা এক্ষেত্রে মালিকদের সহায়ক ছিল। নানা প্রলোভন দেখিয়ে সর্দাররা হাজার হাজার শ্রমিক নিয়ে এসেছে চা বাগানে। পরিবর্তে পেয়েছে শ্রমিকের মাথা পিছু এক আনা, উপরন্তু শ্রমিকদের কাছ থেকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামে নজরানা, ঘুষ ইত্যাদি। এর বাইরেও ছলে বলে কৌশলে তাদের কষ্টার্জিত যৎকিঞ্চিত আয়ের মধ্যে ভাগ বসাত এই আড়কাঠিরা। সরকারি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় ১৮৬৯ সালে দার্জিলিঙের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২২,০০০। ১৮৭২ সালে প্রথম জনগণনা সময়পর্বে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৪,৭১২ এবং শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে অর্থাৎ ১৯০১ এ তা বৃদ্ধি পায় ২,৪৯,১১৭ জন।

অন্যদিকে, শ্রমিকদের একটা বড় অংশ চাবলয়ের বাইরে ভিন্ন রাজ্যে থেকে হওয়ায় তাদের নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অল্প মজুরি, বসবাসের জন্য অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, খাদ্যভাব জনিত অপুষ্টি, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বাগানে কাজের জন্য পুরুষ শ্রমিকের মাথা পিছু ৪ আনা, মহিলা শ্রমিকের জন্য ৩ আনা এবং যুবক-যুবতীর জন্য ১ আনা ধার্য ছিল, এবং শিশুরা চা বাগানের জন্য ক্ষতিকারক পোকামাকড় মেরে আনলে তাদের মিলত এক আনা। মজুরি ক্ষেত্রে এই বৈষম্য পরবর্তী ৫০-৬০ বছর অপরিবর্তনীয় ছিল যা চা বাগানের তীব্র শোষণের রূপকেই তুলে ধরে। সারা বছর চা পাতা তোলার কাজ থাকত না। পাতা তোলার মরশুমে শ্রমিকরা যত ওজনের পাতা তুলত তা সঠিক ভাবে ওজন না করে কম পয়সা দেওয়া হতো। এর পাশাপাশি চলত নানা অজুহাতে শ্রমিকের মজুরি কাটার মালিক নির্মিত আইন। জ্বর রোগভোগের সময় শ্রমিকদের ওপর অকথ্য শারীরিক অত্যাচার করে কাজে নিয়ে আসা হতো। কোনও কোনও বাগানে নগদ মজুরি দেওয়ার পরিবর্তে চাকতি দেওয়া হতো। এই চাকতির পরিবর্তে শ্রমিকরা দোকান থেকে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে পারতো। অসাধু দোকানদাররাও নিরক্ষর সরল শ্রমজীবী মানুষদের ঠকিয়ে প্রচুর মুনাফা করতো। শ্রমিকদের মালিক, সর্দার, দোকানদারদের এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অধিকার ছিল না, প্রতিবাদ করলেই কপালে জুটত পরিবারসমেত হপ্তাবাহারের মত জঘন্য শাস্তি, যেখানে প্রতিবাদী শ্রমিককে সপরিবারে বাড়ি থেকে বের করে ঘন জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হতো, আসামে এই প্রথা হটাবাহার নামে পরিচিত ছিল। পুরুষ, নারী, শিশু নির্বিশেষে চা বাগানের শ্রমিকদের ওপর অকথ্য অত্যাচারের মর্মস্পর্শী চিত্র দি বেঙ্গলী নামক ইংরেজি পত্রিকায় Slavery in British Dominion নামক ১৩টি প্রবন্ধে তুলে ধরা হয়েছিল। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির মত ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যরা সরেজমিনে চা কুলিদের দুঃখ দুর্দশা তদন্ত করেছিলেন। ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা জুড়ে কিন্তু তার কোনও ইতিবাচক প্রভাব চা শ্রমিকদের ওপর পড়ে নি।
ব্রিটিশ সরকার চা শিল্পে শুধু মাত্র মালিকদের জমি প্রদান করে ক্ষান্ত হতো না, বাগান মালিকদের মুনাফা নিশ্চিত করতে তারা মালিকের পক্ষে কয়েকটি কালা কানুনও তৈরি করেছিল যেমন শ্রমিকদের বাগান কাজ করার জন্য তিন থেকে পাঁচ বছরের চুক্তিবদ্ধ হতে হতো। এর মাঝে কাজ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে শ্রমিকদের এক থেকে তিন মাস সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হতো। শাস্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আবার ফিরে আসতে হতো চা বাগানে। আবার কোনও শ্রমিক কাজ করতে অস্বীকার করলে বা সাত দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে মালিক বিনা ওয়ারেন্টে তাকে গ্রেফতার করতে পারতো। আসামের চা বাগানে এই আইনগুলো যতটা কঠোরভাবে পালন করা হতো, উত্তরবঙ্গে এই আইনগুলির প্রয়োগ ততটা না হলেও, শ্রমজীবীদের গতিবিধির ওপর সরকার তীব্র নজর রাখত, শ্রমজীবীদের মাঝে সরকারি গুপ্তচরের উপস্থিতির কথাও জানা যায়। ১৯১২ সালে জলপাইগুড়ি শ্রমিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ডুয়ার্সের শ্রমিক সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের আইনগত পদ্ধতি যুক্ত হয়। যদিও এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল সীমিত। এই আইনে জলপাইগুড়িসহ অন্যান্য শ্রমিকের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিসংখ্যান সংগ্রহের কথা বলা হয়েছিল। এছাড়া বাগিচা শ্রমিকদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রাক স্বাধীনতা পর্বে তেমন কোনও সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ে না, এমনকি স্বাধীনতার প্রাক মুহূর্তে চা বাগিচাগুলি ইউরোপীয় পুঁজিপতির কাছ থেকে এদেশীয় মালিকদের মধ্যে হাতবদল হলেও, শ্রমিকদের সামগ্রিক চিত্রে কোনও পরিবর্তন ঘটে নি।
১৯৪৭ সালে ভারত এই দীর্ঘ পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু উত্তরবঙ্গের চা বাগিচার শ্রমিকদের পায়ের শিকল অচ্ছিন্নই থেকে যায়। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৩০ বছর বাংলায় কংগ্রেসী আমল বাংলার চা বাগিচার শ্রমজীবীদের বঞ্চনার ইতিহাসে একটি অধ্যায়ের সংযোজন ঘটিয়েছে মাত্র। ১৯৪৮ সালে ভারত সরকার ন্যূনতম মজুরি আইন প্রবর্তন করে, চা বাগিচার পুরুষ শ্রমিকদের মাসিক মজুরি স্থির হয় ৬ টাকা এবং নারী শ্রমিকের জন্য ৪ থেকে ৫ টাকা মাসিক। ১৯৭৬ এর পূর্ব পর্যন্ত মজুরি ক্ষেত্রে এই বৈষম্য বজায় ছিল। ১৯৫১ সালে বাগিচা শ্রমিক আইন প্রণীত হয় যেখানে শ্রমিকদের কাজের সময় প্রতি সপ্তাহে ৫৪ ঘণ্টা স্থির হয়। হাটবাজারের দিন ছুটি দেওয়ার কথা বলা হয়। যে কোনও দিন কাজ, বিশ্রামের সময় এবং কাজে যোগদানের আগে অপেক্ষার সময় মিলিয়ে সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা হতে হবে। মালিকরা শ্রমিকদের চিকিৎসা, বাসস্থান ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে দায়বদ্ধ থাকবে এবং যে সমস্ত বাগানে ৫০ এর বেশি মহিলা শ্রমিক কাজ করেন সেখানে ৬ বছরের নীচে শিশুদের জন্য ক্রেশ ব্যবস্থা করতে হবে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত বাগানে নারীদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীন ভারতে চা শিল্পের শ্রমিক দরদি এই আইনগুলির বেশিরভাগই খাতায় কলমে থেকেছে, মজুরি ক্ষেত্রে প্রাক স্বাধীনতা পর্বের থেকে তেমন কোনও পরিবর্তন নজর পড়ে না। এমনকি মজুরি ক্ষেত্রে বৈষম্য স্বাধীনতা উত্তর পর্বেও বজায় ছিল। শ্রমিকদের স্বাধীনতা স্বীকৃত হলেও, মালিক, সর্দারদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল। স্বাধীনতা উত্তর কালে পরিবর্তন বলতে শুধুমাত্র, ভারতে ভোট রাজনীতির প্রেক্ষাপটে চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যেও ভিন্ন রাজনৈতিক দলে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা চা শিল্পে নিযুক্ত শ্রমজীবীদের ভারত তথা বাংলার রাজনীতির মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করেছিল।
১৯৪৭ সালের পূর্বেই বাগানে বামপন্থী আরএসপি দলের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৪৭ সালে ১৫৪টি চা বাগানের মধ্যে ১১৪টিতে আরএসপি ও ১০টিতে কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত ইউনিয়নের প্রভাব ছিল বাকি ৩০টিতে সিপিআই নিয়ন্ত্রিত ইউনিয়নের প্রভাব ছিল। ১৯৫৪ সালে হাসিমারা সম্মেলনে প্রথম চা-শ্রমিকদের বোনাস ও পিএফ-এর দাবি তোলা হয়। এই সময় বোনাসের দাবিতে ডুয়ার্সে ১৮ দিনের শ্রমিক হরতাল হয়। নেতৃত্ব দেন ননী ভট্টাচার্য, সুরেশ তালুকদার, স্টিফেন কুজুর প্রমুখ নেতারা। হরতালের পনের দিন পর কয়েকটি শর্তে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। আন্দোলনের সুবাদে বোনাস কমিটি গঠিত হয় এবং প্রত্যেক শ্রমিক ১৩০ টাকা করে বোনাস পায়। পাশাপাশি এই আন্দোলন চা বাগান ট্রেড ইউনিয়নগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। এরই ফলস্বরূপ ১৯৬০এর দশকের গোড়া থেকেই একটা সাধারণ মঞ্চ বা ফোরাম তৈরির চেষ্টা হয়, যেখানে চা-বাগান শ্রমিকদের সাধারণ দাবিদাওয়া নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগঠিত হবে। ১৯৬২ সালে কো-অর্ডিনেশন কমিটি অফ টি প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কস নামক মঞ্চ গঠিত হয়। আইএনটিইউসি, এইচএমএস, এআইটিইউসি, ইউটিইউসি, এবং গোর্খা লীগ এই মঞ্চের সদস্য হয়। এই কমিটির অধীনেই ১৮ আগস্ট ১৯৬৯ সালে ডুয়ার্সের চা বাগানগুলিতে ধর্মঘট সংগঠিত হয় যা ষোল দিন ধরে চলে। একটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। আন্দোলনের মূলত অর্থনৈতিক দাবিই যেমন মজুরি, বোনাস, কাজের নির্দিষ্ট সময় ইত্যাদি প্রাধান্য পায়।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা মানুষের মনে মধ্যে পরাধীনতার গ্লানি মিটিয়ে মুক্তির যে আলো সঞ্চার করেছিল, কেন্দ্রে ও রাজ্যে দীর্ঘ ৩০ বছরের কংগ্রেসী শাসনে সেই আশার আলো সম্পূর্ণ প্রজ্বলিত না হয়ে সরকারি উদাসীনতায় টিমটিম করে জ্বলছিল। কেন্দ্রে নেহেরু নেতৃত্বাধীন সরকার শ্রমক্ষেত্রে একাধিক আইন প্রনয়ন করলেও, মালিক শ্রেণী সেই আইনের ফাঁকফোকর অপব্যবহার করতে শুরু করে, অন্যদিকে এই আইনগুলি প্রয়োগে সরকার বিশেষ কোনও সদিচ্ছা দেখায় নি। সম কাজে সম বেতনের কথা বলা হলেও তা কখনোই প্রযোজ্য হয় নি, উপরন্তু মাতৃত্বকালীন সুবিধা স্থায়ী নারী শ্রমিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল, বিশাল সংখ্যা অস্থায়ী নারী শ্রমিক এই আইনের আওয়তায় আসত না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকার মালিকের উপর যাবতীয় দায় ফেলে দেয়। সামগ্রিক ভাবে দেখা যায় ব্রিটিশ আমলে চা-শ্রমিকের যা অবস্থা ছিল, স্বাধীনতা উত্তর পর্বে বিশেষত কংগ্রেস আমলে সেই অবস্থার মূলগত কোনও পরিবর্তনই ঘটে নি। শুধু পাওনার মধ্যে ছিল কিছু সাংবিধানিক আইন, বোনাস এবং সক্রিয় রাজনীতি করার অধিকার। এই রাজনীতির অধিকার প্রাথমিক পর্বে বামপন্থীদের পতাকা তলেই সম্পূর্ণতা পায় এবং তাদের সংগঠিত প্রতিবাদ আন্দোলনই বাংলায় ১৯৭৭ সালে পরিবর্তনের জোয়ার নিয়ে আসে। কিন্তু এই পরিবর্তন তাদের আর্থ-সামাজিক তথা রাজনৈতিক জীবনে কতটা পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল তা আজ অনুসন্ধানের বিষয়।
১৯৭৭ সালে রাজ্যে পালাবদলের সঙ্গে পাহাড়ের জনজীবনে কোন বদল কি আমরা দেখতে পাই? না তার কোন প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। ১৯৭৪ সালে চা বাগানের মালিকপন্থী ইউনিয়নগুলি (প্রধাণত কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন) এবং বামপন্থী ইউনিয়নগুলির সঙ্গে রাজ্য সরকারের যে ত্রিপাক্ষিক আলোচনা হয় তাতে স্থির হয় চা শিল্পে কোনও ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হবে না। প্রতি তিন বছর অন্তর মজুরি সংক্রান্ত ত্রিপাক্ষিক আলোচনা হবে এবং তাতে মজুরি নির্ধারিত হবে। এই ত্রিপাক্ষিক আলোচনায় খুব অল্পই মজুরি বৃদ্ধি ঘটত। ২০০৫ সালে অনিচ্ছুক বাগান মালিকদের আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করার জন্য একটি স্মরণীয় এক মাসব্যাপী ধর্মঘট সত্ত্বেও, ত্রিপাক্ষিক আলোচনায় বাগান মালিকরা শ্রমিকদের দাবি কার্যত অস্বীকার করে উৎপাদনশীলতা রীতি ও পরবর্তী তিন বছরের জন্য সামান্য মজুরি বৃদ্ধি করা হয়। সরকার তাতেই সিলমোহর দেয়। উৎপাদনশীলতা রীতি বলতে বোঝায় শ্রমিকদের তোলা পাতা ঠেকা থেকে কম হলে প্রতি কেজির জন্য এক টাকা মজুরি কাটা হবে। ২০১১ সালে বাম সরকার পতনের প্রাক্কালে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি সমতলে ৬৭ টাকা এবং পাহাড়ে ৯০ থাকা ছিল। সপ্তাহের ছয় দিন কাজ এবং কাজের দিনের জন্যই মজুরি। বেতন ছাড়া বেতনের একটা অংশ দ্রব্যে দেওয়া হতো। যেমন জ্বালানি কাঠ এবং মাসে ৪০০ গ্রাম চা পাতা। বামেদের সমকাজের সম বেতনের নৈতিক দাবিও বাম আমলে বাস্তবে রূপ পায়নি। রেশন প্রদানের ক্ষেত্রেও নারীদের ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় বৈষম্য করা হতো। দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে বেতন বৃদ্ধি ঘটে নি। যার ফলে ২০০৩ থেকে ২০০৭ এর মধ্যে খাদ্যভাব হেতু অপুষ্টি জনিত কারণে প্রায় ১২০০-র বেশি শ্রমিক ও তাদের পরিবারের লোকজন মারা গিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের খাদ্যের অধিকার বেঞ্চের দ্বারা নিযুক্ত এক স্পেশাল অফিসার অপুষ্টি নিয়ে যে রিপোর্ট দেন তা দেখার পর সুপ্রিম কোর্ট ২০০৮ সালে যথেষ্ট কম দামে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা, মাসে অন্তত ১৫ দিন সরকারি উদ্যোগে কাজের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা, বাগানগুলিতে বিনামুল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং কর্মহীন শ্রমিকদের একটা ভাতা দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়। এই সময় প্রায় ৩২টি বাগান বন্ধ হয়ে পড়েছিল, মালিকরা সেগুলিকে বেআইনিভাবে বন্ধ করেছিল। তারা শ্রমিকদের প্রাপ্য বেতন, রেশন (মজুরির যে অংশ খাদ্য শস্যে দেওয়া হয়), গ্র্যাচুইটি এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আত্মসাৎ করেছিল। অথচ সরকার নিছক দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। বাগানগুলি যখন খোলে তখন শ্রমিকরা আর বকেয়া টাকা মেটানোর দাবিই তুলতে পারে নি পাচ্ছে বাগানগুলি পুনরায় যদি বন্ধ করে দেওয়া হয় এই ভয়ে। শ্রমিক, কৃষকদের মধ্যে বামফ্রন্টের জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ১৯৮০ এর মাঝামাঝি সময় থেকে দার্জিলিং এর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও বাংলার রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্রমশ উত্থান যা ২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটায়। মা-মাটি-মানুষের শ্লোগানে বাংলার রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে।
ক্ষমতায় এসেই ২০১১ সালে চা বাগানের ট্রেড ইউনিয়ন, মালিক তথা রাজ্য সরকারের ত্রিপাক্ষিক আলোচনা সম্পন্ন হয় যেখানে সামান্য কিছু মজুরি বৃদ্ধি ছাড়া বিশেষ কোনও পদক্ষেপ বা শিল্প নীতির কথা উঠে আসে নি। এই চুক্তি অনুসারে শ্রমিকদের নগদ মজুরি ছিল সমতলের জেলাগুলিতে দৈনিক ৯৫ টাকা এবং পার্বত্য অঞ্চলে ৯০ টাকা। ২০১৪ সালে মার্চ মাসে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও প্রায় এক বছর পর ২১ মার্চ ২০১৫ সালে শ্রমিকদের সংযুক্ত ট্রেড ইউনিয়ন ফোরাম, মালিক পক্ষ ও সরকারের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যার মেয়াদ ১ এপ্রিল ২০১৪ থেকে ৩১ মার্চ ২০১৭ নির্ধারিত হয়। এই চুক্তিতে সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের বেতনের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণের কথা বলা হয়। স্থির হয় প্রথম বছরের জন্য, অর্থাৎ ১ এপ্রিল ২০১৪ থেকে ৩১ মার্চের জন্য দৈনিক নগদ হবে ১১২.৫০ টাকা, পরের বছর তা বেড়ে হবে ১২২.৫০ টাকা এবং চুক্তির শেষ বছরে সেটা হবে ১৩২.৫০ টাকা। মজুরির একটি অংশ দ্রব্যে দেওয়ার চলন এই পর্বেও অক্ষুণ্ণ ছিল যেখানে কিছু খাদ্যশস্য, জ্বালানী কাঠ এবং ৪০০ গ্রাম চা শ্রমিকদের দেওয়া হতো। ২০১৮ সালে নবম ত্রিপাক্ষিক আলোচনায় শ্রমিকদের বেতনে ১৭.৫০ টাকা অন্তর্বর্তীকালীন বৃদ্ধির কথা বলেছেন এবং অনেক বাগান মালিক শ্রমিকদের ১৫০ টাকা (১৩২.৫০ + ১৭.৫০) দৈনিক বেতন প্রদান করতে শুরু করেছেন। কিন্তু দ্রব্যমুল্যের ব্যাপক বৃদ্ধি তাদের পুনরায় রাস্তায় নামতে বাধ্য করে। ২০১৯ সালে আগস্ট মাসে প্রায় তিন লাখ চা শ্রমিক তাদের দৈনিক বেতন ১৩২.৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১৭৬ টাকা করার জন্য ধর্মঘটে সামিল হয়। ২০২১ সালে চা শ্রমিকদের সংযুক্ত মঞ্চ ন্যূনতম মজুরি দাবির জন্য আন্দোলনে নামে।
স্বাভাবিকভাবে দেখা যাচ্ছে, ব্রিটিশ আমলে চা শ্রমিকদের বেতন, খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কাজের সময়, চাকরির স্থায়ীত্ব প্রভৃতি যে সমস্ত সমস্যা দেখা দিয়েছিল, স্বাধীনতা উত্তরপর্বেও সেই সমস্ত সমস্যার সমাধান অধরাই থেকে যায়। ২০২১ সালেও চা শ্রমিকরা তাদের ন্যূনতম মজুরির অধিকার অর্জন করার জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়। এমনকি তিন বছর অন্তর হওয়া ত্রিপাক্ষিক মিটিং এর জন্যও শ্রমিকদের সবসময় আন্দোলনের পথে যেতে হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর পর্বে মুল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাদের বেতন বৃদ্ধির গ্রাফে বিস্তর ফারাক তাদের দৈনন্দিন বাঁচার সংগ্রামকে ক্রমশ কঠিন করেছে। বেতনের একটি অংশ খাদ্যদ্রব্যরূপে দেওয়ার চল আজও তাদের মালিকদের দাসত্বে ছদ্ম প্রথার শিকলে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। শিক্ষার অভাব তাদের অধিকারের সংগ্রামকে আরও প্রলম্বিত করেছে। ব্রিটিশ আমল থেকে হাল আমলে তাদের সুষ্ঠু ভাবে বাঁচার অধিকারটুকু তারা পায় নি। তাই বলাই যায় বাংলার সরকার পরিবর্তন তাদের বঞ্চনার ইতিহাসে শুধু এক নতুন অধ্যায়ের সংযোজন ঘটিয়েছে মাত্র।
লেখক ডেবরা থানা শহীদ ক্ষুদিরাম স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।