বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

বাংলার তেভাগা আন্দোলন

বাংলার তেভাগা আন্দোলন

সঞ্জয় পুততুণ্ড

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ মে, ২০২২— ব্রিটিশ শাসনের নির্মম পীড়নে ভারতের কৃষকের অবস্থা ছিল মর্মান্তিক। দেশের বিভিন্ন অংশে বারে বারে ফেটে পড়েছে কৃষক বিদ্রোহ। বাংলার পশ্চিম অঞ্চল কেঁপে উঠেছিল সাওতাল বিদ্রোহে। বাংলার পূর্বে চব্বিশ পরগণায় তিতুমীরের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছে বিদ্রোহ। ১৯৩৬ সনে সারা ভারত কৃষক সভার প্রতিষ্ঠার পর সংগঠিত হয় তেভাগা আন্দোলন। তৎকালীন বাংলার ২৮টি জেলার ১৯টি জেলায় এই আন্দোলন বিস্তৃত হয়। শহীদ হন ৮৬ জন, আহত হন বিপুল সংখ্যায়। শহীদের তালিকায় নারীর সংখ্যাও বিস্ময়কর।
প্রেক্ষাপট: ১৭৯৩ সনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এদেশ তৈরি হয় বৃহৎ ভূস্বামী বর্গ। রাজকোষ পূর্ণ করার জন্যই এই ব্যবস্থা। জমিদাররা কৃষকদের কাছ থেকা চড়া হারে খাজনা আদায় করা হতো। তাদের বিপুল পরিমাণ জমিতে কাজ করতো অগণিত কৃষক। অগণিত কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি খাজনা আদায় করা বৃহৎ ভূস্বামীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার জন্য তৈরি করা হয় মধ্যবর্তী স্তর— কোনও কোনও এলাকায় বহুস্তরীয় ব্যবস্থা চালু হয়। কৃষক চাষ করতো উৎপন্ন ফসলের ভাগের বিনিময়ে। এভাবে যারা চাষ করতেন তারাই ভাগচাষী, বর্গাদার, আধিয়ার নামে পরিচিত ছিল। সাধারণভাবে, কৃষকের প্রাপ্য ছিল উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক— ফসলের অবশিষ্ট অর্ধেক জমির মালিকের। কিন্তু বাস্তবে ভাগচাষীরা ফসলের অর্ধেক ভাগ থেকেও বঞ্চিত হতো। তাদের কাছ থেকে বেআইনিভাবে নানা আদায় করা হতো। ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্টে জানা যায়, বর্গাদারদের কাছ থেকে ১৩ প্রকার বেআইনি আদায় করা হতো— দারোয়ানী, পার্বণী, সেলামী, কাকতাড়ানী, খামার চাছনী, ঈশ্বর বৃত্তি, নজরানা, সন্তান কর ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত ভাগচাষীদের ভাগ্যে উৎপন্ন ফসলের যে অংশটুকু জুটতো তাতে সামান্য কয়েক মাসের খাবার সংস্থান হতো। তারপর লতা, পাতা, কন্দ খেয়ে কোনওভাবে বেঁচে থাকা। ফসল তোলা হতো মালিকের খামারে। তাদেরই নির্দেশ অনুযায়ী ধান ঝাড়া এবং ভাগবন্টন।
১৯৩৭ সনে ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টির সরকার হয়। ১৯৩৮ সনে ফ্লাউড সাহেবকে দিয়ে ভূমি-রাজস্ব কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন দুই বছর পরে ১৯৪০ সনে রিপোর্ট পেশ করে। কমিশনের সুপারিশ ছিল, এই অবস্থার স্থায়ী সমাধান সাপেক্ষে বর্গাদারদের ফসলের ভাগ দুই-তৃতীয়াংশ করা হোক। কমিশনের এই সুপারিশ জোতদারদের চাপে কখনও কার্যকর হয়নি। এই সুপারিশ তেভাগা আন্দোলন গড়ে তুলতে যথেষ্ট উৎসাহ ও পরিবেশ সৃষ্টি করে।
১৯২৮ সনে যশোর জেলায় প্রথম উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ ভাগের দাবি ওঠে। প্রাদেশিক কৃষক সভার সম্মেলনে এ দাবির পক্ষে সিদ্ধান্ত হয় ১৯৪৩ এবং ১৯৪৫ সনে। ১৯৪৬ সনের সেপ্টেম্বর মাসে কৃষক প্রাদেশিক কাউন্সিল সভা থেকে তেভাগা কার্যকর করার আহ্বান জানানো হয়। প্রথমে জোতদার-প্রধান ১৩টি জেলায় আন্দোলন শুরু হয়। ক্রমশ তৎকালীন বাংলার ২৮টি জেলার ১৯টি জেলায় এই আন্দোলন বিস্তৃত হয় ১৯৪৭ সনের শুরুতে। ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের ৭৫তম বর্ষে আমরা প্রবেশ করেছি। প্রথমে উত্তরে দিনাজপুর, রংপুর, জলপাইগুড়ি এবং দক্ষিণে চব্বিশ পরগণা ও মেদিনীপুর জেলায় লড়াই তীব্রতা লাভ করে। জেলাগুলিতে ভূমি সম্পর্কের তারতম্য ছিল। যেখানে জমির কেন্দ্রীভভন বেশি, সেখানে আন্দোলনের তীব্রতাও ছিল বেশি।
লীগ মন্ত্রীসভা ১৯৪৬ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা গেজেটে নতুন আইনের খসড়া প্রকাশ করে। তাতে ভাগচাষীদের ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ ভাগ, উচ্ছেদ বন্ধ প্রভৃতি বিষয় স্থান পায়। কিন্তু জোতদারদের প্রবল বাধায় তা আইনসভায় পেশ করেই যায়নি। পরে প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দী একান্তে জ্যোতি বসুকে বলেছিলেন। জমিদারদের শক্তির প্রতাপে জনতামনা সরকার যে কাজ করতে সাহস পায়নি, তার শতগুণ সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনের প্রভাবে পরবর্তী ইতিহস তৈরি হয়েছিল পশ্চিমবাংলায়।
১৯৪৬এর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তেমন সমস্যা হয়নি। অনেক জায়গাতেই বর্গাদাররা তাদের খুশিমতো ধান কেটে নেয়। শঙ্কিত জোতদাররা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে— পুলিশ ও গুন্ডাবাহিনী গঠন করে বর্গাদারদের উপর তীব্র আক্রমণ চালায়। কৃষকরাও পিছিয়ে থাকে না— সামিল হয় বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধে। জানুয়ারি মাস থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। সরকার গোপন সার্কুলার দিয়ে প্রশাসনকে কার্যত হামলায় নামার নির্দেশ দেয়। আন্দোলনের শক্ত ঘাঁটিগুলিতে পুলিশ ক্যাম্প বসতে থাকে।
জেলাগুলির পরিস্থিতি: দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁ মহকুমায় আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। সেখানে বর্গাদার-ক্ষেতমজুরেরা যেমন দৃঢ়পণ লড়াই গড়ে তুলেছিলেন, তেমনই অন্য অংশের কৃষকেরাও তাদের পাশে ছিলেন। তারা অধিকাংশই রাজবংশী ও মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত। চিরির বন্দরের এক গ্রামে ‘৪৭এর জানুয়ারি পুলিশ অভিযান চালিয়ে সামসুদ্দীন নামে এক নেতাকে গ্রেপ্তার করে। তার বোন বাধা দিলে তাকেও বেয়নেট দিয়ে আহত করে। ওই গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষ জড়ো হয়। পুলিশ গুলি করে সমীরুদ্দীনকে হত্যা করলে ক্ষিপ্ত হয়ে আদিবাসী যুবক শিবরাম পুলিশকে তীরবিদ্ধ করে। পুলিশের গুলিতে শিবরামও প্রাণ হারায়। দ্রুত প্রতিবাদ সংগঠিত হয়— সমবেত হয় ১০ হাজার কৃষক। ঠাকুরগাঁ শহরে প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশ গুলি করে ৫ জনকে হত্যা করে। ধুমানিয়া গ্রামেও পুলিশের গুলিতে ৪ জন নিহত হয়।
২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭ পুলিশ খাঁপুরে আসে কৃষক নেতাকে গ্রপ্তার করতে। কৃষক জনতা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ২২ জন। সংবাদ পেয়ে আব্দুল্লাহ রসুল, পিআরসি-র ডা. বিজয় বসু এবং একজন সাংবাদিক যাত্রা করেন। বালুরঘাট থেকে গরুর গাড়িতে যাওয়ার পথে পুলিশ তাদের আটক করে এবং দুই মাসের জন্য জেলা থেকে বহিষ্কার করে। পরিস্থিতি সম্পর্কে স্টেটসম্যান পত্রিকার সংবাদাতা লেখেন, “শতকের পর শতক মূক ছিল সে; আজ এক চিৎকারে ধ্বনিতে রূপান্তরিত।
রংপুরের নীলফামারী একটি গ্রামে জোতদাররা কৃষকদের খামারে তোলা ধান লুঠ করতে যায়। বাচ্চা মুন্সি ও তৎনারায়ণ বর্মণের নেতৃত্বে কৃষকরা বাধা দেয়। পুলিশ গুলি চালিয়ে তৎনারায়ণকে খুন করে। তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে কৃষকরা —ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন।
১ মার্চ, ’৪৭ জোতদারের বাড়ি থেকে কৃষকরা নিজেদের চাষ করা ধান নিয়ে যায়। সেখানে পুলিশ ক্যাম্প থেকে গুলি চালনায় ৪ জন কৃষক প্রাণ হারায়। ৪ এপ্রিল জলপাইগুড়ির মেটেলি থানাতেও একই ঘটনা। সেখানে জোতদারের বাড়ির ক্যাম্পের পুলিশ গুলি চালিয়ে ৯ জনকে হত্যা করে। প্রতিবাদে বিশাল সমাবেশে আত্মগোপনকারী নেতারা বক্তৃতা করলেও পুলিশ তাদের আটক করতে সাহস পায়নি।
বৃহৎ জোতদারদের ঘাঁটি চব্বিশ পরগণা তেভাগা আন্দোলনের শহীদ সংখ্যায় দ্বিতীয় স্থানে। ২৩ ফেব্রুয়ারি কাকদ্বীপের গোবিন্দরামপুরে জমিদারের কাছারিতে এক কৃষককে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রহার করা হয়। যতীশ রায়ের নেতৃত্বে কৃষকরা কৈফিয়ত দাবি করে। কৃষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ নায়েবের নির্দেশ সত্ত্বেও সে ধান ঝাড়েনি। শত শত কৃষক কাছারি ঘিরে ফেলে। একজন ক্ষেতমজুর কার্তিক খাঁড়া হামাগুড়ি দিয়ে কাছারির দরজায় পৌঁছে যায়। ভিতর থেকে বুলেট এসে কার্তিক খাঁড়ার প্রাণ কেড়ে নেয়। সংবাদ পেয়ে প্রতিবাদে সমবেত হয় জনসমুদ্র। বিচক্ষণ নেতৃত্ব ওনেক কষ্টে সেদিন রক্তস্রোত বন্ধ করতে সক্ষম হয়।
এক সপ্তাহ পরেই সন্দেশখালি থানার বেরমজুরে জোতদারের বাড়ির ধান মজুত। ৮ মার্চ আগে থেকে জানিয়ে কৃষকরা ধান ঝাড়া শুরু করলে ক্যাম্পের পুলিশ গুলি চালায়। নিহত হয় রবিরাম সরদার, রতিরাম সরদার, পাগুলু সরদার এবং চামু বিশাল। পার্শ্ববর্তী সমস্ত গ্রাম থেকে কয়েক হাজার কৃষক ছুটে আসে। পুলিশ ও কাছারির লোকেরা প্রাণভয়ে পালিয়ে বাঁচে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে, ৬ নভেম্বর, ১৯৪৮, নামখানার চন্দনপিড়ি গ্রাম। ধান রক্ষার জন্য সমবেত কৃষকদের দেখে পুলিশ পালিয়ে যায়। পুলিশ বাহিনী বর্দ্ধিত শক্তি নিয়ে আবার আক্রমণ হানে। গর্ভবতী অহল্যা সহ ৮ জনকে পুলিশ হত্যা করে—তার মধ্যে ৪ জনই কৃষক রমণী। এই মর্মস্পর্শী ঘটনা সার বাংলাকে নাড়া দিয়ে দেয়। বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর আবার রক্ত ঝরে কাকদ্বীপের বুধাখালি গ্রামে। বকুলতলার মাঠে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় সুধীর, সুরেন ও নীলকন্ঠ; আহত হলেন অগণিত কৃষক ও কৃষক রমণী। আহতদের গোপনে চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন পিয়ারসি-র চিকিৎসকবৃন্দ।
মেদিনীপুর জেলায় তেভাগা আন্দোলন অনেকটা সংগঠিত রূপ নেয়। নন্দীগ্রাম ছিল বৃহৎ জোতদারদের এলাকা। সেখানে এক এক জোতদারের এলাকা ভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। আবার থানা ভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলা হয়। হাজার হাজার কৃষক আওয়াজ তোলে— ফসলের তেভাগা চাই- নিজ খামারে ধান তোলো। নন্দীগ্রাম ছাড়াও তমলুক, পাঁশকুড়া, দাসপুর, চন্দ্রকোণা এলাকায় আন্দোলন শক্তিশালী হয়। যথাসম্ভব পুলিশকে এড়িয়ে সমস্ত এলাকায় একই সঙ্গে ধান কাটা ও ধান তোলার কৌল নেওয়া হয়। পুলিশ ক্যাম্পের নিকটবর্তী এলাকায় ধান কাটার সময় ক্যাম্প ঘেরাও করে রাখার জন্য ব্যাপক কৃষক সমাবেশের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। পুলিশ ও গুন্ডাদের মোকাবিলায় ধূলা মিশ্রিত লঙ্কার গুড়ো ছড়াবার কৌশলটি যথেষ্ট কার্যকর হয়। কৃষকদের সংগঠিত শক্তি এবং নেতৃত্বের বিচক্ষণ কৌশলে অধিকাংশ জায়গায় সফল্ভাবে নিজেদের চাষ করা ধান কৃষকের ঘরে তোলা সম্ভব হয়।
এই সব ঘটনাবলি থেকে আন্দোলনের বিপুল বিস্তৃতি এবং অভিঘাত সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায়। ওই সব এলাকা ছাড়াও হুগলি জেলার বরা, কমলাপুর, ডুবির ভেড়ি, হাওড়ার ডোমজুড়, যশোরের নড়াইল, ময়মনসিংয়ের পাহাড় ও কুমিল্লা জেলায় তেভাগার লড়াই সংগঠিত হয়েছিল।
সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র সেদিন নেমেছিল জোতদারদের পক্ষে। এই আন্দোলনে শহীদ হন ৮৬ জন কৃষক— জোতদার গুলিতে মাত্র একজন নিহত হয়, অন্যরা পুলিশের গুলির শিকার। আন্দোলনের শক্তিশালী কেন্দ্রগুলিতে সর্বত্র পুলিশের ক্যাম্প বসানো হয়েছিল। আন্দোলনের হাজার হাজার সংগঠক ও কর্মীরা ধরা না দিয়ে ঘুরে ঘুরে কাজ করেছে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে। রাষ্ট্রের আক্রমণ প্রতিরোধে উপযুক্ত কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল এবং সেই কৌশল কার্যকর করার মতো সংগঠন গড়ে উঠেছিল। পুলিশ দেখা মাত্র গ্রামের পর গ্রামে সংকেত পৌঁছে দেওয়া এবং অল্প সময়ের মধ্যে স্থানীয় অস্ত্রে সজ্জিত গ্রামবাসী পুলিশকে পরিবেষ্টিত করে ফেলতো। সংগঠনের জালের বিস্তৃতি ছাড়া যা অসম্ভব ছিল।
শোষক জোতদাররা সর্বশক্তিমান নয়, তাদের পরাস্ত করা সম্ভব—এই বিশ্বাস গড়ে তোলা গিয়েছিল কৃষকদের মনে। কৃষকদের সমবেত শক্তির ভয়ে জোতদাররা বহু জায়গাতে পালিয়ে যায়। বিভিন্ন জেলায় আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে, প্রশাসন এমন কিছু নির্দেশ দিয়েছে যা ছিল কৃষকদের পক্ষে। আন্দোলনের বাঁকমোড়ে ছোট-বড় নানা জয় অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যৎ আন্দোলনের পথ করে দিয়েছে— রেখে গেছে অমূল্য শিক্ষা।
তেভাগা আদায়, নিজ খামারে ধান তোলা, পুলিশ-গুন্ডাদের মোকাবিলায় কৃষক রমণীরা কেবল আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধিই করেনি, সামাজিক-পারিবারিক চিন্তা-চেতনার পরিসরেও প্রভাব বিস্তার করে। নারীদের সাহস, বুদ্ধিমত্তা, ত্যাগের স্ফুরণ দেখা গেছে তেভাগা আন্দোলনের সমগ্র পরিসরে। নারীদের নিজস্ব চেতনা এবং তাদের সম্পর্কে পুরুষের চেতনায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে এই আন্দোলন।
আজ শাসক-শোষকদের সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের বিষয়টি অজানা নয়। কিন্তু ৭৫ বছর আগের অবস্থা ছিল পৃথক। কলকাতা-নোয়াখালির দাঙ্গার প্রায় পরক্ষণে শুরু হয় তেভাগা আন্দোলনের প্রস্তুতি। আন্দোলনের কোনও স্তরেই দাঙ্গার বিষবাস্প প্রবেশ করতে পারেনি। এলাকাগুলি ছিল সম্প্রীতির প্রাচীরে ঘেরা। সেই সময়কার সাম্প্রদায়িক সংঘাত নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এই আন্দোলন।
তবে এত বড় আন্দোলন পরিচালনায় যে বিপুল প্রস্তুতি প্রয়োজন, তার কিছুটা অভাব অস্বীকার ককা যায় না। কোনও কোনও এলাকায় প্রচার, কোথাও বা উপযুক্ত কৌশল গ্রহণের দুর্বলতায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে এবং যে আক্রমণ নেমে এসেছিল তা মোকাবিলায় সময় ব্যয় করতে হয়েছিল।
আবার অস্বীকার করা যায় না, তৎকালীন পরিস্থিতির বাস্তব সমস্যা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে স্বাধীনতার সম্ভাবনা মানুষের চেতনাকে ব্যস্ত রেখেছে। বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজ স্বাধীনতা আন্দোলন ও অন্য গণআন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল, কিছু আত্মত্যাগী সংগঠক ছাড়া মধ্যবিত্ত সহ সমাজের অন্য অংশ তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে সংপৃক্ত হতে পারেনি। তা সত্ত্বেও তেভাগা আন্দোলন অনন্য ইতিহাস রেখে গেছে এবং পরবর্তী কৃষক সংগ্রাম ও গণসংগ্রামের ভিত্তিভূমি রচনা করেছে।
পরিশেষে বলা যায়, এই সংগ্রামের প্রভাবেই লীগ মন্ত্রীসভা নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। তবে জোতদারদের বাধায় তা স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু স্বাধীনতার পরে তেভাগা আন্দোলনের জেরে ’৫০-এর দশকে নতুন বর্গা আইন রচিত হয়— সেই আইনে ফসলের ভাগ দাঁড়ায় ৬০: ৪০। পরববর্তী সময়ে ’৭০-এর ফসলের ভাগ হয় ৭৫:২৫ এবং রেকর্ডভুক্তির কাজ শুরু হয়। তা শেষ পর্যন্ত ’৮০-র দশকে অপারেশন বর্গার রূপ গ্রহণ করে। এইভাবেই কৃষকের ফসলের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা সংগ্রাম এগিয়েছিল।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.