বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
৪ সেপ্টেম্বর রাতে, একটি মোমবাতি মিছিল থেকে ফিরে এসে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল দেখছিলাম। অনুভব করলাম, কলকাতা সহ সারা পশ্চিমবঙ্গে আলোড়ন বেড়েই চলেছে।
২৪ আগস্ট দুশোর বেশি ব্যক্তি, যারা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণা ও পড়াশোনার সঙ্গে যুক্ত, বিভিন্ন ব্যানার এবং প্ল্যাকার্ড হাতে নিঃশব্দে রাস্তার মিছিলে ঘন্টা দেড়েক হাঁটলেন। সারাটা রাস্তাই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। মিছিল শেষে কয়েকজন সাংবাদিক আমাকে আমাদের প্রতিবাদ মিছিল সম্পর্কে কিছু বলতে বলেন। আমি বলেছিলাম, “সমাজের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই আমরা রাস্তায় নেমেছি। নিজেদের ইচ্ছায়। আরজিকর হাসপাতালে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ঘটনা এই সামাজিক অবক্ষয়ের ফল। এই ঘটনাটা প্রথমও নয়, এবং এটি যে শেষ সেটাও আশা করা যায় না। অতএব, আমরা যা দাবি করছি তা আমাদের সমাজের সম্পূর্ণ সংশোধন করা। যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে। যখন এই ঘটনাগুলি ঘটবে, অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা উচিত এবং উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া উচিত। এটাই আমাদের দাবি। এবং যতক্ষণ আমাদের দাবি পূরণ না হয়, ততক্ষণ আমরা আমাদের আন্দোলন এবং কলকাতার রাস্তায় মিছিল চালিয়ে যাব।”
জঘন্য অপরাধটি ঘটার পর প্রায় এক মাস অতিবাহিত হয়েছে। অপরাধীদের চিহ্নিত করার এবং যে পরিস্থিতিতে অপরাধটি সংঘটিত হয়েছিল তা জনসমক্ষে প্রকাশ করার বিলম্বের কারণে, বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামছেন। আমরা যারা কলকাতায় থাকি তাদের জন্য ঘটনাটি ভীষণ লজ্জার বিষয়। কিন্তু এটি অবশ্যই গর্বের বিষয় যে, আমরা এই অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ করে যাচ্ছি। এই প্রতিবাদ চলতেই হবে। যদিও কিছু ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি প্রাথমিকভাবে আর্থিক দুর্নীতির। কিছু মেডিক্যাল কলেজে কতিপয় ক্ষমতাবান ব্যক্তিকে বদলি করা হয়েছে বা পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। গত কয়েক বছরে তারা যে শক্তি সংগ্রহ করেছে, বেশিরভাগই রাজ্য সরকারের প্রকাশ্য সমর্থনে, তা এই ঘৃণ্য অপরাধ করার কাজে মদত দিয়েছে। তবে আমাদের দাবি, গত ৯ আগষ্ট সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের সকলকেই গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। এটাই হবে সঠিক বিচার। বর্তমান গ্রেপ্তার, বদলি এবং চেয়ার থেকে অপসারণ, এগুলো ব্যবস্থা পরিষ্কারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই সিদ্ধান্তগুলো আমাদের মূল দাবি থেকে আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে পারে; এই সম্ভাবনা সম্বন্ধে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে, আমাদের সমাজের একটি সম্পূর্ণ সংশোধন প্রয়োজন। পাঠকদের মনে থাকবে যে, কয়েকদিন আগে কেরালা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি কে হেমা প্রদত্ত রিপোর্টের অভিঘাতে সমাজ এক প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে। মালয়ালম চলচ্চিত্র দুনিয়ায় লিঙ্গ বৈষম্য এবং নারী শিল্পীদের অস্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে যে যে মন্তব্য করেছিলেন বিচারপতি হেমা, তার পরিণতিতে মালয়ালম মুভি আর্টিস্টদের অ্যাসোসিয়েশনটির মৃত্যুই হল! আরজিকর হাসপাতালের ঘটনার ঠিক দশ দিন পর, বিচারপতি হেমা কমিটির রিপোর্ট জনসাধারণের সামনে প্রকাশ করা হয়। ধর্ষণ সহ যৌন অসদাচরণ মালয়ালম চলচ্চিত্র শিল্পে সচরাচর হয়ে থাকে বলে রিপোর্টে জানা গেছে। লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে মাননীয় বিচারপতির অভিযোগের অনেকগুলোই আমাদের এখানেও প্রযোজ্য।
আমাদের সমাজে পুরুষের দ্বারা নারীর উপর হিংসা সাধারণ ঘটনা। এটি কেবলমাত্র পুরুষরা শারীরিকভাবে মহিলাদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হওয়ার কারণে নয়। সমাজ বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রম বিভাজন লিঙ্গ ভিত্তিক হয়ে ওঠে। এর ফলে পুরুষের আধিপত্য দেখা দেয়। কারণ পুরুষরা যেসব কাজ করতে আরম্ভ করে সমাজ সেগুলোর মূল্য বৃহত্তর বলে গণ্য করতে শুরু করে। পুরুষতন্ত্র ব্যতিক্রমের পরিবর্তে নিয়মে পরিণত হয়েছে। পুরুষের আধিপত্য সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক পুরুষ এখন আক্রমণাত্মক আচরণ প্রদর্শন করে এবং মহিলাদের নিপীড়ন করে। এটি আরজিকর হাসপাতালের জঘন্য অপরাধের মূল। সুতরাং, মিছিলের শেষে সাংবাদিককে বলেছিলাম, যেটা করা দরকার সেটা হল সমাজের সম্পূর্ণ সংশোধন। এটা সহজ ব্যাপার নয়। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে শিক্ষা নিজেদের বাড়িতে, স্কুলে, পাড়ায়, কলেজে এবং কর্মস্থলে গুরুত্ব সহকারে বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা সময়সাপেক্ষ। দীর্ঘকালীন কর্মসূচি।
আপাতত, ন্যায়বিচার চেয়ে আমাদের আন্দোলন চলবে যতদিন আরজিকর হাসপাতালের অপরাধীদের ধরা না হচ্ছে, এবং তাদের উপযুক্ত শাস্তি না দেওয়া হচ্ছে।
— লেখক ভারত সরকারের ন্যাশনাল সায়েন্স চেয়ার