বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

‘থ্রেট কালচার’ বিপন্ন করছে নার্সদেরও

‘থ্রেট কালচার’ বিপন্ন করছে নার্সদেরও

সন্দীপ চক্রবর্তী

photo

‘অভয়ার মৃত্যু আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। তা দেখিয়েছে, রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে যে ক্ষমতা, তার সামনে আমরা কতটা অসহায়।’ কথাগুলো বলছিলেন মিনতি দাস*। তিনি কলকাতার একটি হাসপাতালের নার্স। কেন এই অসহায়তার বোধ? ‘আমি অভয়া আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলাম বলে হাসপাতালের শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে অনেক হুমকি পেয়েছি। যদিও অভয়ার মৃত্যুর বিচার চেয়েই আমরা রাস্তায় নেমেছি, কিন্তু আমাদের প্রতিবাদ সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যা নার্সিং স্টাফদের প্রতিকূল, কেবলই শাস্তি দিতে উদ্যত।’ কেবল পরিকাঠামো, কাজের পরিবেশ নিয়ে নয়, ঊর্ধ্বতন কর্তাদের মনোভাব নিয়েও তিনি ক্ষুব্ধ। ভীতিপ্রদর্শনের সংস্কৃতি থেকে কাজের জায়গাকে মুক্ত রাখার দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন চিফ মেডিক্যাল্ অফিসার হেলথ (সিএমওএইচ), মনে করেন মিনতি।
‘সকালে ডিউটি থাকলে আমরা ভোর পাঁচটায় উঠি। বাস ধরে কর্মস্থলে যাই। সেখানে পোশাক বদলানোর একটা ঘরও আমাদের দেওয়া হয় না। যদি বা চেঞ্জিং রুম দেওয়া হয়, সেটা হয় হাসপাতালের সব চাইতে ছোট, দমচাপা ঘর। এক একটা হাসপাতালের একশো জনেরও বেশি নার্সকে এই রকম ছোট একটা ঘর দেওয়া হয়। লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতে হয়, কখন ঢুকতে পারবে ঘরে। এ দিকে ডিউটির সময় শুরু হয়ে যায়। হাসপাতাল সুপার এই অব্যবস্থার দিকে তাকান না।’
বেশির ভাগ জেলা হাসপাতালে রোগীর মৃত্যু ঘটলেই জুনিয়র ডাক্তার আর নার্সিং স্টাফদের মারধর করা হয়। নার্সদের শ্লীলতাহানিও করে রোগীর পরিবারের লোকেরা। সব ঘটনা সামনে আসে না, কারণ নার্সরা পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে চান না। বেশির ভাগ হাসপাতালে পুলিশের সংখ্যা এত কম, যে রোগীপক্ষের মারমুখী লোকেদের সামনে পুলিশ পিছু হটে যায়। জুনিয়র ডাক্তার এবং নার্সরা তাদের সামনে পড়ে। রোগীর আত্মীয়দের সঙ্গে শাসকদলের সম্পর্ক থাকলে আক্রমণ বেশি হয়। রোগীর লোকেরা জোর করে নার্সদের ঘরে ঢুকে পড়ে, নার্সদের নির্দেশ দিতে থাকে। তাদের ঔদ্ধত্যের সীমা নেই।
শহরের হাসপাতালগুলোতেই যদি নার্সদের এই অবস্থা হয়, তা হলে গ্রামীণ হাসপাতালগুলির অবস্থা আন্দাজ করা কঠিন নয়। সেখানে কেবল নেই-নেই — ওষুধের অভাব, ব্যান্ডেজের অভাব থেকে ডাক্তারের অভাব। মানুষ নবনির্মিত হাসপাতাল ভবন দেখে রোগীদের নিয়ে আসে, তারপর প্রশিক্ষিত মেডিক্যাল কর্মীদের অভাব টের পায়। তাদের ক্ষোভ এসে পড়ে নার্সদের উপরে।
নার্সদের প্রমোশন প্রায়ই সিনিয়রিটির ভিত্তিতে হয় না। কে ক্ষমতাসীন দলের কতটা কাছাকাছি, তার উপর নির্ভর করে। এই অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা গ্রামীণ হাসপাতালের কাজের পরিবেশকে প্রভাবিত করে। ‘একজন নার্স সপ্তাহে গড়ে একশো ঘন্টারও বেশি কাজ করে, বিশেষ করে রাজ্যের গ্রামীণ হাসপাতালগুলোতে, কিন্তু তার কোনও প্রতিদান পায় না,’ বললেন ক্ষুব্ধ প্রতিমা মল্লিক*। আর একজন জিএনএম নার্স বলেন, একজন নার্স যেদিন থেকে জিএনএম প্রশিক্ষণ কোর্স করতে আসে, সেই দিন থেকেই ব্যবস্থার দুর্নীতির শিকার হওয়া শুরু হয়। বর্তমান ব্যবস্থায় নার্সিং প্রশিক্ষণরত মেয়েদের পাস নম্বর পেতে প্রচুর টাকা দিতে হয়। ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকেও জিএনএম নার্স বানানোর মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আরও অভিযোগ, এখন অর্থের পরিবর্তে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রশাসন বেঙ্গালুরু-ভিত্তিক নার্সিং ট্রেনিং কলেজগুলিকে প্রশিক্ষিত নার্স সরবরাহ করার জন্য নিয়োগ করে। ফলে বিত্তশালী বাঙালি পরিবারের মেয়েরা বেঙ্গালুরুতে পড়ে কাজ পাচ্ছে, কিন্তু নিম্নবিত্ত মেয়েরা এ রাজ্যের উচ্চমানের নার্সিং প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করেও কাজ পাচ্ছে না। কাজের খোঁজে ভিনরাজ্যে, ভিনদেশে যেতে হচ্ছে, নানা হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে। অথচ, অন্য রাজ্য থেকে আসা নার্সদের প্রশিক্ষণে যথেষ্ট ঘাটতি থাকছে। ইঞ্জেকশন দিতেও পারছে না অনেকে। তিন-চার বছর
লেগে যাচ্ছে দক্ষতা অর্জন করতে। ‘অভয়ার মৃত্যু আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। উচ্চতর আদালতগুলির কাছে আমাদের অভিযোগ জানানোর এই হচ্ছে সময়। তারা আমাদের কাজের পরিস্থিতি বিচার করে দেখুন, আরও ভাল একটা ব্যবস্থা তৈরি করুন। নার্সদের কাজকে কায়িক শ্রমের কাজ বলে দেখা বন্ধ হোক,’ দাবি করলেন এক নার্স।
মল্লিকা ঘোষ* মেদিনীপুরের একটি হাসপাতালের জিএনএম নার্স। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে দূষিত স্যালাইনের ঘটনায় রাজ্য সরকার যে ভাবে নার্সদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে, তাতে তিনি ক্ষুব্ধ। তাঁর অভিযোগ, খারাপ স্যালাইন ছিল মায়েদের মৃত্যুর কারণ, অথচ স্বাস্থ্যকর্মীদের ভুল খুঁজে বার করতে সরকার বদ্ধপরিকর। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ওষুধ ও স্যালাইন সরবরাহকারী ঠিকাদাররা রাজ্যের শাসক দলের কাছাকাছি হওয়ার জন্যই বিপদ ঘটছে। মল্লিকার মতে, আর জি কর হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের মতো প্রশাসকরা প্রশাসনের সর্বত্র সিঁধিয়ে রয়েছে। ডাক্তারদের মতো, নার্সরাও বদলি বা প্রমোশনের ক্ষেত্রে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’-র শিকার। এ বিষয়ে কোনও অভিযোগ স্বাস্থ্য ভবন গ্রাহ্য করে না। ‘আমি বছরের পর বছর ধরে প্রমোশনাল পোস্টিং-এর জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু আমি শাসকগোষ্ঠীর কাছের লোক নই, তার উপর নার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তাই তারা আমাকে ভয় পায়। আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যেও আমি শাস্তির মুখে পড়তে পারি। তবে এ সব ভয় দেখানোকে আমি পাত্তা দিই না,’ বললেন মল্লিকা। q

* এই প্রতিবেদনে নার্সদের নাম পরিবর্তিত।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.