বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
অমর্ত্য সেন ২০০৮ সালে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, পরে সেটি প্রবন্ধ হিসেবে তাঁর দ্য কান্ট্রি অব ফার্স্ট বয়েজ় (২০১৫) সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হয়। ফার্স্ট বয়দের দেশ নামে এই সঙ্কলনের একটি বাংলা তর্জমাও প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালে। প্রবন্ধের শিরোনাম: ‘হোয়ট শুড কিপ আস আওয়েক অ্যাট নাইট?’ কী নিয়ে আমাদের বিনিদ্র রজনী যাপন করা উচিত? অর্থাৎ, কিসের চিন্তায় আমাদের রাতের ঘুম চলে যাওয়ার কথা? বলা বাহুল্য, নানা জনের কাছে এই প্রশ্নের নানা অর্থ। একটা প্রচণ্ড এবং বহুমাত্রিক অসাম্যের কাঠামোয় সেই অর্থভেদ অতিমাত্রায় প্রবল হওয়াই স্বাভাবিক— থাকবন্দি সমাজের কোন তলায় কার বাস, তার উপর চিন্তাভাবনার গতি ও প্রকৃতি ভয়ানক ভাবে নির্ভর করতে বাধ্য।
যেমন, উচ্চকোটির যে অধিবাসীদের কাছে মুনাফাই একমাত্র ঈশ্বর, মুনাফার জন্ম দিতে দিতে যাদের কেটে গেছে অনেক সময়, মুনাফার জন্ম দেবে জন্ম দেবে বলে যারা পুঁজির বীজক্ষেতে চষে আসছে, তাদের হৃদয় আর মাথার ভিতরে অহোরাত্র একটিই চিন্তা কাজ করে: কী করলে মুনাফা বাড়বে। আবার, এই মুনাফাতন্ত্রের আনাচেকানাচে উচ্ছিষ্টভোগী যে সব পরজীবীর ঘরের মেঝের নীচে বা নকল দেওয়ালের পেটে কিংবা স্নানঘরের আনাচেকানাচে টাকার বান্ডিল লুকোনো থাকে, তাদের মন কি বাত একটা নিজস্ব গভীর গোপন ধারায় প্রবাহিত হবে, হতে বাধ্য।
অন্য দিকে, মাসের শেষ সপ্তাহে পাড়ার দোকানদার যাঁকে ‘আর ধারে মাল দেওয়া যাবে না’ বলে জবাব দিয়ে দিয়েছেন, কিংবা অসুস্থ শিশুকন্যার জন্য আরও পনেরো দিনের ওষুধ কেনার পয়সা যাঁর নেই, অথবা যাঁর হাজার দশেক টাকার চাকরিটা যে কোনও দিন চলে যেতে পারে, সেই সব অমৃতের পুত্রকন্যাদের নিদ্রাহারা রাতের চেহারা এবং চরিত্র আলাদা। অগণন শ্রমজীবী মানুষের অবশ্য একটা বড় সুবিধে আছে: সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পরে দু’চোখের পাতা এক করলেই অপ্রতিরোধ্য ঘুম নেমে আসে; অসহনীয় গরম, হাজার আওয়াজ, এমনকি আধপেটা খিদেও তাকে আটকাতে পারে না। এমন নিদ্রায় চিন্তার কোনও স্থানই নেই।
কিন্তু, আবারও বলা বাহুল্য, অমর্ত্য সেনের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে এই দৃষ্টান্তগুলি অপ্রাসঙ্গিক। তিনি বলছেন মানবিক দায়িত্বের কথা। সেই দিক থেকে বিচার করলে অনন্ত মুনাফাকৈবল্যতন্ত্রের বশীভূত ক্ষমতাবানেরা নিতান্তই অবান্তর, কারণ তাঁদের ব্যক্তিত্ব ওই তন্ত্রের ধারক ও বাহকে পরিণত, সুতরাং বৃহত্তর মানবিকতার অর্থে ‘মানুষ’ বলে গণ্য হওয়ার যোগ্যতাই তাঁরা হারিয়েছেন। কী নিয়ে চিন্তা করা ‘উচিত’ সেই প্রশ্নকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দেওয়ার বাসনা তাঁদের নেই, প্রয়োজনও নেই। যদি কারও তা থাকে, তবে সেটা ব্যক্তিগত ব্যতিক্রম, সুতরাং এই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক নয়। আর, ওই অগণন সুযোগবঞ্চিত শ্রমসর্বস্ব মানুষ? চিন্তার ভুবনে তাঁদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে রাখে সেই সমাজ, যে তাঁদের জীবনধারণের আবশ্যিক প্রয়োজন মেটানোর সমস্যাকেই নিরন্তর এক অতলান্ত সঙ্কটে পরিণত করেছে, ফলে অন্য কোনও চিন্তার অবকাশটুকু তাঁদের নাগালের বাইরে। অন্য ভাবে বলা যায়, নিজের চিন্তাভাবনার বিষয় পছন্দ করে নেওয়ার কোনও সুযোগ তাঁদের থাক না।
অমর্ত্য সেন, স্পষ্টতই, বলতে চাইছেন সেই সব মানুষের কথা, যাঁদের বৃহত্তর চিন্তাভাবনা এবং কাজকর্মের অবকাশ আছে, আকাঙ্ক্ষাও আছে। মানে, যাঁরা চিন্তা ও কাজ করতে চান এবং পারেন। তাঁদের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল হতে হবে, এমন কোনও শর্ত নেই, তবে বেঁচে থাকার প্রয়োজন মেটানোর পরে তাঁদের হাতে কিছুটা সময় এবং সুযোগ থাকে। স্পষ্টতই, প্রয়োজন ব্যাপারটা নিতান্ত আপেক্ষিক। যাঁরা সমাজের জন্য, বিপন্ন মানুষের জন্য বিস্তর কাজ করেন তাঁদের অনেকেরই নিজের জীবনে সাচ্ছল্য নেই, অনেক সমস্যাও আছে, কিন্তু তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনকে সীমিত রেখে সমাজের প্রয়োজনকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেন, দেন বলেই অপরের জন্য ভাবতে পারেন, কাজ করতে পারেন। তাই, এখানে তেমন সব মানুষের কথাই আমরা ভাবতে পারি, যাঁদের সাধারণভাবে সমাজসচেতন নাগরিক বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, সমাজ সম্পর্কে, সমাজের বাস্তব অবস্থা এবং সেই বাস্তবের অন্তর্নিহিত সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে যিনি অচেতন নন, তেমন নাগরিক।
এ-কথা বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, সামাজিক বাস্তবকে কে কীভাবে দেখবেন, বাস্তবের কোন দিকগুলিকে প্রাসঙ্গিক বা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবেন, সেটা একটা আপেক্ষিক প্রশ্ন। প্রত্যেক মানুষের কাছে তার একটা নিজস্ব উত্তর আছে। এমনকি সমাজের প্রতি অতি বড় উদাসীন বা বিমুখ মানুষও এই সত্যের বাইরে নন— ঔদাসীন্য বা বিমুখতাও সামাজিক চেতনার রূপ বইকি। আর তাই, সমাজচেতনার কোনও ‘শ্রেষ্ঠ’ বা ‘আদর্শ’ ধারণার সন্ধানে সময় এবং পরিশ্রমের অপচয় না করে আমাদের ঠিক করে নিতে হবে, আমরা কী নিয়ে সচেতন হব, কী নিয়ে ভাবব, কিসের চিন্তায় বিনিদ্র রজনী যাপন করব? যদি বলি, কোনও কিছু নিয়েই মাথা ঘামাব না, কোনও ভাবনাতেই রাতের ঘুম নষ্ট করব না, সেটাও এক ধরনের ‘ঠিক করে নেওয়া’ই হল। ‘আহার, নিদ্রা ও মৈথুন’ স্বচ্ছন্দে বহু মানুষের জীবনে যথেষ্ট হতে পারে, হয়ে থাকে। তাঁরা ভাল থাকুন, সুখে থাকুন। তবে কিনা, সেই ভাবনাবিহীন সুখের জড়ত্বে যদি কারও মন না ভরে, তা হলেই ওই প্রশ্নটির মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে: কী নিয়ে ভাবব?
অমর্ত্য সেন তাঁর বক্তৃতা তথা প্রবন্ধের শুরুতেই পরিষ্কার বলেছিলেন, সমাজের পরিব্যাপ্ত অসাম্য (ইনএকুয়িটি) এবং অ-ন্যায় (ইনজাস্টিস) নিয়েই প্রবলভাবে চিন্তা করা দরকার। অতঃপর সেই প্রবন্ধে স্তরে স্তরে বিন্যস্ত হয়েছিল একদিকে অসাম্যের বহুমাত্রিক চরিত্র এবং অন্যদিকে ন্যায় বা ন্যায্যতার ধারণা সম্পর্কে সুগভীর চিন্তাভাবনার চমৎকার একটি বিশ্লেষণ। আমরা তার আলোচনায় যাব না, আগ্রহীরা সেটি সহজেই দেখে নিতে পারেন। আমরা আপাতত বিশেষভাবে নজর দিতে চাই একটি দিকে। এই আলোচনার শুরুতেই সেই দিকটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তার সূত্র ধরেই আমরা বুঝতে চাইব, নানা ধরনের অসাম্যে জর্জরিত একটি সমাজের বাস্তবতা কীভাবে নাগরিকদের সামাজিক ধারণাকে প্রভাবিত করে, সমাজবাস্তবের ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে তাঁদের চিন্তায় চেতনায় সেই অসাম্যের কী প্রভাব পড়ে। এই প্রশ্নের উত্তর না জানলে সামাজিক অসাম্যের মোকাবিলায় এগোনোর পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন। অতএব, চিন্তা করার উদ্দেশ্য যদি কেবল চিন্তা করা এবং বক্তৃতা দেওয়া আর প্রবন্ধ লেখাতেই সীমিত না থাকে, পৃথিবীটাকে পাল্টানোর ভাবনা যদি সেই চিন্তার অঙ্গ হয়, তা হলে এই প্রশ্নকে তুচ্ছ করার কোনও উপায় নেই।
একটা ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার। নাগরিকের চিন্তায় সামাজিক অসাম্যের প্রভাব পড়বেই, কিন্তু সেই প্রভাব কেমন হবে, কীভাবে তা কাজ করবে, এর কোনও পূর্বনির্ধারিত এবং সর্বকালীন সর্বজনীন উত্তর নেই। এই সতর্কবাণী দু’টি কারণে প্রয়োজনীয়। প্রথমত, বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা বলে যাকে আমরা চিনেছিলাম, তার একটা খুব বড় এবং প্রতিপত্তিশালী পরিসরে এই বিশ্বাস জোরের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষত উৎপাদন-ব্যবস্থার চরিত্রই সামাজিক মানুষের চিন্তাভাবনা নির্ধারণ করে দেবে। জীবনধারার ছাপ চেতনাকে গড়ে— এই কথাটিকে কেবল আক্ষরিক অর্থেই অভ্রান্ত ও ধ্রুব সত্য বলে মনে করা হয়নি, জীবনধারা বলতে নির্দিষ্ট অর্থে উৎপাদন-সম্পর্ককেই বোঝা এবং বোঝানো হয়েছিল। এই ধারণা তথা বিশ্বাসের পরিণামে সমাজতন্ত্রের অনুশীলনকারীদের একটা বড় অংশ মানুষের চিন্তা এবং চেতনার জটিল ও দ্বন্দ্বময় চরিত্রকে কীভাবে অগ্রাহ্য করেছিলেন, তার করুণ কাহিনি আজ আর নতুন করে বলার দরকার নেই। অভিজ্ঞতা জানিয়েছে, এই নির্ধারণবাদ সমাজ-বদলের সম্ভাবনাকে শাঁখের করাতের মতো দু’দিকেই কেটেছে। সে ঘোষণা করেছে, ‘সমাজব্যবস্থার আমূল সংস্কার’ ছাড়া চেতনার পরিবর্তন হবে না, সুতরাং তার জন্য আলাদা করে কোনও চেষ্টা অনাবশ্যক, বস্তুত অর্থহীন। অথচ চেতনার পরিবর্তন ছাড়া সমাজব্যবস্থার সংস্কারের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। ফলে সমাজতন্ত্রের নামে নানা ধরনের অচলায়তন তৈরি হয়েছে।
অন্য দিকে, নির্ধারণবাদী মানসিকতায় এমন একটি ধারণা খুব সহজেই কায়েম হতে পারে যে, যিনি যে শ্রেণীর মানুষ, তিনি ‘স্বভাবত’ নিজের শ্রেণীস্বার্থ অনুসারেই ভাববেন। এই ধারণা থেকে খুব সহজেই আমরা পৌঁছে যেতে পারি এক ধরনের স্বার্থসর্বস্ব সমাজদর্শনে। সেই দর্শন বলে, যে যার নিজের সামাজিক অবস্থান অনুসারে কাজ করুক, উন্নতির চেষ্টা করুক, আন্দোলন করুক, তা হলেই সমাজ অগ্রসর হবে, ‘অন্যের’ স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই, যৌক্তিকতাও নেই। সুতরাং, সুযোগবঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের কথা কেবল তাঁদের নিজেদেরই ভাবতে হবে, তাঁদের জন্য ‘বাইরে থেকে’ অন্য কেউ কাজ করবেন এটা কাম্য নয়, করলেও সেই কাজ সার্থক হবে না। এর সঙ্গেই দিব্য জড়িয়ে থাকে বঞ্চিত মানুষদের দুরবস্থার জন্য তাঁদেরই দায়ী করার মানসিকতা— কত বার কত লোককে উচ্চকণ্ঠে কিংবা ঈষৎ গলা নামিয়ে বলতে শুনেছি, “ওরা নিজেরাই তো যথেষ্ট এফর্ট দেয় না, ছেলেমেয়েগুলোকে পড়াশোনাটা ভাল করে শেখালে কি আর এই অবস্থা থাকত?” শ্রেণীবৈষম্যের কাঠামোতেই ‘গ্যাসলাইটিং’-এর মারণমূর্তিটি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে।
বলা বাহুল্য, আজকের বাজার অর্থনীতির সর্বগ্রাসী অভিযান এই ধারণায় প্রভূত ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে। ‘যে যার নিজেরটা লড়ে আদায় করে নিতে হবে’— এই নীতিই সেই অভিযানের একটি প্রধান মন্ত্র। সেই মন্ত্রে দীক্ষিত অগণন মানুষ অমর্ত্য সেনের প্রশ্নটির উত্তর দিতে দু’বার ভাববেন না। তাঁরা জানিয়ে দেবেন: আত্মোন্নতির চিন্তাতেই আমাদের রাতের ঘুম চলে যাওয়া উচিত, তবেই সকলের উন্নতি হবে। এই আত্মমগ্ন এবং সমাজবিচ্ছিন্ন মানসিকতার নিদর্শন আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে দেখে চলেছি। শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, জীবনযাপনের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণে, শ্রমিকের কাজের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা বিধানে অজস্র মানুষ গভীর অন্ধকার থেকে গভীরতর অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হচ্ছেন, আমরা দেখছি এবং দেখছি না। প্রায় আক্ষরিক অর্থে প্রত্যেক দিন বিভিন্ন জায়গায় দিনমজুররা নির্মীয়মাণ বহুতল ইমারত থেকে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন অথবা সারা জীবনের মতো অক্ষম হয়ে যাচ্ছেন, মহানগরের রাজপথের নীচে নর্দমা পরিষ্কার করতে নেমে অথবা ধাপার জঞ্জালশিখরে চড়তে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে আসছেন, নাগরিকের চাহিদা মাফিক খাবারদাবার অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে পৌঁছে দিতে গিয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন— এই সব মরণ আমাদের দৈনন্দিন সংবাদের সমারোহে পাখির পালকের মতো তুচ্ছ, আমাদের স্মৃতিতে বুদ্বুদের মতো ক্ষণস্থায়ী।
কিংবা ধরা যাক শিক্ষার ছবিটা। বছরের পর বছর রাজ্য জুড়ে অগণিত শিশু ও কিশোরকিশোরীর কার্যত কোনও লেখাপড়াই হচ্ছে না, ক্লাস সেভেনের শিক্ষার্থীকে ক্লাস থ্রি-ফোরের বই পড়তে দিলে পড়তে পারছে না, যোগবিয়োগ যদি বা পারে, গুণ করতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে, ভাগ তো সম্পূর্ণ নাগালের বাইরে। কোনও সমীক্ষা না করে বলে দেওয়া যায়, এই শিশুদের অধিকাংশই গরিব শ্রমজীবী ঘরের সন্তান। যে তীব্র সামাজিক বৈষম্য আমাদের গ্রাস করেছে, শিক্ষার এই অসাম্য তাকে আগামী এক দশকের মধ্যে আরও কতখানি বাড়িয়ে তুলবে, ভাবলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু শহরের তথাকথিত শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজে এই ভয়ানক পরিস্থিতি নিয়ে প্রায় কোনও উচ্চবাচ্য শোনা যাবে না। যে পরিস্থিতি অসহনীয়, তাকে আমরা শুধু সহ্য করছি না, অনায়াসে ভুলে থাকছি। রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া? কী যে বলেন!
শাসকের রাজনীতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতি আমাদের নাগরিক সমাজের এই ঔদাসীন্যের সুযোগ নেবে, সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা কব্জি ডুবিয়ে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন। তাঁরা বুঝে নিয়েছেন, শ্রমজীবী মানুষের সসম্মান জীবন যাপনের কথা আদৌ ভাববার প্রয়োজন নেই, তাঁদের কোনও ক্রমে দিন কাটলেই যথেষ্ট, এবং রকমারি প্রকল্প ঘোষণা করে তাঁদের হাতে কিছু টাকাকড়ি তুলে দিলে, আর মাঝে মাঝে নানা নতুন নতুন কর্মসূচি তৈরি করে তাঁদের অভাব-অভিযোগ ‘শোনবার’ একটা আড়ম্বর চালিয়ে যেতে পারলেই যথেষ্ট। উল্টো দিকে, বিরোধী রাজনীতির চালকরাও সত্যিকারের সামাজিক ন্যায়ের প্রসার ঘটানোর জন্য কোনও সংগঠিত দাবি বা আন্দোলন নির্মাণের চেষ্টা করছেন না, তাঁদের সমস্ত শক্তি দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনেই লগ্নি হয়ে চলেছে। দুর্নীতির বিরোধিতা অবশ্যই জরুরি, কিন্তু কখনওই যথেষ্ট হতে পারে না।
কেন আমাদের বিরোধী রাজনীতি, বিশেষত ‘বামপন্থী’ রাজনীতি সামাজিক ন্যায়ের প্রসার ঘটানোর এই প্রাথমিক দাবিকে তার চিন্তায় ও কর্মসূচিতে স্থান দিতে পারছে না? তার অনেক কারণ আছে। কিন্তু একটা কারণ অবশ্যই সামাজিক অসাম্য এবং দূরত্ব। আমাদের সমাজে কেবল অসাম্য বাড়ছে না, সুযোগবঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে তুলনায় সুবিধাভোগী উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাপনে এবং মানসিকতায় পারস্পরিক দূরত্ব ক্রমশই বেড়ে চলেছে। বামপন্থী রাজনীতিও এই দূরত্বের শিকার। তার ‘এজেন্ডা’ প্রধানত মধ্যবিত্তের প্রয়োজনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বা মহার্ঘ ভাতা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনে তারই প্রতিফলন। আবার, গরিবের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বা শ্রমজীবীর নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন না-হওয়ার বাস্তবেও সেই একই দূরত্বই প্রতিফলিত।
এই দূরত্ব ঘোচানো জরুরি। তার দায়িত্ব কেবল রাজনৈতিক দলের নয়, নাগরিক সমাজেরও। আগে সমাজব্যবস্থা পাল্টাবে, সামাজিক অসাম্য কমবে, তার পরে আমরা সামাজিক দূরত্ব কমানোর কথা ভাবতে পারব— এমন কোনও ধারণা সম্পূর্ণ অর্থহীন। যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি, সেখান থেকেই দূরত্ব কমানোর কাজটা শুরু করা যায়। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমাদের হাতেই আছে। অতিমারির দিনগুলিতে নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজের অনেক মানুষই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শ্রমজীবী দরিদ্র সহনাগরিকদের পাশে দাঁড়াতে, তাঁদের সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করতে, তাঁদের জীবনযাত্রাকে আর একটু সহনীয় করে তুলতেও। তার পরেও তেমন কিছু কিছু উদ্যোগ অনেক দিন চলেছে, এখনও সম্পূর্ণ থেমে যায়নি। কিছু মানুষ যা পেরেছেন, আরও অনেক মানুষের তা না-পারার কোনও সঙ্গত কারণ নেই।
যে বস্তুটি আমাদের এই পারা এবং না-পারার মধ্যে প্রকৃত ব্যবধান রচনা করে, তার নাম সহনশীলতা। সামাজিক বৈষম্য এবং সেই বৈষম্যজনিত অন্যায্যতার প্রতি আমাদের সহনশীলতা যত বেশি হবে, সামাজিক দূরত্ব ঘোচানোর ব্যাপারে আমরা ততই নিশ্চেষ্ট থাকব। অতিমারির বিপর্যয়ে সেই অন্যায্যতার মাত্রা এবং তার পরিণাম অনেকের অসহনীয় মনে হয়েছিল বলেই কিছু সামাজিক উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল। বৈষম্যের প্রতি আমাদের সহনশীলতা কমানো— অমর্ত্য সেনের ভাষায় বললে, রাতে ঘুমোতে পারার ক্ষমতা হারানো— একটা খুব বড় কাজ। তার কোনও পূর্বনির্ধারিত উপায় জানা নেই। কিন্তু আমরা অন্তত পরস্পরকে এই বিষয়ে ক্রমাগত উত্ত্যক্ত করতে পারি। এবং, অবশ্যই, শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে দৈনন্দিন সংযোগ যথাসম্ভব, যত ভাবে সম্ভব বাড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে পারি। দূরত্বের প্রতিষেধক হিসেবে সংযোগের তো কোনও বিকল্প থাকতে পারে না।