বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

ডিএ মামলায় হাইকোর্টের রায় প্রসঙ্গে

ডিএ মামলায় হাইকোর্টের রায় প্রসঙ্গে

কমল কুমার দাশ

photo

গত ২৫ মে ২০২২, আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয় কলামে ডিএ সংক্রান্ত মামলায় হাইকোর্টের রায়কে সমালোচনা করে “বাঘের পিঠে সওয়ার” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধের বিষয়বস্তুকে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর মনোভাব ধরে নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
মহামান্য আদালতকে মান্যতা দিয়ে গণতান্ত্রিক দেশের যে কোনও নাগরিক আদালতের রায়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেই পারেন। আমাদের দেশের সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে সেই অধিকার দিয়েছে। সেদিক থেকে হাইকোর্টের ডিএ মামলার রায়কে পর্যালোচনা করার সাংবিধানিক অধিকার আনন্দবাজার পত্রিকার আছে। এর আগেও আদালতের বিভিন্ন রায়ের বিশ্লেষণ এই পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে পড়েছি। পত্রিকাটি তার ঐতিহ্য এবং পরম্পরা রক্ষা করে এবারও হাইকোর্টের ডিএ মামলার রায় অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছে। এ জন্য পত্রিকা সম্পাদককে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ডিএ মামলার রায় ঘোষণা করতে গিয়ে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের একজন বিচারপতি জানিয়েছেন ডিএ সরকারি কর্মীদের মৌলিক অধিকার। আনন্দবাজার গোষ্ঠী সরকারি কর্মীদের ডিএ পাওয়ার এই অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করতে নারাজ। তাদের যুক্তি হল “মৌলিক অধিকার বস্তুটি দেশের সব নাগরিকের ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য হতেই হবে। আদালত পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে আয়বৃদ্ধির অধিকারের যে যুক্তিটি পেশ করেছে, তা-ও সব নাগরিকের ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য হতেই হয়।” মহামান্য বিচারপতি আইনের পরিসরে দাঁড়িয়ে বিচারাধীন বিষয়ের রায় দেন। এক্ষেত্রে বিচারক মহাশয় কেন ডিএ পাওয়া অধিকারকে সরকারি কর্মীদের মৌলিক অধিকারের পর্যায়ভুক্ত করেছেন তার ব্যাখ্যা আইনের ছাত্ররা ভাল দিতে পারবেন। সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি যেটুকু বুঝেছি তা ব্যক্ত করছি। ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ের ১২ থেকে ৩৫ নম্বর ধারায় উল্লেখিত ৬টি অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে নির্ধারিত করা হয়েছে। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে দেশের সব মানুষ এই অধিকার সমানভাবে ভোগ করে। কিন্তু ডিএ পাওয়ার অধিকার সরকারি কর্মীদের অর্জিত অধিকার। এর সঙ্গে সব নাগরিকের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের কোনও যোগসূত্র নেই। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সরকারি কর্মীরা এই অধিকার অর্জন করেছে। এটি কোনও জমিদারের দয়ার দান নয়। তাই আদালত স্পষ্ট ভাষায় বলেছে ডিএ সরকারি কর্মীদের মৌলিক অধিকার।
দ্বিতীয়ত,পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে আয় বৃদ্ধির অধিকারের যে যুক্তি আদালত পেশ করেছে তা সরকারি কর্মচারীদের সার্ভিস রুলের অন্তর্ভুক্ত। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডিএ (Dearness Allowance) বৃদ্ধির অধিকার সরকারি কর্মীদের দেওয়া হয়েছে সামাজিক সুরক্ষা এবং সম্মানজনক জীবন ধারণের কথা মাথায় রেখে। মনে রাখতে হবে এই অধিকারও সরকার স্বেচ্ছায় দেয়নি। লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়েছে।
তৃতীয়ত, ডিএ পাওয়ার অধিকারকে আদালত আইনি অধিকার হিসেবে উল্লেখ করেছে। আইনগত অধিকার বলতে আদালত যা বোঝাতে চেয়েছে তা আইনের ব্যাখ্যার মধ্যে খোঁজা যাক— “A legally enforceable contract means that you can hold the other contracting party to their promises. If the other contracting party fails or refuses to uphold their obligations, you can rely on the law to enforce your agreement.” মোদ্দা কথা, আইনি অধিকার হল একটি শক্তিশালী স্থায়ী অধিকার। অথচ রায়ে ঘোষিত আইনি অধিকারের প্রসঙ্গটি সম্পাদক সুচারুভাবে তাঁর লেখায় অনুল্লেখ রেখেছেন।
চতুর্থত, মহার্ঘভাতার সঙ্গে সরকারের কল্যাণপ্রকল্পগুলোর তূল্যমূল্য বিচার করে সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন তুলে বলা হয়েছে “কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মী, নাকি বিপুল সংখ্যক (নিশ্চিত ভাবেই দরিদ্রতর) রাজ্যবাসী, কার স্বার্থরক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়?”
“কিছুসংখ্যক” এবং “বিপুলসংখ্যক” এই শব্দদ্বয় ব্যবহারে করে সম্পাদক সচেতনভাবে রাজ্যের দরিদ্র মানুষ এবং সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে আড়াআড়ি একটা বিভাজন রেখে তৈরি করে ডিএ প্রদানকে তথাকথিত উন্নয়নের বিপ্রতীপে দাঁড় করিয়েছেন। অর্থাৎ আদালতের নির্দেশকে মান্যতা দিয়ে, দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের সংগ্রামকে সন্মান জানিয়ে সরকারি কর্মীদের ন্যায্য অধিকার যদি সরকার মিটিয়ে দেয়ে তাহলে রাজ্যের গরীব মানুষের ভয়ঙ্কর দুর্বিপাকের মধ্যে পড়বে। রাজ্যের মূল কল্যাণপ্রকল্পগুলো আর চালু রাখা সম্ভব হবে না। সম্পাদক ধরেই নিচ্ছেন জনকল্যাণ প্রকল্পের জন্য সরকার বছরে যে চল্লিশ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি খরচ করে তার থেকে ৩১ শতাংশ হারে বকেয়া ডিএ বাবদ ২৩,০০০ কোটি টাকা কেটে নিয়ে সরকারি কর্মীদের দেবেন। সরকারের পরিকল্পনা না জেনে আনন্দবাজার পত্রিকার এই আগাম অনুমান প্রমাণ করে যে তারা বেতনভুক সরকারি কর্মীদের সঙ্গে সাধারণ জনগণের বিরোধ বাধিয়ে দিয়ে গোপনে সরকারের পক্ষ অবলম্বন করার চেষ্টা করেছেন। অথচ সরকার মেলা, খেলা, উৎসবের নাম করে বছরের পরে বছর কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা অপচয় করছে সে বিষয়ে একটি বাক্যও আনন্দবাজার ব্যয় করতে চায় না। শুধু কি মেলা-খেলা, এই সরকার ক্লাব, পূজো কমিটিকে যে বিপুল পরিমাণ দানখয়রাতি করে, তাতে কি জনহিতকর প্রকল্প বাধাপ্রাপ্ত হয় না? সরকারি কর্মীদের আইনি এবং সাংবিধানিক অধিকারকে মেনে মহার্ঘভাতা মিটিয়ে দিলেই সব কল্যাণপ্রকল্প মুখ ধুবড়ে পড়বে? তাছাড়া নিরপেক্ষভাবে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সরকারের বেশিরভাগ প্রকল্প ভোটকেন্দ্রিক। ভোট তরণী পার হওয়ার জন্য জনগণকে উপঢৌকন দিয়ে তুষ্ট রাখার অভিপ্রায়ে বেশিরভাগ প্রকল্প চলে। কোনও প্রকল্পে স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি হয় না। শুধু একদল অনুগত উপভোক্তা সম্প্রদায় তৈরি করা ছাড়া সরকারের অন্য কোনও লক্ষ্য আছে কি?
পঞ্চমত, প্রবন্ধের শেষে সম্পাদক সরকারকে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন “মহার্ঘভাতা ইত্যাদির তর্ক অতিক্রম করে সরকারি কর্মীদের বেতনকে উৎপাদনশীলতার সঙ্গে যুক্ত করার পথ খোঁজা জরুরি।” এখানে প্রশ্ন হল সরকারি কর্মীরা উৎপাদনশীলতার সঙ্গে যুক্ত নয়, এ কথা কোথায় প্রমাণিত হল? রাজ্যের সিংহ ভাগ পড়ুয়া এখনও সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল। মিডিয়া যতই অপপ্রচার চালাক না কেন এখনও সরকারি বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ছাত্র-ছাত্রী জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের নাম উজ্জ্বল করছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অসংখ্য সরকারি প্রকল্প নিশ্চয় সরকার কর্মচারীরা সাফল্যের সঙ্গে কার্যকরি করছেন? এই সমস্ত সাফল্যকে কি উৎপাদনশীলতার আওতায় আসে না? আসলে আনন্দবাজার বাজার অর্থনীতি এবং কর্পোরেট পুঁজির ধারক ও বাহক। তারা নিজেদের pro-capitalist হিসেবে সদর্পে ঘোষণা করে। ফলে তাদের পক্ষে কর্মচারীদের সামাজিক সুরক্ষার কথা মাথায় রাখা সম্ভব নয়। তারা কর্মী নিয়োগে ‘হায়ার’ এবং ‘ফায়ার’ নীতিতে বিশ্বাসী হবেন এ বিষয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই তো বছর দুয়েক আগে আনন্দবজার তাদের ৪০ শতাংশ কর্মীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে। কারো কাছে কোনও দায় তাদের নেই। কিন্তু মুস্কিল হল সরকার তো আর কর্পোরেট সংস্থা নয়। ব্যবসা করা তার উদ্দেশ্য নয়। তাই ফায়দা খোঁজাও তার মূল লক্ষ্য নয়। আর সরকারি চাকরি কোনও ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভ করে নর। সামাজিক সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে সরকারি চাকরির সমস্ত সুযোগ সুবিধাগুলো নির্ধারিত হয়েছিল অনেক যুগ আগে। তাই বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে সরকারি সংস্থাকে গুলিয়ে দিয়ে সরকারি কর্মীদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়া তোলার অপচেষ্টা বন্ধ করার জন্য আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব। মনে রাখবেন সরকার কর্মীদের হাতে অর্থ এলে তা স্বাভাবিক নিয়মে বাজারেরই ফিরে যাবে। এতে দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। বাজার গতিশীল হবে। চাঙ্গাও হবে। ফলে সরকারি কর্মীদের সামাজিক গ্রহণযোগ্য শূন্যতে মানিয়ে এনে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করলে আখরে সমাজের ক্ষতিই হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.