বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
“সে ছিল সব চাইতে সেরা সময়, সে ছিল সব চাইতে খারাপ সময়” — এই অবিস্মরণীয় বাক্য দিয়ে চার্লস ডিকেন্স শুরু করেছিলেন তাঁর উপন্যাস, ‘আ টেল অব টু সিটিজ়।’ আজ সেই বাক্যটাই মনে ভেসে উঠছে না কি? আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে ধর্ষণ-হত্যা কাণ্ড দেখাল, ক্ষমতাসীনকে পথ ছেড়ে দিলে সে দেশকে কোন অতলে নামাতে পারে। ব্যালট কাগজে অবাধে ছাপ্পা দিতে দিতে নেতারা যেন ধরেই নিয়েছে, মেয়েদের শরীরেও ক্ষমতার ‘ছাপ্পা’ দেওয়া চলে। ম্যানেজ করা এমন কিছু ব্যাপার নয়। আমরা যে একটা নির্বাচিত সরকারকে এত দূর যেতে দিয়েছি, অনেক আগেই রুখে দাঁড়াইনি, এই আত্মগ্লানি দগ্ধে মারছে আমাদের। নিহত চিকিৎসকের বাবা-মায়ের মুখের দিকে চেয়ে একটা জাতির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছে। বাঙালি যেন আজ কাঙালের চাইতেও কাঙাল, মৃতের চাইতেও মৃত। এখন কুমোরটুলিতে বায়না কমেছে, পুজোর বাজারে গ্রহণ লেগেছে — এই অশৌচ কেবল সন্তানবিয়োগের সন্তাপে নয়, নিজেদের মনুষ্যত্ব-বিয়োগের শোকে।
আবার, ভস্মের থেকে ফিনিক্স পাখির ফের বেঁচে ওঠার মতোই, ভূলুণ্ঠিত নাগরিক সমাজ আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। ক্ষুদ্র স্বার্থ, তিক্ত রেষারেষির জেরে যারা বিচ্ছিন্ন, বিষণ্ণ জীবন কাটাচ্ছিল, অসহ্য বেদনার মধ্যে ফের তারা টের পেল, তারা আদতে এক, অভিন্নহৃদয়। বাংলা, তথা বিশ্বের পথে পথে ঐক্যের সেই শক্তি দেখা গেল। মহাত্মা গান্ধীর জন-আন্দোলনেও এত মানুষ এক সঙ্গে, এত দিন ধরে, এমন শান্তিপূর্ণ কিন্তু উদ্দীপ্ত প্রতিবাদে রাস্তায় নামেনি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনও শ্রেণী-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলার সব মানুষকে এতখানি বিচলিত করেনি। যে জনস্রোত দেখেছে কলকাতা এ ক’দিন, যত মিছিল, সমাবেশ, মানবশৃঙ্খল, রাত দখলের পালা দেখেছে, তার তুলনা অতীতে পাওয়া যাবে না। আরও আশ্চর্য, এই নাগরিক আন্দোলনের সামনে কোনও মুখ নেই। অন্না হজারের মতো কোনও সমাজকর্মী নেই, নেই শঙ্খ ঘোষের মতো সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবি, অথবা কোনও জনপ্রিয় তারকা। যাঁরা সমাবেশের ডাক দিচ্ছে, সংগঠন করছে, পোস্টার আঁকছে, গান গাইছে, তারা পাড়ার মেয়ে, পাড়ার ছেলে। টিভিতে বা সমাজমাধ্যমে তাদের কথাগুলো জোরালো বলে মনে হচ্ছে এই জন্যই যে, সেগুলো সবার মনের কথা। এই সমস্বরের সামনে দলীয় রাজনীতির বাক্যবাগীশরা হালে পানি পাচ্ছে না। মুখপাত্রহীন এক আন্দোলন গণ-আলোচনার বিষয় নির্ধারণ এবং বয়ান রচনার ক্ষমতা দখল করেছে নেতাদের থেকে।
এই তো সেই “আত্মশক্তির উদ্বোধন” যার কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এই তো সেই জনজাগরণ যার স্বপ্ন দেখেছেন বিপ্লবীরা। ঘোড়সওয়ার নেতাজির মূর্তিকে দাঁড়িয়ে অতন্দ্র মানুষ, অজস্র আলোকবিন্দু — যেন গণতন্ত্রের দীপাবলী। এই ছবি কি বাঙালির সেরা পোর্ট্রেট নয়?
৯ অগস্ট, ২০২৪-এর পরদিন থেকে পশ্চিমবঙ্গে যে এক অভূতপূর্ব আন্দোলন শুরু হয়েছে, সেটা স্পষ্ট। তবে তার সবক’টি দিক হয়তো সমান স্পষ্ট নয়। আন্দোলনে প্রাধান্য পেয়েছে চিকিৎসক সমাজ, এবং মেয়েরা। সরকারি মেডিক্যাল কলেজে দুর্নীতি চক্রের ছবি সামনে এসেছে, চিকিৎসা ব্যবস্থায় দুর্বৃত্তদের দাপটের বহর দেখে সবাই বিস্মিত। পাশাপাশি, জুনিয়র ডাক্তার ও ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীরাই আন্দোলনে অগ্রণী। তাঁরা লাগাতার কর্মবিরতি করেছেন, লালবাজার অভিযান করেছেন। সিনিয়র চিকিৎসকরাও যোগ দিয়েছেন। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপের কাছে তাঁরা নতিস্বীকার করেননি, এখনও অবধি আর জি কর হাসপাতালের অচলাবস্থা কাটেনি। ফলে এই আন্দোলনের কেন্দ্রে রয়েছেন চিকিৎসকরা।
পাশাপাশি, রাত দখল আন্দোলন বিশেষ ভাবে আলো ফেলেছে মেয়েদের উপর। মেয়েদের ডাকে সাড়া দিয়েই আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ এক জন-আন্দোলন হয়ে উঠল। শিশু থেকে বৃদ্ধ, ধনী থেকে দরিদ্র, সকলেই মেয়েদের নিরাপত্তার দাবিতে বেরিয়ে এসেছে পথে। নারী আন্দোলন বাংলায় নতুন নয়, কিন্তু মেয়েদের কাজের অধিকার, সম্মানের অধিকারের সপক্ষে মেয়েরা যেমন শ্রেণি-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমর্থন আদায় করতে পেরেছে, সকলকে পথে নামতে উদ্বুদ্ধ করেছে, তা যে কোনও দেশের নিরিখে ব্যতিক্রমী। এই মেয়েরা ধর্ষণ সংস্কৃতিকে নির্ভুল ভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছে, সে কথা তাদের পোস্টার, স্লোগান, লেখালিখি থেকে স্পষ্ট।
তুলনায় এই আন্দোলনে শ্রমিকদের অংশিদারিত্ব, এবং শ্রমিক সংগঠনগুলির ভূমিকা তেমন ভাবে সামনে আসেনি। এমন নয় যে শ্রমিকরা এই আন্দোলনে অংশ নেননি। বরং যেমন ভাবে বিভিন্ন পেশার শ্রমিকরা এগিয়ে এসেছেন, শ্রমিক সংগঠনগুলির ডাকা কর্মসূচিগুলিতেও সচরাচর তেমনটা দেখা যায় না।
অ্যাপ ক্যাব এবং বাইক চালকরা গাড়ি, বাইক-সহ মিছিল করেন। বিভিন্ন ডেলিভারি পরিষেবার রাইডাররাও বাইক মিছিল বার করেন। কলকাতা বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরা নেতাজি সুভাষ ডকের সাত নম্বর গেটে বিক্ষোভ সভা করেন। ইছাপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি, ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরি-সহ প্রতিরক্ষা শিল্পের নানা কারখানার শ্রমিকরা মিছিল করেন, পুরোভাগে ছিলেন মহিলা কর্মীরা। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি এবং শিল্পভিত্তিক নানা ফেডারেশনের যৌথ মিছিল হয় ২০ অগস্ট। বিভিন্ন জেলায় শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুরদের নানা সংগঠন মিছিল করেছে। এই সব মিছিল থেকে আরজিকর কাণ্ডে দোষীদের শাস্তির দাবি করা হয়েছে। শাসকের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাবি তোলে শ্রমিকরা।
আরজিকর কাণ্ডের সূত্র ধরে যে আলোচনা সব চাইতে বেশি প্রাধান্য পাওয়ার কথা ছিল, রাজ্যের সব কর্মক্ষেত্রে, পথে-পরিবহণে, মহিলা শ্রমিক ও কর্মীদের বিপন্নতা। তরুণী চিকিৎসকের হত্যা যে কেবল কোনও কাম-উন্মত্ত ব্যক্তির কাজ নয়, তার ইঙ্গিত মিলেছে। কর্মক্ষেত্রে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে বিরোধের জন্যই সম্ভবত তাঁর উপর এমন আক্রোশ আছড়ে পড়ল। এই দুর্বৃত্তরাজ তো সর্বত্র। সরকারি ও অসরকারি, সংগঠিত ও অসংগঠিত, যে কোনও কর্মক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রশ্রয়প্রাপ্ত বাহুবলীদের দেখা পাওয়া যায়। তাদের জন্য যে কোনও কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের জন্য এক অসুস্থ, অসুরক্ষিত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এমনকি যে শিল্পে শ্রমিক সংগঠনগুলির উপস্থিতি যথেষ্ট, সেই চটকলেও কাজের পরিবেশ মেয়েদের জন্য নিরাপদ এবং সম্মানজনক নয়। বহু মেয়ে কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
অথচ, সম্প্রতি চটকল মালিক, সরকার এবং ট্রেড ইউনিয়ন যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করল, সেখানে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি আইন (২০১৩) মানতে অঙ্গীকার করার শর্ত রাখা হয়নি। আইন পাশের দশ বছর পার করেও, এবং রাতের শিফট-সহ সব শিফটে প্রচুর মহিলা নিয়োগ করেও, চটকলগুলি যৌন হয়রানিকে উপেক্ষা করে দিব্যি পার পেয়ে যাচ্ছে। শ্রমিক সংগঠনগুলো কেন মেয়েদের সুরক্ষার প্রতি চটকল মালিকদের দায়বদ্ধ করতে ব্যর্থ হল?
আর জি কর কাণ্ডের পর সকলে আতঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করছেন, যদি নিজের কাজের জায়গাতে, নিজের সহকর্মীদের মধ্যে মেয়েরা নিরাপদ না থাকে, তা হলে আর কোথায় থাকবে? এ প্রশ্নটা ইটভাটায়, খড়ি খাদানে, কল-কারখানায়, নির্মীয়মান বাড়িতে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করলে নিজের কানেই ফাঁপা ঠেকতে পারে। এমনকি সংবাদপত্রের দফতরে বা ফিল্মের স্টুডিওতে দাঁড়িয়েও বলা সহজ নয়। সম্প্রতি মালয়লম ফিল্মর কলাকুশলীদের মধ্যে তদন্ত করে দেখা গেল, বড় বড় তারকারাও ধর্ষণ সংস্কৃতি থেকে মুক্ত নন।
অনিতা অগ্নিহোত্রী তাঁর ‘কাস্তে’ উপন্যাসে দেখিয়েছেন, তীব্র গরমেও আখ-কাটুনি মেয়ে কয়েক পরত জামাকাপড় পরে শোয়। মত্ত ঠিকাদার জামা খোলার জন্য যে সময়টুকু নেবে, তার মধ্যে মেয়েটি চেঁচিয়ে লোক ডাকতে পারবে। পশ্চিমবঙ্গের নির্মাণ ক্ষেত্র থেকে তামিলনাড়ুর কাপড় কল, সর্বত্র মজুর মেয়ের উপর মালিক, ঠিকাদার, সুপারভাইজ়ার প্রভৃতির জুলুমের এই ছবি দেখা যায়। ধর্ষণ সেখানে ব্যতিক্রম নয়, কাজের শর্ত।
আর জি কর কাণ্ডের পরে শ্রমিক সংগঠনগুলি এই বিষয়টিকে সামনে আনতে পারত। যথেষ্ট আলো, যথেষ্ট শৌচাগার, বিশ্রামের ঘর, সিসিটিভি, যৌন হয়রানি প্রতিকারের কমিটি নির্মাণ, এগুলির জন্য মালিককে দায়বদ্ধ করার কথা ছিল তাদেরই। বিচ্যুতি হলে সরকারের নজর টানাও তাদেরই কাজ। আক্ষেপ, শ্রমিক নেতারা ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ বললেন শুধু, সব কর্মক্ষেত্রে সব মেয়ের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারের কথাটা তুললেন না। মোমের শিখার চারপাশে অনেকটা অন্ধকার রইল।
অতএব পথ দখলের প্রতীকী প্রতিবাদে আটকে না থেকে, মেয়েদের দখল করতে হবে ভাটা, খাদান, কারখানা, বাগিচা, দফতর। বিভিন্ন আইন ও বিধিতে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের সুরক্ষার যে নির্দেশ আছে, সেগুলি কাজে পরিণত করা এই আন্দোলনের পরবর্তী ধাপ। যে মেয়েরা কাজ করেন রাস্তায়, বাজারে, গৃহস্থের বাড়িতে, তাঁদেরও সম্মানহানি রুখতে হবে। প্রতি জেলায় যৌন হয়রানির প্রতিকারের সরকার-নির্দিষ্ট কমিটি রয়েছে। টাকার অভাবে, লোকের অভাবে সেগুলো অকেজো। অথচ, ন্যায় চাইলে বিচারের প্রতিষ্ঠানও চাই। গণ-আন্দোলনের উত্তেজনা কমে যাওয়ার পরেও মেয়েরা তাদের প্রতি প্রতিকূল স্থানগুলিকে নিজেদের দখলে আনার লড়াই চালিয়ে যায় যদি, তা হলে নতুন ইতিহাস লেখা হতে পারে বটে।