বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

মেয়েদের ভোট

মেয়েদের ভোট

স্বাতী ভট্টাচার্য

photo

সামনে তো পঞ্চায়েত ভোট। আপনারা কী চান? প্রশ্নটা করতেই ঘর-ভরা মেয়ে সমস্বরে বলে উঠলেন, “কাজ। কাজ চাই আমরা।” সভার কথাবার্তার পরে যখন নিজেদের দাবি সনদ লেখার পালা এল, তখন বাগদার মেয়েরা লিখে আনলেন, “শুধু ডোল দান না, কাজ চাই।” আর একটি দলের প্রতিনিধি পড়লেন, “আমাদের সোনারপুর ব্লকে ব াচ্চাদের জন্য ক্রেশ দরকার যেখানে বাচ্চারা নিরাপদ থাকে এবং মায়েরা নিশ্চিন্তে কাজে যেতে পারে।” পাথরপ্রতিমা ব্লকের মেয়েরা তাদের তালিকার তিন নম্বরে লিখেছেন, “মেয়েদের কাজ (কারিগরী দক্ষতা প্রশিক্ষণ)।” সাত-আটটি ব্লকের নানা পঞ্চায়েত থেকে যত দাবি সনদ এল, তার প্রতিটিতে কাজের দাবি। কেউ বাড়িতে বসে কাজের সুযোগ দাবি করেছেন, কেউ হাতের কাজের ট্রেনিং চেয়েছেন, কেউ চেয়েছেন পুরুষদের সমান কাজ করলে সমান মজুরি।
অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি এক দুপুরে বাসে-ট্রেকারে-ট্রেনে কলকাতায় এসে, শিয়ালদহ থেকে পায়ে হেঁটে প্রায় দু’শো মেয়ে জড়ো হয়েছেন বৌবাজারের ভারত সভা হলে। কত প্রাচীন এই প্রেক্ষাগৃহ, ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে কত গভীর তার যোগ। সেখানে এই মেয়েরা যে সব দাবি লিখে আনলেন, তাতে চোখ বোলালেই বোঝা যায়, স্বাধীনতার যুদ্ধ এখনও ঘরে ঘরে, গ্রামে গ্রামে চলছে। ‘পঞ্চায়েত থেকে আমাদের হুমকি দেওয়া হয়, এটা থামানো হোক,’ লিখেছেন কুলপি ব্লকের ঢোলা আর শিমূলবেড়িয়ার মেয়েরা। ‘পাড়া বৈঠকের মিটিং সঠিক ভাবে করতে হবে,’ লিখছে বনগাঁ ব্লকের কালুপুরের মেয়েরা। ‘আমরা মহিলারা যেন সম্মানে সহিত মাথা উঁচু করে চলতে পারি।’ একাধিক দাবিপত্রে নালিশ পাওয়া গেল, ‘সংসদ মিটিং আমরা জানতে পারি না।’
কী চায় মেয়েরা? মেয়েরা কাজ করে ন্যায্য মজুরি চায়, নিজের খেতের ফসল, নিজের তাঁতে তৈরি কাপড়ের ন্যায্য দাম চায়। নিজেদের কথা যাতে বলতে পারে পঞ্চায়েতে, ব্লক অফিসে, যাতে ধমক খেয়ে অপমানিত হয়ে ফিরতে না হয়, তা-ও চায়। অবশ্যই তারা চায় পরিকাঠামোর উন্নয়ন — সে দিন সাদা চার্ট পেপারে কালো কালির মোটা পেন দিয়ে লেখা দাবি সনদগুলোর প্রায় সবক’টাতে ছিল ভাল রাস্তা (গ্রামের ভিতরের বহু রাস্তা এখনও পাকা হয়নি), পানীয় জল (এখনও ভরা কলসি-বালতি বয়ে আধঘন্টা, পৌনে এক ঘন্টার পথ হাঁটতে হয় বহু মেয়েকে)।
বাংলার যে কোনও গ্রামে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে কথা বললে এমন ধরনের কথাই কানে আসে। নিজেদের পরিচয় তাঁরা দেন খেতমজুর, দিনমজুর, ছোট ব্যবসায়ী, নানাবিধ সরকারি প্রকল্পের স্থায়ী বা অস্থায়ী কর্মী, ব্যাঙ্ক-সমবায়ের গ্রাহক, স্বনির্ভর দলের সদস্য। অথচ দলীয় রাজনীতি যে ডিসকোর্স তৈরি করেছে, যা প্রায় নির্বিচারে গ্রহণ করেছে মিডিয়া, সেখানে মেয়েদের প্রধান পরিচয়, তারা ‘বেনিফিসিয়ারি’ — সরকারি প্রকল্পের গ্রাহক। তারা সেই কাকের দল, যারা ঝাঁকে ঝাঁকে ভিড় করে আসে নেতাদের ছড়ানো ভাতের অপেক্ষায়। ড্রয়িং রুম থেকে নিউজ় রুম, কোথাও কেউ এক বারও উল্লেখ করে না যে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্পে যাদের নাম উঠেছে, যারা রাজকোষ থেকে পাঁচশো কি হাজার টাকা করে পায়, সেই মেয়েদের অধিকাংশই কেবল ওই টাকার অপেক্ষায় গালে হাত দিয়ে বসে নেই। তারা তাঁত বোনে, ধান কাটে, বিড়ি বাঁধে, চা পাতা তোলে, লটারির টিকিট বেচে, দোকান চালায়, রাজমিস্ত্রির হেল্পার হয়ে ইঁট-সিমেন্ট বয়, বাগদার মিন ধরে, সব্জি বেচে, ইটভাটা-কয়লা খাদান-খড়ি খাদানে মজুরের কাজ করে। একশো দিনের কাজ পেলে মাটি কাটে, গাছ লাগায়, কিন্তু গত এক বছর সে কাজ পায়নি। মিড ডে মিল কর্মীরা একশো-দেড়শো ছেলেমেয়েকে খাওয়ায়, আশা কর্মীরা মাঝরাতে প্রসূতি নিয়ে হাসপাতালে ছোটে। তারপর তো রয়েছেই এ রাজ্যে মেয়েদের বৃহত্তম নিয়োগক্ষেত্র — গৃহপরিচারিকার কাজ।
এই মেয়েদের রোজগারের সিকি ভাগ থেকে অর্ধেক চলে যায় ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ মেটাতে। আরও অনেকটা যায় স্বামীর নেওয়া ঋণ, বাড়ি সারানোর ঋণ, আরও হাজার কাজে নেওয়া ঋণ শোধ করতে। বহু পরিবারের পুরুষরা পরিযায়ী শ্রমিক, আরও অনেক পরিবারে তাঁরা কাজের জন্য অনেকগুলো দিন থাকেন বাইরে, না হলেও বাইরে থাকেন দিনের অধিকাংশ সময়। থাকলেই বা কী — স্কুলপড়ুয়া বোন দিনে চারবার এক কিলোমিটার দূরের টিপকল থেকে জল ধরে আনবে, তার বেকার দাদা বসে তাস পিটবে, এতে কেউ আশ্চর্য হয় না। বাইরের কাজ, ঘরের কাজ মিলিয়ে প্রায় একা হাতে সংসার চালায় বাংলার গ্রামের মেয়েরা। জীবন-জীবিকার নিরিখে তাদের একটা মস্ত অংশ আসলে ‘সিঙ্গল মাদার।’ প্রদীপের তলার পিলসুজের মতো এই মেয়েরা নিজেদের মাথায় ধরে রেখেছে ভারতের ‘ইকনমিক গ্রোথ’-এর রূপকথা। তবু শিক্ষিত শহুরে লোকেরা নালিশ করে, গরিব মেয়েদের অনুদান দিতেই সরকারের সব টাকা চলে গেল, উন্নয়নের জন্য কিছুই রইল না। তাদের কাছে উন্নয়ন মানে বড় শিল্প, বড় অঙ্কের মাইনের বাঁধা চাকরি।
যেখানে কাজ করে গ্রামের অধিকাংশ মেয়ে, সেই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কী করে যথেষ্ট কাজ, যথাযোগ্য মজুরি, কর্মীদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধের জোগান নিশ্চিত করা যায়, সে প্রশ্ন যত বার তোলা গিয়েছে, তত বার উত্তরে মিলেছে কোনও না কোনও প্রকল্পের নাম। পেনশন, ভাতা, বিমা, অনুদানের অমুক প্রকল্প, তমুক প্রকল্প। মেয়েদের মৌলিক দাবিগুলোর সঙ্গে সরকারি প্রকল্পের সম্পর্ক কী, সে কথাটা কেউ জানতেও চায় না, চাইলে উত্তরও মেলে না। এ সব প্রকল্প যত দেখি, ততো আনন্দবাজার পত্রিকার দফতরের একটা সত্যি-গল্প মনে পড়ে। তিন তলার বারান্দার জলের মেশিন থেকে এক দিন বোতল ধরতে গিয়ে দেখি, জল বেরোনোর সরু নালীতে মুখ দিয়ে জল খাচ্ছে একটা কাক। ব্যাপারটা অস্বাস্থ্যকর, তাই ফোন করলাম দেখভালের ভারপ্রাপ্ত দফতরে। ওপার থেকে প্রশ্ন ভেসে এল, “আপনার পায়ের কাছে দেখুন। একটা নীল প্লাস্টিকের চৌকো ট্রে-তে জল আছে, দেখতে পাচ্ছেন?” ট্রে আছে, জলও আছে, জানাতেই এল মোক্ষম প্রশ্নটি, “ওটা কাকের জন্য। কাক কেন ওটা থেকে জল খাচ্ছে না?” মুখে উত্তর জোগাল না। এ বার শেষ প্রশ্ন, “জানেন না তো? তা হলে আমরাই বা কী করে জানব, বলুন?”
সম্প্রতি পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি ও ঝালদা শিশু-অপুষ্টি নিয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে শুনলাম ‘প্রজেক্ট উত্থান’-এর কথা। কোভিডে অপুষ্ট শিশু প্রচুর বেড়ে গিয়েছে দেখে জেলাশাসকের দফতর থেকে অতি-অপুষ্ট শিশুদের মায়েদেরকে দেওয়া হয়েছিল পেঁপের চারা, হাঁসের ছানা, সবজির বীজ। সে কথা বলতে গিয়ে হেসে কুটোপাটি হচ্ছিল এলাকার জনাকয়েক তরুণ-তরুণী। “ভেবে দেখুন দিদি, ওই গাছে ফল ধরবে, ওই হাঁস ডিম দেবে, তবে বাচ্চা খাবে। ও তো তদ্দিনে মরেই যাবে।” হয়তো মায়েদের দীর্ঘমেয়াদী রোজগারের কথা ভেবে এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন আধিকারিকরা। কিন্তু তাতেও প্রশ্ন থাকে — খেতের কাজে, মিস্ত্রির কাজে বেরোতে হয় বলে তিন বেলা শিশুসন্তানকে ভাত-ডাল খাওয়ানোর সময় করতে পারে না যে দিনমজুর, খেতমজুর মেয়ে, সে কী করে সবজি বাগান, ফলের বাগান, হাঁসের প্রতিপালন করবে? এলাকার আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, মায়ের সময়ের অভাবই যে শিশু অপুষ্টির কারণ, এটা যে তাঁরা বোঝেন না, তা নয়। কিন্তু তাঁদের হাতে দেওয়ার মতো যা রয়েছে, তা হল গাছের চারা, হাঁসের ছানা। অতএব সেটাই তাঁরা রেখেছেন পরিকল্পনায়।
যে আদিবাসী মায়ের নাম উঠেছে লক্ষ্মীর ভান্ডারে, বাড়তি হাজার টাকা পাওয়ায় তার অপুষ্ট শিশুর ওজন বাড়বে, এমন আশা করা কঠিন। কারণ সেই মাকে রোজগারে বেরোতেই হবে, শিশুকে নামমাত্র দেখাশোনা করবে বাড়ির বৃদ্ধরা, কিংবা একটু বড় দাদা-দিদিরা। সারা দিন সেই শিশু ধুলোয় খেলবে। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে কি ওই শিশুদের আরও বেশি সময় রেখে তিন বার খাওয়ানো যায় না? “তা হলে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা তো বেশি টাকা চাইবে,” বললেন এক বিডিও। এ দিকে অঙ্গনওয়াড়ি চলে মাত্র দেড়-দু’ঘণ্টা, শিশুকে রেখে দিয়ে আবার নিয়ে যাওয়ার ঝামেলা পোষায় না মায়েদের। তার ওপর অধিকাংশ দরিদ্র এলাকায় অঙ্গনওয়াড়িতে কর্মী কম, নজরদারি কম, তাই প্রাক-প্রাথমিকের পড়াশোনা হয় না। খাবার মানও তথৈবচ — সবজির জন্য মাথাপিছু দশ পয়সা বরাদ্দ, তাতে আলুর ঝোল ছাড়া তেমন কিছু মেলে না। খিচুড়িতে ডালের অভাব ঢাকতে অনেকটা হলুদ গুলে দেন রান্নার কর্মীরা। মায়েরা বরং মাসে দুশো-আড়াইশো টাকার নার্সারি স্কুলে পাঠান শিশুদের, পিঠের ব্যাগে ক্রিম বিস্কুট, টিফিন কেক-এর প্যাকেট ভরে দেন, যেগুলোতে চিনি বেশি, প্রোটিন সামান্য, অতএব অস্বাস্থ্যকর। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে আসার সব চাইতে বেশি প্রয়োজন ছিল যে শিশুদের, তারা কেন্দ্রেই আসে না। কেন অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পের মতো ১৯৭৫ সাল থেকে চালু থাকলেও শিশুর অপুষ্টি দূর হয় না?
পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের জন্য অপর যে প্রকল্পটি সর্বাধিক প্রচারিত, কন্যাশ্রী, সে-ও কিন্তু তার প্রধান দুই লক্ষ্য (নাবালিকা বিবাহ রোধ, অকালমাতৃত্ব নিবারণ) পূরণে ব্যর্থ, সরকারি সমীক্ষাই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। পূর্ব মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমানের মতো অগ্রসর জেলাতেও নাবালিকা বিবাহের হার বেড়েছে (জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা, ২০১৯-২০)। কেন পঁচিশ হাজার টাকা, স্কুল-পাশ সার্টিফিকেট, সব কিছুর হাতছানি অগ্রাহ্য করে বেশ কিছু কিশোরী পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করছে? এ সব প্রশ্ন করলে নেতা-আধিকারিকদের থেকে উত্তর মেলে, “আমরা তো ব্যবস্থা করেই রেখেছি, ওরা নেয় না কেন?” একই কথা প্রতিধ্বনিত হয় ড্রয়িং রুমে, নিউজ় রুমে। যেন গরিব মেয়েরা একটা অন্য প্রজাতি, তাদের কাজের মাথামুন্ডু খোঁজার মানেই হয় না। যেন সরকারের জোগান দিয়ে মানুষের চাহিদা ঠিক হবে। যেন এ দিক দিয়ে প্রকল্পের মেশিনে টাকা গুঁজে দিলে ও দিক দিয়ে মানব উন্নয়নের পরিসংখ্যান-প্যাকেজ বেরিয়ে আসবে। জামার মাপে মানুষ, জুতোর মাপে পা — এমনই যেন হওয়ার কথা।
গরিব মেয়েকে ‘পাইয়ে দেওয়া’-র চাট্টি প্রকল্প মাঠে নামিয়ে দিলেই মেয়েরা দলে দলে গিয়ে ভোট দেয়, এই কথা এত সহজে বলা যায়, কারণ গরিবকে, মেয়েকে, অপমান করা শহুরে শিক্ষিতদের চিরকালের অভ্যাস। এ বদভ্যাস সকলেরই, তবে রাজনীতি নিয়ে আলোচনার ফ্রেমটা শহরেই ঠিক হয় বেশি। অনেকে প্রশ্ন করবেন, তবে কি বলতে চান, অনুদানের টাকার প্রতি মেয়েদের কোনও আগ্রহই নেই? এত বড় বড় লাইন করে তারা দাঁড়ায় কেন তবে? অবশ্যই মেয়েরা আগ্রহী টাকা পেতে — কে-ই বা নয়? অভাবী সংসারে এক হাজার টাকার ক্রয় ক্ষমতা অনেক। দলিত-আদিবাসী মেয়েটির হাতে প্রতি মাসে টাকা আসে জানলে পাড়ার দোকান তাকে ধারে তেল-নুন দেয়, সে ভরসাটার দামও কম নয়। কিন্তু যে ভাবে ভোটের আগে মদ-মাংস খাওয়ানো, হাতে টাকা গুঁজে দেওয়ার পালা চলে, তেমন করেই কি লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকাকে দেখা চলে? নেতারা তাই দেখেন — যে মেয়েরা লক্ষ্মীর ভান্ডারের তালিকা আছেন তাঁদের মিটিং-এ আসতে হবে, শাসক দলের পক্ষ থেকে এমন একটা চাপ তৈরি হয়েছে সারা রাজ্যে। তবে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, এই টাকার তাৎপর্য তাদের কাছে অন্য। সচ্ছল পরিবারও বধূকে তার নিজের মতো করে খরচ করার টাকা দিতে চায় না। সে গৃহকর্ত্রী হলেও তাকে পরিবারের প্রধান ব্যক্তির স্বীকৃতি দেয় না। যে সম্মান সংসার-সমাজ দেয়নি, রাষ্ট্র যে মেয়েদের সেই সম্মান দিচ্ছে মেয়েটির নামে পরিবারের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড করে, কিংবা মেয়েটিকে হাতখরচের টাকা দিয়ে, সেটা সক্ষমতার একটা বোধ তৈরি করেছে। আমার মূল্য কতটুকু — আজও মেয়েদের এই প্রশ্ন করতে হয় নিজেকে। কন্যাশ্রী বা বিধবা ভাতার টাকা মেয়েটিকে আত্মপ্রত্যয় দেয়, সান্ত্বনা-সাহস জোগায়। তাই ওই টাকার মূল্য মেয়েদের কাছে অনেক। তবু টাকার দিয়ে মেয়েদের ভোট কেনা যায়, এ কথা মানা কঠিন। কারণ, তা হলে মেয়েরা নিজেদের ভোটের দাম আরও বাড়াতে চাইত। অথচ, আজ অবধি মেয়েদের কোনও সভায়, কোনও মিছিলে, এমন দাবি শুনিনি যে কন্যাশ্রী বা লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা বাড়ানো হোক। বা নতুন নতুন ভাতা দেওয়া হোক। বরং ন্যূনতম মজুরি, বকেয়া মজুরি, মাতৃত্বের ছুটি, পুলিশের বা মালিকের হয়রানি বন্ধের দাবি নিয়ে বারবার রাস্তায় নামতে দেখি মেয়েদের। সে দিন ভারত সভাতে অবশ্য ভাতার দাবিও উঠেছিল। কুলপি ব্লকের মেয়েরা লিখেছিল, “গরিব, অসহায় মানুষের বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা চাই।” বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা (দুটোরই অঙ্ক মাসে ১০০০ টাকা) গরিবের জন্য পেনশন বলতে পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড বলতে প্রভিডেন্ট ফান্ড। মদ-মাংসের ভোজের সঙ্গে কি এর তুলনা হয়?
বাগদা ব্লকের মেয়েদের তালিকায় দশটি দাবি আছে। তার প্রথম, “সম কাজে সম মজুরি চাই।” আর চার নম্বরে, “মদের লাইসেন্স বন্ধ করা হোক।” মেয়েরা চায় অনেক কিছু, কিন্তু যে জন্যে গ্রামের মেয়েরা রাস্তায় নেমেছে সব চাইতে বেশি, তা হল মদের ভাটি ভাঙা। এমন কোনও কোনও মহকুমা-ব্লক নেই, যেখানে মেয়েরা একজোট হয়ে মদের ভাটি ভাঙেনি। এই একটি দাবিতে মেয়েরা সর্বত্র সোচ্চার, ভারতে বড় বড় আন্দোলন হয়ে গিয়েছে মদের বিরোধিতায়। কী ভাবে এই দাবি মিটিয়েছে রাজনীতি? বিহারে নীতীশ কুমার মদ বন্ধ করে দিয়েছেন ২০১৬ সালে, মেয়েদের ভোটের জন্য। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১৮ সালে মদ বিক্রি থেকে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্দেশে নিগম তৈরি করেছে, যে কোনও খুচরো বিক্রেতাকে মদ কিনতে হয় সেই নিগমের থেকে। বেসরকারি মদের দোকান খোলার লাইসেন্স দিতে সরকার আগ্রহী বলে রাজ্যে মদের দোকান বেড়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। সরকারি নিগম এ বার ‘ফ্র্যাঞ্জাইজ়ি’-র মাধ্যমে দোকান খুলবে, তার তোড়জোড়ও চলছে। ২০২২-২৩ সালে ষোল হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি রাজস্ব মিলবে মদ থেকে, মনে করছে রাজ্য সরকার। ওই একই বছর লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের জন্য খরচ হবে প্রায় তেরো হাজার কোটি টাকা, কন্যাশ্রী ও রূপশ্রী মিলিয়ে আড়াই হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। মদ থেকে রোজগার, আর মেয়েদের অনুদানে রাজ্য সরকারের খরচ, দু’টো অঙ্ক কাছাকাছি।
এই হিসাবটা মেয়েদের অনুদান নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। মদ্যপায়ীদের মত্ততার জন্য মেয়েদের উপর ঘরে-বাইরে যে নির্যাতন হয়, যত রোজগার নষ্ট হয় পরিবারের, সন্তানদের শিক্ষার যে ক্ষতি হয়, রাস্তায় বিপদের ভয়ে তরুণী মেয়েরা শিক্ষা-প্রশিক্ষণের যে সুযোগ হারায়, মাসিক পাঁচশো কি হাজার টাকার ভাতাকে তার ক্ষতিপূরণ বলতেও লজ্জা লাগে। তেমনই যখন দেখি, ন্যূনতম মজুরি বা সম কাজে সম মজুরি আইনে থাকা সত্ত্বেও সারা রাজ্যে খেতমজুর বা নির্মাণ শ্রমিক মেয়েরা পুরুষের থেকে ৫০-১৫০ টাকা দৈনিক কম পায়, তাঁতি মেয়ে, দর্জি মেয়ের ‘পার পিস’ কাজের মজুরি আগের চাইতে কমেছে, তখন ‘অনুদান কী ও কেন’ প্রশ্নটা নিয়ে ফের চিন্তা করতে হয়। যদিও বরাদ্দ টাকার নিরিখে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের বাজেট পুলিশ বা নগর উন্নয়ন দফতরের বাজেটকে ছাড়িয়ে যায়, তবু সত্যিই কি তা খুব বেশি টাকা? ঠিকাদার-পাইকারদের হাতে মেয়েদের মজুরি ছেড়ে দিয়ে সাক্ষীগোপাল সেজেছেন নেতা-আধিকারিকরা। মেয়েরা ন্যায্য মজুরি, সমান মজুরি পেলে বাজার থেকে যে টাকা রোজগার করত, তার অঙ্ক সব সরকারি অনুদানের মিলিত অঙ্কের চাইতে বহু, বহু গুণ বেশি দাঁড়াত। আর ভারতের যত মেয়ে কাজ চায়, তত মেয়ে যদি সত্যিই কাজ পেত, তা হলে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) বৃদ্ধির হার ছাড়িয়ে যেতে পারত বিশ্বের সব দেশকে। বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করার, আইনের শাসন নিশ্চিত করার, সংসার-সমাজকে সাম্যময় করার সাহস বা ক্ষমতা সরকারের নেই। থাকবেই বা কী করে, ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো পুরুষতন্ত্রের ঘাঁটি। অতএব ক’টা টাকা বিলি করাই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজার পার্ট। অগত্যা প্রজার গায়ে জোর করে ভিখিরির সাজ চাপাতে হচ্ছে। নইলে কি এ নাটক চলতে পারে?
গরিব মেয়েরা নিজেদের জীবনের স্ক্রিপ্ট-এ কী লিখছে, তার নাগাল তেমন কেউ পায় না। তারা টিভি স্টুডিয়োতে ডাক পায় না, কাগজেও লেখা ছাপায় না, মিটিং-মিছিলে তাদের বয়ান ‘অমুক চাই তমুক চাই’-এর বেশি এগোয় না। অনেকে এক হলে দুঃখ করে বটে, “আমাদের কথা কেউ শোনে না” — সে দিন ভারত সভা হলে কথাটা বার কয়েক শোনা গেল — তা বলে গায়ে পড়ে অন্যকে নিজের কথা শোনাতেও যায় না। সময় কই? কত কাজ মেয়েদের। যদি কেউ গিয়ে পড়ে ওদের মধ্যিখানে, যদি নিজেদের মধ্যে ওদের ঝগড়া-খুনসুটি, হিহি হাসি আর চোখে আঁচল-চাপা কান্না পার করে, বারবার ‘তারপর কী হল’ প্রশ্ন করে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা কথার মধ্যে মনের কথা বলার ফাঁকটুকু করে দেয়, তখন এক এক করে অসম্ভব সব গল্প আসে সামনে। কত সামান্য সুযোগে কত অসাধ্য সাধন করে দরিদ্র মেয়েরা, সেই সব সত্যি-গল্প। পায়ের তলায় আরও জমি, হাতের নাগালে আরও একটু উপায়-উপকরণ থাকলে আরও কত সম্পদ তৈরি করতে পারত ওরা, তার আন্দাজ হয়। আর বোঝা হয়, এই মেয়েদের মূল্য কেবল তাদের ভোট দিয়ে গণনা করে যে রাজনীতি, তা কত দরিদ্র।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.