বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

তাঁতির মজুরি

তাঁতির মজুরি

নিলয় কুমার বসাক

photo

“দু’মাস যেতে না-যেতেই এমন মন্দা পড়ল যে, এখন সে যায় কোথায়? এক ধাক্কায় গদির মহাজনেরা কাপড়ের দাম দিল এতটাই কমিয়ে যে দাম কেটে মজুরি যা হাতে পায়, তাতে সংসার-খরচ কুলানো দায়। তার উপর আছে কর-ব্যাকর (বিপদ-আপদ)।” (তাঁতিপাড়ার আখ্যান, মনোহর বসাক)।
তাঁতির মজুরিতে এটাই বোধকরি একটা অলিখিত নিয়ম! সুতাসহ অন্যান্য কাঁচামালের দাম বাড়লে যেহেতু উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়, তখন বাজারে কাপড়ের দামকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে কোপ পড়ে মজুরিতে। কাঁচামালের দাম বাড়া-কমার ওপর স্থানীয় ব্যবসায়ী-মহাজনদের সরাসরি ভূমিকা থাকে না। অগত্যা মধুসূদন তাঁতির মজুরি।
দেশভাগের পর উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল ফুলিয়ার তাঁতপল্লী সমূহ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহকুমার বসাক তাঁতিদের বসতি স্থাপনের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের হস্তচালিত তাঁতশিল্পের জগতে আত্মপ্রকাশ করেছিল টাঙ্গাইল শাড়ি। ভিটে-মাটি হারিয়ে এই তন্তুবায় সম্প্রদায় নিজেদের তাঁত-বোনা বিদ্যাকে সম্বল করেই পারস্পরিক ও সামাজিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে গড়ে তুলেছিল এই তাঁতকেন্দ্রিক বসতি। মহাজনী-দাননি ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই তাঁতিরা নতুন করে সহায়-সম্বল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সবটাই হয়েছিল তাঁদের মজুরিকে ভিত্তি করেই। ও দেশ থেকে সকলেই এসেছেন প্রায় শূন্য হাতে। কারও কারও হাতে যদি বা যৎকিঞ্চিৎ কিছু ছিল, তা দিয়ে নতুন করে জমি-বাড়ির ব্যবস্থা করে তাঁতের কাজ আরম্ভ করা ছিল অসম্ভব। তা ছাড়া তাঁতবস্ত্র উৎপাদন-বিপনণের কাজ যৌথ-শ্রমবিভাজন ভিত্তিক যেখানে সামগ্রিকের বোঝাপড়া অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। ফলে কিছু কিছু অবস্থাসম্পন্ন তাঁতি, যাঁরা ও দেশ থেকে কিছু নগদ অর্থ হাতে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁরাই এখানে এসে জমি কিনে বাড়ি করে তাঁতিদের বসাতে থাকলেন; দিলেন তাঁত, দাদন। কাপড় বুনে তাঁতি পেল শুধু মজুরি। তাই দিয়েই চলল সংসারের ভরণপোষণ। ধীরে ধীরে জমি-বাড়ির ঋণ পরিশোধ করে তাঁতি পেল নিজের জমি-জায়গা-বাড়ি-তাঁতঘর। কেউ কেউ সামান্য পুঁজি জমিয়ে গড়ে তুললেন ‘নিজ্যা পুঁজি’র তাঁত, ব্যবসা।
দেশভাগের অব্যবহিত পর থেকেই টাঙ্গাইলের বসাক তাঁতিরা এ দেশে আসতে শুরু করলেও ব্যাপক হারে তাঁদের পরিব্রাজন শুরু হয়েছিল ষাটের দশকের পর থেকে। এ দেশে আসার পর তাঁতিদের মজুরি তথা সমগ্র তাঁতশিল্পের ওপর সম্ভবত প্রথম আঘাত আসে সাতের দশকে, ১৯৭২-৭৩ সালে। সেই সময় সুতার বাজারের সংকটকে কেন্দ্র করে সুতার দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছিল। মনে করা হয়, সুতার কারবারি পুঁজিপতি মহাজনদের দুরভিসন্ধিতেই সুতার কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছিল। সুতার খুচরো ব্যবসায়ী ও স্থানীয় মহাজনেরা চড়া দামে সুতা কিনতে বাধ্য হলেন। কাপড়ের উৎপাদন মূল্য বাড়ল। কিন্তু বিক্রয়মূল্য বাড়ল না সেই অনুপাতে। সঙ্গে হুজুগ উঠল, বাজারে কাপড়ের চাহিদা নেই। স্বভাবতই কোপ পড়ল মজুরির ওপর। অথচ এই মজুরিই ছিল উদ্বাস্তু তাঁতিদের বাঁচার লড়াইয়ের এক মাত্র রসদ। শুধু ফুলিয়া নয়, শান্তিপুর, নবদ্বীপ, সমুদ্রগড়, ধাত্রীগ্রামসহ পশ্চিমবঙ্গের হস্তচালিত বস্ত্রশিল্পের প্রায় অধিকাংশ কেন্দ্রগুলিতেই এই সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিল। অনেকে তাঁত ছাড়লেন, হাতেম-দপ্তি-টানা হাতে উঠল কোদাল-শাবল! অনেকে আবার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রওনা দিলেন বাপ-ঠাকুরদার ভিটেতে, নবগঠিত বাংলাদেশে। সেই সময় এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাঁতিরা সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন, সংগঠিত হয়েছিল তন্তুজীবী আন্দোলন। সুযোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে ফুলিয়ার তাঁতিরা নিজেদের দাবি আদায়ে সক্ষম হয়েছিল; গড়ে উঠেছিল টাঙ্গাইল তন্তুবায় সমবায় সমিতি, বন্ধ হয়েছিল মহাজনদের একচেটিয়া কারবার। বাজারে এসেছিল ভারসাম্য, তাঁতিরা পেয়েছিল ন্যায্য মজুরি। এর পর থেকে সমান্তরাল ভাবে চলেছে সমবায় ও মহাজনের ব্যবসা।
সমবায় হোক বা মহাজন তাঁতিদের কাপড়ের ভোল-বানা (ডিজাইন প্যাটার্ন) বুঝিয়ে দেন। তাঁতি সেই মতো কাপড় বুনে নিয়ে আসেন; বিনিময়ে পান মজুরি। পুঁজি অবশ্যই সমবায় বা মহাজনের। কিন্তু একটি শাড়ি তৈরি করতে যে সকল কাজগুলি করতে হয় তা একা এক জন তাঁতির পক্ষে সম্ভব নয়, সেখানে পরিবারের সকলেরই কম-বেশি ভূমিকা থাকে। মোটামুটি ভাবে বলা যায়, একটি শাড়ির পেছনে কমপক্ষে আড়াই জনের শ্রম প্রয়োজন হয়। টাঙ্গাইল শাড়ির উৎকর্ষতা নির্ভর করে তার সুতা প্রক্রিয়াকরণের ওপর। বাজার থেকে আনা সুতাকে পান্তাভাত, খই ইত্যাদির সাহায্যে মাড় লাগিয়ে লাটাই করে, চরকায় নলি পাকিয়ে শাড়ি তৈরির উপযুক্ত করে দিতে এক জন মহিলার সম্পূর্ণ শ্রমের প্রয়োজন হয়। গৃহস্থালীর সমস্ত কাজ করে তাঁতিবউকে এই কাজটি করতে হয় এবং কাপড় বোনার সময় প্রতিনিয়ত তাকে পোড়েনের সুতার যোগান দিয়ে যেতে হয়। অর্থাৎ তাঁতিকে তাঁত সচল রাখতে গেলে বাড়ির গৃহিণীকে সদা-সর্বদা সুতার যোগান দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু তাঁতির মজুরিতে তাঁতিবউয়ের মজুরির নির্দিষ্ট কোনও অংশ নেই। আবার বাড়ির ছোটো ছেলে বা মেয়েটিকেও পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে তাঁতের কাজের নানা খুঁটিনাটিতে হাত লাগাতে হয়। এই নিয়ে তাঁতি-সমাজের কেউ কোনওদিন মাথা ঘামায়নি। সমবায় ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরে শাড়ির দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘প্রস্তুতি’ নামে একটি অংশ রাখা হয়েছে। সেখানে মূল্য ধরা হয় মজুরির প্রায় অর্ধেক। আবার প্রস্তুতির মধ্যে সুতা প্রক্রিয়াকরণ ব্যতিরেকে অন্যান্য খরচও অন্তর্ভুক্ত। ফলে তাঁতির মজুরি মানে শুধু কাপড় বোনার মজুরি নয়, প্রকৃতপক্ষে তা আড়াই জনের শ্রমের মূল্য। এ বারে যদি দেড় বা দুই দিনে একটা কাপড় বুনে তাঁতি ৫০০ টাকা মজুরি পান তাহলে প্রকৃত পক্ষে তাঁতির একার শ্রমের মূল্য ২০০ টাকা, দিন প্রতি ১০০ টাকা। আবার সারা মাসে ২০-২২ দিনের বেশি কাজ হয় না। কারণ একটি টানা শেষ হলে নতুন করে টানা জোড়ার প্রস্তুতি শুরু করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সাত থেকে দশ দিন, বিশেষ ক্ষেত্রে দুই সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় লাগে। এই সময় তাঁতির ও তাঁতিবউয়ের শ্রম কেবলমাত্র উৎপাদনের প্রস্তুতির জন্য। এই সময় কালে কোনও আয় তো নেই-ই বরং অতিরিক্ত কিছু খরচ হয়। এই রকম বিরতি তাঁতিকে বছরে চার-পাঁচ বার দিতেই হয়। এর সঙ্গে আরও কিছু কর্মহীন দিন যোগ করলে দেখা যায় বছরের এক-চতুর্থাংশ সময় তাঁতির কোনও আয় থাকে না।
তবুও মজুরির এই নিয়মকে ভরসা করেই এগিয়েছে ফুলিয়ার তন্তুবায় সমাজ। স্বচ্ছল না হলেও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অতিবাহিত হয়েছে তাঁদের। কিন্তু বর্তমানে আবার সেই পূর্ব পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটছে। মূল কারণ যন্ত্রচালিত তাঁতের আগ্রাসন। পাওয়ার লুমে অতি সহজেই হস্তচালিত তাঁতের চার গুণ উৎপাদন করা যায়। সেখানে সুতার প্রক্রিয়াকরণেরও প্রয়োজন হয় না। তাঁতি শ্রমিক হিসাবে শাড়ি প্রতি মজুরি পেয়ে যান। হ্যান্ডলুম ও পাওয়ার লুমের শাড়ির মধ্যে যে গুণগত ফারাক, সাধারণ ক্রেতা সমাজ সে দিকে নজর না দিয়ে সস্তায় শাড়ি পেয়েই খুশি হলেন। সব থেকে মজার ব্যাপার, পাওয়ার লুমের শাড়ি বাজারে বিক্রি হল হ্যান্ডলুম নামে। স্বভাবতই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ল প্রকৃত হাতের তাঁতের শাড়ি। কোপ পড়ল মজুরিতে।
বর্তমানে বাজারে থাবা বসিয়েছে র‍্যাপিয়ার মেশিন, সুরাটের সস্তার সিন্থেটিক শাড়ি। অবস্থা এমন এসে দাঁড়িয়েছে যে ২৫০ টাকার সুতির (?) বুটিদার নকশা পাড় শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে যেখানে একটি সাধারণ সুতির টাঙ্গাইল শাড়ি বয়নের নূন্যতম মজুরিই ৪০০ টাকা। ফলে হাতের তাঁত আজ অন্তর্জলি যাত্রায়। শতকরা ২০ ভাগ তাঁত আজ টিকে আছে কি না সন্দেহ। যে কয়টি তাঁত চলছে সেখানেও পলিয়েস্টার সুতার রমরমা। ২০১৬ সালের একটি ব্যক্তিগত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল যে ফুলিয়া তাঁতি পরিবারগুলির মধ্যে ৩৭ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় ৩০০০ টাকার কম। ৩৭.৫ শতাংশ পরিবারের আয় ছিল ৩০০০-৬০০০ টাকার মধ্যে আর বাকি ১১.৫ শতাংশের মাসিক আয় ছিল ১২০০০ টাকার বেশি। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের নিরিখে সেই অবস্থায় ইতর বিশেষ কিছু হয়নি, বরং কমেছে। প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে আর শীর্ষ সমিতির নিষ্ক্রিয়তায় সমবায় সমিতিগুলিরও আজ নাভিশ্বাস উঠে গেছে। ন্যায্য মজুরি তো পরের কথা, তারা সদস্যদের সারা বছর কাজই দিতে পারছে না। উপযুক্ত মজুরি না পেয়ে পেশা ছাড়ছেন তাঁতিরা। কেউ বা আজ নির্মাণ শ্রমিক, আবার কেউ ভিন রাজ্যে পাড়ি জমাচ্ছেন ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ তকমা এঁটে। পঞ্চাশ বছর আগে এই রকমই একটি পরিস্থিতিতে তাঁতিরা সংঘবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের দাবি আদায় করে নিয়েছিলেন। আজ আর আন্দোলনের উপায় নেই তাঁতিদের, নেই যোগ্য নেতৃত্ব। অগত্যা বিলুপ্তই বোধ হয় ভবিতব্য।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.