বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
আমাদের দেশ পরিচালনার জন্যে ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের যে ব্যবস্থা চালু আছে তা দেখিয়ে বলা হয় সংবিধান একটা রাজনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। অথচ সকলেই জানেন, দেশের অর্থনীতির রক্তের সঞ্চালক যারা অর্থাৎ শ্রমজীবীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও এদেশে টিকে আছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে। আর “বিশ্ব নারী দিবস” নিয়ে যতই সভা, অনুষ্ঠান ও উচ্ছাস ঝরে পড়ুক না কেন শ্রমজীবী মহিলাদের অবস্থা তো একেবারে তলানিতে। যদিও এবারেও আমরা শুনেছি, ভোটের তালিকায় মহিলার সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্বাচনের পরে হয়তো বলা হবে, নির্বাচনে মহিলাদের অংশগ্রহণ অতীতের রেকর্ড ম্লান করে দিয়েছে। এগুলোই হবে দেশের উন্নতির দৃষ্টান্ত।
কিন্ত বাস্তব অতি র্নিমম। আজ বিশ্বায়নের কর্পোরেট পুঁজি ব্যবস্থার অংশ হিসেবে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে এমনই পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে, শ্রমজীবীদের জীবন টিকিয়ে রাখাই এখন বিরাট চ্যালেঞ্জ। আর মহিলা শ্রমজীবীদের জীবনের শোষণ-বঞ্চনার মাত্রা অসহনীয়। আমরা যেমন এখন দাস সমাজ বা ইতালি-জার্মানির ফ্যাসিস্ত শাসনে নির্মম শোষণের ইতিহাস পড়ে শিউরে উঠি আগামী দিনেও আজকের বৈষম্যে ফিরে দেখে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিশ্চয়ই শিউরে উঠবে। বিশ্বায়নের আধিপত্যে দেশের পরিস্থিতি এতটাই সংকটে যে, বৈষম্যের শিকার শ্রমজীবীদের সংগঠিত হওয়া, ন্যূনতম শ্রম আইনের সুযোগ নেওয়া, রাজপথে আন্দোলনে সামিল হওয়া কিংবা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার ধর্মঘট করাও আজ আইনসম্মতভাবেই প্রায় অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। শুধু জাতীয়স্তরেই নয় রাজ্যেও একইরকম শাসকের আগ্রাসন চলছে শ্রমজীবীদের বিরুদ্ধে। শিল্প বিপ্লবের পর সভ্যতার বিকাশের বিবরণের অনুসারী হয়ে শ্রমজীবীদের যে অগ্রগতির অভিমুখী হওয়ার কথা তাও যেন পালটে যাচ্ছে।
ভোট আসছে। কিন্তু শ্রমজীবীদের জীবন-যাপনের ইস্যুগুলো অগ্রাধিকার পাচ্ছে কোথায়? প্রান্তিক মানুষরা কি কেবলই হয়ে থাকবে শাসকের পেয়াদা বাহিনীর জোগানদার। অথচ এযুগটা তো সামন্ততান্ত্রিক যুগ নয়!
বিশ্বায়নের জন্যে এখন সংগঠিত শিল্প-শ্রমিক সংখ্যা কম, অসংগঠিত শ্রমজীবীদের অংশ অনেক বেশি। এরাই আজ সব চেয়ে বঞ্চিত। শাসন ব্যবস্থা এমনভাবেই চলছে যার পরিণতিতে সাধারণ জনগণ ফতুর হচ্ছে। লুঠ-চুরি-প্রতারণার মতো জঘন্য সব কান্ডে ব্যস্ত শাসকেরা। রাষ্ট্র কাঠামোর অংশ পুলিশ-প্রশাসন সব শাসকের দলদাস। নিত্যনতুন কালাকানুনের সাহায্য নিয়ে শ্রমিক ছাঁটাই যেন খুব স্বাভাবিক ঘটনা, নিয়োগ নেই, পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা সব হিসেব ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কম মজুরিতে কাজ করিয়ে নিচ্ছে খোদ রাষ্ট্রই। শ্রমজীবীদের মতামত মূলহীন। রাজপথে যতই আভিজাত্য ও সৌন্দর্য উপভোগ করুন না কেন, ক্ষুধা-বেকারি-দারিদ্রে ছেয়ে যাচ্ছে দেশ। দেশি বিদেশি বৃহৎ পুঁজির মিডিয়া এসব চর্চায় আনে না। তারা পরিকল্পিতভাবে সত্য আড়াল করার চেতনাই নির্মাণের কাজ করে। কর্পোরেট পুঁজির টাকায় চলছে সরকার। বন্ডের টাকার রহস্য ফাঁস হওয়ায় তা পরিষ্কার করেছে।
অতি সম্প্রতি কংগ্রেসের “ন্যায় যাত্রা”র সময়ে দেখলাম, মুর্শিদাবাদে কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী গিয়েছেন বিড়ি শ্রমিকদের কাছে। জানিনা, কি বুঝলেন বা জানলেন। বিড়ি কারখানার পরিবর্তে এখন বিড়ি তৈরি হচ্ছে ঘরে ঘরে। কারখানার সময়কালে শ্রমজীবীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ছিল বেশি। আর এখন ৮৭ শতাংশই মহিলা শ্রমিক। মহিলাদের আঙুল সরু হওয়ার ফলে তাদের হাতে বিড়ির বাঁধন বেশ সহজ ও ভাল হয়। ব্যবসায়ীর মুনশীরা (যারা আবার অধিকাংশ শাসক দলের মাতব্বর) ঘরে ঘরে বিড়ি বাঁধার বরাদ দেয়। হাজার বিড়ি বাঁধলে ১৬০-১৮০ টাকা। মাসে মাসে প্রতিটি শ্রমিকের কাছ থেকেই কেটে রাখা হয় পঞ্চাশ টাকা — ষাট বছর বয়সের পর মাসে হাজার টাকার ফিরৎ দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে। যা অনেক ক্ষেত্রেই মেরে দেওয়া হয়। কেউ “বিড়ি বাঁধা” ছেড়ে “সুপারি কাটা”র কাজে চলে গেলে, এই পেশা বদলের খেসারত দিতে ওই টাকা আর তিনি পাবেন না। যেখানে যাবেন সেখানে পুনরায় নতুন করে টাকা কাটা হবে। এটা ঠিক যে একটু বেশি টাকা রোজগারের সন্ধান পেলে শ্রমজীবীরা পেশা পরিবর্তন করেন। পাশাপাশি আছে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা, এই তামাকের গুঁড়ো শ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে এমনকী অন্তঃসত্ত্বা মহিলার গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি করে। এসব কথাই সকলেই জানেন, অথচ সব কিছুই স্বাভাবিক চলছে। কুটির শিল্পে যুক্ত শ্রমজীবীদের মজুরিও দুর্মূল্যের বাজারে একেবারেই বেমানান। জরি, টিপ সহ সর্বত্র ছবির একই রকম। তবে তাঁত শিল্পের অবস্থা আলাদা। তৃণমূল রাজ্য সরকার বিশ্ববাংলার নামে মেসিন দিয়ে মসলিন সরু, ভারী সুতোর উৎপাদিত পণ্য খুব স্বল্প দামে কিছুদিন কিনেছিল, এখন সব বন্ধ। শোনা যায় এখানেও তোলাবাজির সমস্যা। বর্তমানে মেসিন বিক্রির টাকায় চলছে ওই শ্রমজীবীদের জীবন। বিরাট সংখ্যক মহিলা শ্রমজীবীরা কাজ হারিয়েছে। মানে প্রতিটি শিল্পই মৃত্যুদণ্ডের আদেশের নীচে দাঁড়িয়ে। বুঝতেই পারছেন, মজুরিশূন্য, কর্মহীনতার বৈষম্যের জন্যেই সামাজিক নিরাপত্তা, অধিকার হারিয়েছে শ্রমজীবীরা। যতই সরকার কন্যাশ্রী, রূপশ্রী চালু করুক, কিন্তু তার কোনওটাই আইনি অধিকার হিসেবে স্বীকৃত দেওয়া হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী থেকে সব নেতা-নেত্রীরা আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার ঢাক বাজাচ্ছে। যদিও শ্রমজীবীদের ঘরে কন্যাদের অপরিণত বয়সে বিবাহ, সন্তান প্রসব, রিকেট শিশুর জন্ম, প্রসবকালীন সময়ে মৃত্যু, নারী পাচার বেড়ে চলছে। বাড়ছে স্কুল ছুটের সংখ্যা— অভাবের জ্বালায় লেখাপড়া ছেড়ে কাজে লেগে পড়তে হচ্ছে দরিদ্র-প্রান্তিক পরিবারের ছেলে-মেয়েদের।
একথা ঠিক যে কোনও মৃত্যুই দুর্ভাগ্যজনক। মহিলা শিশুদের ওপর আক্রমণ নির্যাতন কখনোই কাম্য নয়। আমেরিকার টুইন টাওয়ারের ঘটনায় নিহত হলেও যেমন যন্ত্রণার, তেমনই গাজা-ইউক্রেনে নিহত হলেও একই যন্ত্রণার অনুভূতি। একই অনুভূতি গার্ডেনরিচের বেআইনি বিল্ডিং ভেঙে পড়ার ঘটনায় দু’জন নির্মাণ শ্রমিক সহ ১১ জনের মৃত্যুতে।
যে কোনও মানুষের অনুভূতিকে এই মৃত্যু প্রভাবিত করে। তাই কর্পোরেট পোষিত শাসকরা নিজেদের মহান প্রতিপন্ন করতে সরকারি কোষাগারের টাকায় শোক জ্ঞাপন, সহানুভূতি, মানবাধিকারের ক্ষয়রাতি করে। যারা হত্যা করছে, গৃহহীন করছে, তারাই মানুষকে আকাশ পথে খাবার ফেলছে। গার্ডেনরিচের মৃত্যুতেও সরকারি অর্থে একইভাবে খয়রাতি বিতরণ।
এহেন অন্ধকার পরিবেশে আছেন জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবীরা। তাদের প্রকৃত জীবনযাপনের চেহারা ঢেকে রাখা হচ্ছে রঙিন আলোর রশ্মির খেলায়। খেলা হচ্ছে। উত্তরকাশীর ৪১ জন শ্রমিকের জীবন বাঁচানোর জন্য যে ‘র্যাট মাইনার’রা হয়েছিলেন ‘ন্যাশনাল হিরো’, যাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলেন নেতারা, তাঁদের অন্যতম ভাকিল হোসেন এখন গৃহহারা। তাঁর ঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে দিল্লি ডেভলপমেন্ট অথরিটি। আর আমাদের রাজ্যে ৪১ দিন সুড়ঙ্গে কাটানো শ্রমিকদের একজনের ঘর ভাঙ্গলো এই রাজ্যের শাসক দলের দুষ্কৃতিরা। আমরা তাকে ভাইয়ের মর্যাদার দিতে পারিনি। কিন্তু দিতে তো হবে।
শ্রমজীবীদের জীবনের আদিম পর্ব থেকেই দুঃখ, কষ্ট ও যন্ত্রণা আছে। তাদের জীবন ইতিহাস অন্যরকম। সমস্যা হল এই জীবন ইতিহাসের যন্ত্রণা যখন বাড়ছে রাষ্ট্রের দরদের আশা করা যায় না। বরং রাষ্ট্র জনসাধারণের থেকে আদায়কৃত করের টাকায় জনমানসে দরদ নির্মাণে বাধা সৃষ্টি করছে পরিকল্পিতভাবে।
সময়ের দাবি হল— শ্রমজীবী মানুষের জীবন যন্ত্রণার পাশে, তাঁদের দাবি ও আন্দোলনের পাশে এগিয়ে আসতে হবে ছাত্র-যুব-মহিলা থেকে শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর সংগঠনকে — এগিয়ে আসতে হবে সমস্ত বুদ্ধিজীবী, শিক্ষিত গণতান্ত্রিক মানুষকে। কিন্তু কীভাবে শ্রমজীবীরা পুঁজির মালিক ও শাসকদের শাসনকে উপেক্ষা করে আন্দোলনে সাহসী হবে — সংগঠন ছাড়া শ্রমজীবীরা প্রবল পরাক্রান্ত পুঁজির মালিক এবং তাদের পাহারাদার শাসকদের সঙ্গে লড়বে কীভাবে। ব্যাপকতম শ্রমজীবীদের সংগঠিত হতে — তাঁদের নিজেদের হক বুঝে নিতে বামপন্থী সংগঠন ও শ্রমিক সংগঠনগুলিকে এই কাজে বাস্তবোচিত দরদী উদ্যোগ নিতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে একাজে পথিকৃত হতে হবে। আর এই কাজের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিস্ত শক্তি ও স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
লোকসভা নির্বাচন আসছে। সকাল অংশের মানুষ, গরীব-গুর্বো, সুশীল, ক্ষুব্ধ, বিরক্ত, মুক্তমনা মানুষ এবং বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে নির্বাচনের সময়ে উদ্বেলতা, আগ্রহ সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমরা ইতিপূর্বে নির্বাচনে শ্রমজীবীদের শ্রেণীর চেতনায় সংগঠিত করে ভোট বা নির্বাচনে কোনও বার্তা দিতে পারিনি।
ভোটের লড়াই অংশ নিতে গিয়ে শ্রমজীবী মানুষের জীবন যন্ত্রণা, তাঁদের দাবি ও আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানোর কাজটা এগিয়ে নিয়ে যেতে ঐক্যবদ্ধ হই। পুঁজির স্বার্থবাহী শাসকদের শক্তি আপাতত খুব বড় মনে হলেও আসলে ওরা কাগুজে বাঘ পরিণত হবে তখনই, যখন এই অসম যুদ্ধে শ্রমজীবীদের সমস্ত অংশের শ্রেণী সচেতনা নির্মাণ ও সংগঠিত হওয়ার ঐতিহাসিক দায়িত্বকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবো। শ্রমজীবী মানুষ একে অন্যেকে পরম আপনজন মনে করবে। প্রাক নির্বাচন পর্বে সেই কাজ শুরু হোক শ্রমজীবীদের স্বার্থের ইস্যু নিয়ে দৃশ্যমান প্রচারের মাধ্যমে।