বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
অবশেষে একটু ঘুম ভাঙল। করোনা অতিমারির সংকট আগেই দেখিয়েছিল এ রাজ্যসহ সারা দেশের পরিযায়ী শ্রমিকের ভয়াবহ দুরবস্থা। যা এতদিন চোখের সামনে দেখেও কেন্দ্রীয় সরকার-সহ বেশির ভাগ রাজ্য সরকার দেখেও না দেখার ভান করে চলছিল, অবশেষে তা নিয়ে কিছুটা হলেও ভাবনা চিন্তা শুরু হয়েছে। কখনো অতিমারির চাপে কখনো বা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ধাতানি খেয়ে। পশ্চিমবঙ্গ বহু দিন ধরেই ভিনরাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের জোগানদার। এবার অন্তত সরকারিভাবে পরিযায়ী শ্রমিকের সমস্যা, রাজ্য সরকার স্বীকার করতে প্রস্তুত হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকের কল্যাণে নেওয়া হচ্ছে সরকারি উদ্যোগ। অতি সম্প্রতি পরিযায়ী শ্রমিকের সহায়তার জন্য রাজ্য শ্রম দপ্তর পশ্চিয়বঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ গঠন করেছে। ঠিক হয়েছে বিপদগ্রস্ত শ্রমিকদের সহায়তার জন্য কেরল, দিল্লি, মহারাষ্ট্রে আঞ্চলিক কার্যালয় গড়ে তোলা হবে। যে কোনও পরিযায়ী শ্রমিক দুর্ঘটনাগ্রস্ত হলে ৫০০০০ থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থ সাহায্য করা হবে। কর্মরত অবস্থায় স্বাভাবিক মৃত্যু হলে তাঁর পরিবারকে দেওয়া হবে পঞ্চাশ হাজার টাকা, দুর্ঘটনায় মারা গেলে ২ লক্ষ টাকা। ভিনরাজ্যে মারা গেলে দেহ রাজ্যে ফিরিয়ে আনতে ২৫০০০ টাকা, এবং ওই রাজ্যেই দেহ সৎকার করতে চাইলে পরিবার কে ৩০০০ টাকা দেয়া হবে। রাতদিন, সাত দিনের এই পরিষেবা পাওয়া এবং নাম নথিভুক্ত করার জন্য একটি পোর্টাল চালু হবে।
উদ্দেশ্য সাধু, কিন্তু কতগুলো বিষয়ে শুরুতেই সচেতন না হলে এই পর্ষদের সফলতাও অধরা থেকে যাবে। প্রথম প্রশ্ন হল, এ রাজ্য থেকে ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ঠিক কত? এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য, সমীক্ষা রিপোর্ট কি সরকারের হাতে আছে? এক কথায় এর উত্তর হল, না। রাজ্য শ্রম দপ্তর বলছে সংখ্যাটা ৩৮ লাখের মতো। এ হিসাবের ভিত্তি কি? শোনা যাচ্ছে, লকডাউনের সময় ৪২ লক্ষ মানুষ রাজ্যে ফিরে এসেছিল। তাঁদের মধ্যে ৩৮ লক্ষ নাকি পরিযায়ী শ্রমিক। এটা কোনও পরিসংখ্যানের ভিত্তি হতে পারে না। লকডাউনের সময় ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিক ছাড়াও আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়া, চিকিৎসার জন্য যাওয়া বা নিছক ভ্রমণের জন্য যাওয়া বহু লোকও আটকে পড়েছিল, এবং ওই অবস্থায় যে সব ট্রেনের ব্যবস্থা হয়েছিল সেগুলোতে যোগাযোগ করে ফিরে আসে। হেল্পলাইন একটাই ছিল। অভিজ্ঞতায় জানি শুধু ফেরার ট্রেন বা বাসে জায়গা পাওয়ার জন্যও অনেকে স্বত:প্রণোদিত হয়ে পরিযায়ী তকমা নিয়েছিল। আটকে পড়া মানুষেরা নিজেদের যা তথ্য দিয়েছিল তার ভিত্তিতেই সরকার ৩৮ লক্ষ সংখ্যাটি বলছে, যার কোনও নির্ভরযোগ্যতা নেই। পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন, এনজিও, শ্রম অর্থনীতিবিদদের মতে, সংখ্যাটা ৬০ লাখে পৌঁছেছে। কাজের খোঁজে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে পাড়ি দেওয়া তো ছিলই, বিগত কয়েক দশক ধরে যোগ হয়েছে গৃহপরিচারিকার কাজ করার জন্য ও গাজিয়াবাদ, নয়ডা, গুরগাঁও এমনকি কেরলেও বাংলার মহিলাদের ব্যাপক সংখ্যায় পরিযান। এই অবস্থায় দরকার ছিল পেশাদার সমীক্ষক। সামিল করা যেতে পারতো পঞ্চায়েতকেও, যাদের মধ্যবর্তীতায় এই নথিভুক্তিকরণের কাজ আরও সুষ্ঠু হতে পারতো।
কেরল সরকার আজীবিকা ব্যুরো এবং তিরুবনন্তপুরমের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-এর সহায়তায় প্রতি দু’বছর অন্তর রাজ্যব্যাপী পরিযায়ী শ্রমিকের সমীক্ষা করে, এবং সেই মতো কর্মসূচি তৈরি হয়। এ রাজ্যেও আছে আইএসআই, ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতার মতো প্রতিষ্ঠান। দরকার জেলা, গ্রাম, শহর ভিত্তিক পরিযায়ী শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকা চিহ্নিতকরণ। এ সবের কিছুই না করে নথিভুক্ত করার প্রশ্নে সেই গতে বাঁধা পথে নির্ভর করা হচ্ছে মাথাভারি, আমলানির্ভর প্রশাসনের উপর। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো ঠিক হয়েছে, পর্ষদ এই নথিভুক্তিকরণের কাজ শুরু করবে ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হতে চলা দুয়ারে সরকার কর্মসূচি থেকে। এক মাসের মধ্যে পরিষেবা সম্পূর্ণ করবার গোঁজামিলে, তাড়াহুড়োয় ভুল ও ভুয়ো নথিভুক্তিকরণের সম্ভাবনা প্রবল। বোঝাই যাচ্ছে, ঝোঁকটা প্রচারের দিকে।
বলা হচ্ছে, এক মাসের মধ্যে ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাবে, এই মর্মে ঘোষণা করলে, এবং সেই ঘোষণা জনপ্রতিনিধির দ্বারা প্রত্যয়িত হলেও পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে পর্ষদ নাম নথিভুক্ত করে নেবে। শুধু এই নিয়মকে হাতিয়ার করেই বহু ভুয়ো নথিভুক্তিকরণ ঘটতে পারে।
নবগঠিত পর্ষদকে ঘিরে আরো একটা মৌলিক প্রশ্ন উঠছে। তা হল, পর্ষদের ভূমিকাটা ঠিক কি? এখনো অবধি দেখে শুনে মনে হচ্ছে, পরিযায়ী শ্রমিককে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছু নগদ অর্থ সাহায্য করার দিকেই মূল ঝোঁক। সরকার পরিযায়ী ‘সুরক্ষা’ বুঝতে বা বোঝাতে চাইছে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক দিয়ে। আন্তরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইন, নির্মাণ শ্রমিকের আইন, অসংগঠিত শ্রমিকের সুরক্ষা বিষয়ক আইনগুলোর কথা আর উঠছে না। শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলছে না শ্রম দপ্তর বা পরিযায়ী পর্ষদ। ক্ষতিপূরণ মালিকরা যে দেয় না তা নয়, বরং ঐক্যবদ্ধ ভাবে চেপে ধরলে আরো বেশি দেয়। সেটা কোনও মহানুভবতা থেকে নয়, শ্রমিকের মুখ বন্ধ রাখতে, শ্রমিক সুরক্ষাহীনতার বেআইনি কারবার ঢাকতে। সরকারি দপ্তর আর তার কল্যাণ পর্ষদ কেন সেই মালিকদের মতো কিছু টাকা দিয়েই দায় সারবে? ক্ষতিপূরণ পাওয়া শ্রমিকের জন্য জরুরি, সন্দেহ নেই। কিন্তু ক্ষতিপূরণ দান পর্ষদের কাজ হতে পারে না। পর্ষদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত, নিয়োগকারী যাতে পরিযায়ী শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ-সহ অন্যান্য আইনি সুবিধা দিতে বাধ্য থাকে, নিজের দায়িত্ব এড়াতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। তাদের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। পরিযায়ী শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, বকেয়া মজুরি আদায়ে সহায়তা, অতিমারি বা অন্য কোনও পরিস্থিতিতে আটক শ্রমিকদের উদ্ধার ও নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা, ভিনরাজ্যে কর্মরত শ্রমিকদের সুষ্ঠু বাসস্থান, সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে ভিনরাজ্যের সরকারগুলোর সঙ্গে সমঝোতাপত্র তৈরি করে সই করা এই মুহূর্তে ভীষণ প্রয়োজনীয়। ভিনরাজ্যে যে আঞ্চলিক কার্যালয় খোলার কথা বলা হয়েছে, তার পরিচালনভার কী ভাবে এবং কার হাতে থাকবে, সে প্রশ্নেরও মীমাংসা দরকার। এর দায়িত্ব কোনও বেসরকারি এজেন্সি বা এনজিও-র হাতে দেওয়ার শর্টকাট পন্থা না নিয়ে, দরকার রাজ্য সরকারের আধিকারিক, পরিদর্শকের ডেপুটেশনে নিয়োগ। এতে দায়বদ্ধতা ও কার্যকারিতা, উভয়ই বাড়বে।
পর্ষদ আর যে ঘোষণাটা করেছে তা হল, পর্ষদ ভিনরাজ্যে যাওয়া শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেবে এবং এ রাজ্যেই কর্মনিয়োগের চেষ্টা হবে। এরকম নাকি ২ লক্ষ কাজ তৈরি করা হবে। তর্কের খাতিরে যদি ৩৮ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের হিসাবও মেনে নিই, তা হলেও ২ লক্ষ কাজের হিসাব দিয়ে লাভ কি?এ ঘোষণা একই সঙ্গে বিভ্রান্তিকর, এবং এক ধরনের প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই নয়। ডবল ডবল চাকরির কথা বলা মুখ্যমন্ত্রীর ভাবমূর্তিতে কালি পড়েছে যুগপৎ দুর্নীতি ও কর্মসংস্থানের বেহাল দশায়। পর্ষদ কি ড্যামেজ কন্ট্রোলের কাজটি করতে চায়? পর্ষদের এই ঘোষণা অযৌক্তিক ও হাস্যকর। সবার কাজ এখানেই হবে, এ আসলে সস্তা আবেগের কথা। এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব নয়। একটু ভাল আয়, উন্নততর জীবনের জন্য মানুষ চিরকালই ঘর থেকে দূরে কাজের সন্ধান করেছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসই হলো পরিযানের ইতিহাস। সেখানে বাজার, শিল্পের প্রয়োজনে নানা রাজ্যে নানা ধরনের কাজ সৃষ্টি হয়। সেই অনুসারে শ্রমিকের গমনাগমন ঘটতে থাকে। এটা অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। দেশের সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে যে কোনও রাজ্যে কাজের অধিকার দিয়েছে। তা ছাড়া, এ রাজ্যের একটা বাচ্চা ছেলেও জানে যে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলো শিল্পোন্নত হওয়ায় সেখানে নানা ধরনের কাজের সুযোগ ও পারিশ্রমিক বেশি। সে কারণেই এ রাজ্যের থেকে বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের পরিযান ঘটে। তা ছাড়া বেশির ভাগ শ্রমিককে পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ ও উপযুক্ত মজুরি দিতে পারার মতো শ্রমনিবিড় শিল্পও এ রাজ্যে বিশেষ নেই। সরকার সামগ্রিক ভাবে কাজের সুযোগ বাড়াতেই পারে, কিন্তু ভিনরাজ্যে শ্রমিক গমন কমানো হবে, এ রাজ্যেই তাঁদের কাজ দেওয়া হবে এটা পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের লক্ষ্য হতে পারে না। এ রাজ্য থেকে যারা ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাচ্ছেন, আর অন্য রাজ্য বিশেষ করে পড়শি বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, ত্রিপুরা সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের যে সব শ্রমিকেরা এই রাজ্যে কাজ করতে আসছেন, তাঁদের বিবিধ অধিকারের সুরক্ষা এবং তাঁদের পরিবারকে সহায়তা করাই হোক পর্ষদের প্রধান লক্ষ্য। লক্ষণীয়, অন্য রাজ্য থেকে এ রাজ্যে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়ে একটিও কথা নেই। এ-ও এক স্ববিরোধিতা।
পর্ষদ কর্তারা সরকারি অনুদানের খুদকুড়ো ছড়ানোর নীতি থেকে সরে এসে একটু আইনি অধিকারের পাতাগুলো উল্টে দেখুন, পরিকাঠামোয় জোর দিন, আর স্বচ্ছ নীতি অবলম্বন করুন। সবে তো পথ চলার শুরু।