বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবাংলায় তৃণমুল কংগ্রেস ৪২টি আসনের মধ্যে ২৯টি আসনে জয়ী হয়েছে। বিগত নির্বাচনের থেকে ৭টি আসন বেশি। অন্যদিকে, ভারতীয় জনতা দল ১২টি আসন দখল করেছে, যা বিগত নির্বাচনের চেয়ে ৬টি কম। অথচ বিজেপির সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রমুখ এই রাজ্যে ৩০টির বেশি আসনে জয়ী হওয়ায় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। অন্য রাজ্যে বেহাল অবস্থা দেখে এই রাজ্য থেকে ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী ১৮টি জনসভা ও একটি রোড শো করে একটা প্রবল বিজেপি হাওয়া তৈরি করেছেন বলে দাবি করেন। বিজেপির বিজয় যে শুধু ফলাফল ঘোষণার অপেক্ষা মাত্র, তাও বোঝাতে কসুর করেননি তিনি। তাঁর সব ভাষণে ধর্মীয় বিভাজন, তৃণমূলের দুর্নীতি ও কমিউনিস্ট বিদ্বেষ ছাড়া আর কোনও বিষয় মানুষ শোনেননি! অন্যদিকে তৃণমূল সুপ্রিমো তাঁর জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের জয়গানের সঙ্গে সঙ্গে মহিলা ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে তাঁর দলের অনুকূলে ভোট দেওয়ার বার্তা দিয়েছেন। ভোটের ফল প্রকাশে দেখা গেল নেত্রীর জিত আর প্রধানমন্ত্রীর হার।
তৃণমূল কংগ্রেসের এই সাফল্যকে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক তৃণমূল কংগ্রেসের জনমুখী প্রকল্পের, বিশেষ করে লক্ষ্মী ভাণ্ডার প্রকল্পের জয় হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের আরও মত হল, নির্বাচনের প্রাক্কালে এই প্রকল্পের টাকার অঙ্ক দ্বিগুণ করে দিয়ে (৫০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা এবং তফসিল ভুক্তদের ১২০০ টাকা) নেত্রী যে বড় দান চেলেছিলেন তাতেই খেলা ঘুরে গিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস এখন “ইন্ডিয়া” জোটের তৃতীয় শক্তি।
(২)
_______________________
তৃণমুল কংগ্রেসের এই সাফল্য জনবাদী কর্মসূচির ফলশ্রুতি কিনা তা পর্যালোচনার আগে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এই কর্মসূচির প্রভাব ও নির্বাচনী সাফল্যের পিছনে অন্য বিষয়গুলির ভূমিকার সংক্ষিপ্ত আলোচনা হওয়া দরকার।
প্রথমে বলা প্রয়োজন যে, তৃণমূল কংগ্রেসের জনমুখী প্রকল্প কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। দেশের অনেক রাজ্য সরকার এধরণের প্রকল্প রূপায়ণ করে থাকে। বস্তুত তামিলনাডুর প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা যেসব প্রকল্প রাজ্যে রূপায়ণ করেছিলেন তার অনুকরণে অনেক রাজ্যই সেপথে হেঁটেছে। কেরল সহ দক্ষিণ ভারতের সব রাজ্য সরকারের জনমুখী প্রকল্প দীর্ঘদিন যাবত কার্যকর আছে। অন্ধ্রপ্রদেশের সদ্যপ্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগনমোহন রেড্ডির নাম হয়ে গিয়েছিল “বোতাম টেপা মুখ্যমন্ত্রী”। বড়াই করে বলা হত, বোতাম টিপলেই জনগণের খাতায় টাকা জমা হয়ে যাবে। তেলেঙ্গানাতেও নানান প্রকল্প চালু করেছিলেন সেরাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। এমনকি যে প্রধানমন্ত্রী জনমুখী প্রকল্পকে “রেউড়ি” বলে ব্যঙ্গ করে প্রাপকদের “লাভার্থি” বলে উপহাস করতেন, তিনিও গত কয়েক বছর বোতাম টেপা জনকল্যাণের পথেই হাঁটছেন। উজ্জ্বলা গ্যাসের ভর্তুকি, পিএম কিসান, জনধন অ্যাকাউন্ট, পিএম আবাস, একশো দিনের কাজের মজুরি ইত্যাদি সবই জনগণের ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়। উদাহরণ না বাড়িয়ে বলা যেতে পারে যে, সারা দেশজুড়ে এমনধারা প্রকল্প রূপায়ণে কোনও রাজ্য সরকারই পিছিয়ে নেই। উদারবাদী ভুবনায়নের সময়কালে মানুষের মনে প্রলেপ দিতে রাষ্ট্রের শাসকদের এপথে হাঁটা ছাড়া আর কোনও দীর্ঘস্থায়ী জনমুখী প্রকল্পে তাদের উৎসাহ থাকে না।
আমাদের পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের জমানায় জনমুখী প্রকল্পের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরে, রাজ্য সরকারের উন্নয়ন যে অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলেছে সেই বার্তা নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে পৌঁছে দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে জয়ী করার আবেদন করা হয়। এই আবেদন মহিলা ভোটারের কাছে আকর্ষণীয় করতে লক্ষ্মী ভাণ্ডারে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পরিবারের সব মহিলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের পরিচয়পত্র মহিলাদের নামে করে মহিলাদের মন জয় করার চেষ্টা বহুলাংশে সফল হয়েছে। বিগত নির্বাচনে দেখা যায়, যে ২৫টি লোকসভা কেন্দ্রে পুরুষের চেয়ে নারী ভোটার বেশি ছিলেন তার মধ্যে তৃণমূল জিতেছে ১৫টি আসনে। বস্তুত এই রাজ্যে মহিলা ভোট তৃণমূল কংগ্রেসের অনুকূলে যে বেশি তা ২০১৯ সালের “লোকনীতি” সংস্থার সমীক্ষাতেও ধরা পড়েছে। তৃণমূল সুপ্রিমো বাস্তবতা মেনে লক্ষ্মী ভাণ্ডারের টাকা দ্বিগুণ করেছেন এবং সবুজশ্রী, কন্যাশ্রী, রুপশ্রী প্রকল্পগুলিকে ভোট প্রচারে অগ্রাধিকার দিয়ে মহিলা ভোটারের মন জয় করার চেষ্টা জারি রেখেছেন। বিরোধীরা অসতর্ক মুহূর্তে একে ভিক্ষার দান বলে কটাক্ষ করেন। পরে বিরোধীরা সেকথা হজম করে বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, তারা ক্ষমতায় এলে এই সব প্রকল্পের অনুদানের টাকা অনেক বেশি বাড়ানো হবে। তৃণমূল নেত্রীর প্রচার যে মহিলা ভোটারের মনে দাগ কেটেছে তা সহজেই অনুমেয়। আর প্রত্যক্ষ টাকা হস্তান্তর, তা যতই সামান্য হোক না কেন, তা অসহায়ের কাছে বড় অবলম্বন হয়ে ওঠে। সম্প্রতি নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ এস্থার দুফলো এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে, কম টাকা দেওয়ার চেয়ে বেশি টাকা দেওয়া সব সময় ভাল। ভারতের মতো দেশে ১০০০ টাকা খুব বেশি টাকা নয়, কিন্তু হতদরিদ্রের কাছে এর দাম আছে।
অন্য রাজ্যে এই জনবাদী প্রকল্পগুলির ভোটের ফলাফলে কতটা নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে সে বিষয়ে আলোচনা করবো। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, আমাদের রাজ্যে এই প্রকল্পগুলির ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। পর্যালোচনার বিষয় হল, আমাদের রাজ্য সহ সারা দেশের নির্বাচনের ফলাফলে কোন উপাদানগুলির প্রভাব বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।
(৩)
_______________________
রাজনৈতিক দলগুলির ফলাফলের বিশ্লেষণ এখনও প্রকাশিত হয় নি। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকেদের বিশ্লেষণ থেকে কয়েকটি প্রবণতা উল্লেখ করা যায়।
এক, জনবাদী নীতি পূরণ হলেও তা দীর্ঘদিন পর্যন্ত কার্যকর থাকে না। উদাহরণ হিসাবে তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা ও মহারাষ্ট্রের কথা আসে। আগেই উল্লেখিত হয়েছে যে, অন্ধ্রপ্রদেশে জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের ব্যপকতা এতটা বিস্তৃত ছিল যে বোতাম টিপলেই সরকারি অনুদান উপভোক্তার অ্যাকাউন্টে এসে যেত। এহেন রাজ্যে সরকার ধরাশায়ী হয়েছে। তেলেঙ্গানার হালও একই রকম। যে উত্তরপ্রদেশের উন্নয়ন ও জনহিতকর কাজের ফলাও বিজ্ঞাপনে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর ছবি শোভা বর্ধন করেছে ভোটের ফলাফল ঘোষণা হতে সেই হর্ষমুখেও বিষাদের ছায়া।
ওড়িশায় জনমুখী প্রকল্প রূপায়ণের কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া জনসমক্ষে তেমনভাবে আসেনি। কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু ভাবমূর্তি ও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার চোরা স্রোত সরকারের পতন রোধ করতে পারেনি। লোকসভা নির্বাচনেও তার প্রতিফলন ঘটেছে।
আমাদের রাজ্যের ফলাফলে লক্ষ্মী ভাণ্ডার যেমন সাড়া দিয়েছে, অন্যান্য জনবাদী প্রকল্পগুলির তেমন প্রচার চোখে পড়েনি। সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে, নতুন জনকল্যাণ প্রকল্প শুরুর সময়ে নির্বাচন হলে নির্বাচনী ফলে যে প্রভাব পড়ে, পরবর্তী সময়ে সব সময়ে সেই সাড়া মেলে না। আসলে এধরনের প্রকল্পের কোনও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব থাকে না। জনমানসে আরো নতুন কিছু সুবিধা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। দিল্লির নির্বাচনী ফলাফল তার জীবন্ত প্রমাণ। কেজরিওয়ালের সরকার জনকল্যাণের বহু ধরনের প্রকল্প রূপায়ণ করেও নির্বাচনী সুবিধা পায়নি। তাই জনবাদী প্রকল্প রূপায়ণের সঙ্গে নির্বাচনী সাফল্যের সম্পর্ক একরৈখিক নয়।
(৪)
_______________________
বিগত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের বিশ্লেষণ যেহেতু এখনো অসমাপ্ত, তাই নির্বাচনী ফলাফলে কোন উপাদান বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে তার সঠিকভাবে নিরূপণ করা যাবে না। তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে দেশের বহুত্বের কারণে কোনও একটি উপাদানকে সাফল্যের মূল অভিমুখ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। তবু্ও কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে ফলাফল নির্ধারণে বিশেষ ভূমিকা পালনের জন্য চিহ্নিত করা যায়।
এক) রামমন্দির নির্মাণ ও বিরোধীদের বিরুদ্ধে মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়ার লাগাতার প্রচার দেশের মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেনি। পরন্তু ফৈজাবাদে অখিলেশ যাদব এক কম পরিচিত দলিতকে প্রার্থী করে বাজিমাত করে প্রমাণ করলেন যে, মোদিজীর মন্দির তাস কার্যকারিতা হারিয়েছে। খোদ অযোধ্যায় এই বিজয়, দেশের মানুষের মননের যে ধারা ক্রিয়াশীল ছিল, নির্বাচনের ফলে তারই প্রকাশ ঘটেছে।
দুই) উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদবের যাদব ও মুসলিমদের প্রাধান্য না দিয়ে দলিত, পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী থেকে প্রার্থী নির্বাচন বিজেপির এইসব জনগোষ্ঠীকে হিন্দুত্বের আওতায় আনার কৌশলকে ভোঁতা করে দিয়েছে। তদুপরি সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেসের নির্বাচনী রসায়ন উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে যে বিপাকে ফেলবে তা বিজেপির ভাবনায় ছিল না।
তিন) মোদিজীর “বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও”, দু’ কোটি বেকারের চাকরির প্রতিশ্রুতি, ২০১৪র নির্বাচনে কালাধন উদ্ধার করে প্রত্যেকের হিসাবের খাতায় ১৫ লক্ষ টাকা জমা করার অঙ্গীকার, এবং তিন তালাকের বিরুদ্ধে আইন, মহিলা সংরক্ষণ আইনের প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি কারণে ২০১৯-র নির্বাচনে যে সুফল বিজেপি পেয়েছিল ২০২৪-র নির্বাচনে মোদিজীর মুসলিম বিরোধী ঘৃণাভাষণ পসমন্দা মুসলিমদেরও বিজেপি বিরোধী অবস্থান নিতে বাধ্য করে। তাছাড়া মোদিজী রাজস্থানের এক সভায় কংগ্রেসের মহিলাদের কাছে সরাসরি টাকা হস্তান্তরের ঘোষণাকে বিকৃত করে বললেন যে, কংগ্রেস সরকারে এলে হিন্দুদের মঙ্গলসূত্র ও সোনাদানা সব মুসলমানদের হস্তান্তর করে দেবে। এহেন মিথ্যাচারের বিরূপ প্রতিক্রিয়া নির্বাচনী ফলে প্রকাশ পেয়েছে।
চার) নির্বাচনের প্রাক্কালে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেফতার এবং ইডি, সিবিআই-এর ভূমিকা আদিবাসী জনসমাজ ছাড়াও সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট বার্তা নিয়ে আসে যে, বিজেপি সরকার মানুষের সব অধিকার কেড়ে নেবে। এমনকি সংবিধানের ঘোষিত তপশিলি জাতি ও জনজাতিদের সংরক্ষণও কেড়ে নেবে।
পাঁচ) মহারাষ্ট্রে মহাবিকাশ আগাড়ির সাফল্য যেমন দলবদলুদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে, তেমনি মারাঠি অস্মিতাকে যে উপেক্ষা করা যাবে না সেই বার্তাও বুঝতে ভুল করলে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে ইন্ডিয়া জোটের ফলাফলে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা আছে।
ছয়) দক্ষিণ ভারতে সামগ্রিকভাবে ইন্ডিয়া জোটের সাফল্য সন্তোষজনক হলেও কেরলে বিজেপির একটি আসন লাভ এবং কেরল সহ অন্য দক্ষিণী রাজ্যগুলিতে তাদের ভোট শতাংশ বৃদ্ধি ইন্ডিয়া জোটকে যে উদ্বেগে রাখবে তা বলাই বাহুল্য।
সাত) জাতপাতের রাজনীতির অবসান ঘটেছে বলে বিজেপির প্রচার ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। রাহুল গান্ধীর জাতিগত সমীক্ষার দাবির যথার্থতা যেমন প্রমাণিত হয়েছে, তেমন দলবদলু জেডিইউ নেতা নীতীশকুমারও জাতিগত গণনায় কোর্টের অনুকূল রায়ের জোরে “কুর্মি গড়” রক্ষা করে ১৬টি আসনে লড়ে ১২টিতে জিতে নিজেকে “কিং মেকারের” স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কংগ্রেসও তাদের সংখ্যা এক থেকে তিনে, আরজেডি শূন্য থেকে চারে শুধু নিয়ে গিয়েছে তাই নয়, তাদের মুসলিম ও যাদবদের মধ্যে আধিপত্য বজায় রেখেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল সিপিআই(এমএল) লিবারেশন তিনটি আসনে লড়ে দুটিতে জয়লাভ করেছে। সিপিএমের ভোট শতাংশ বেড়েছে। এই রাজ্যে ইন্ডিয়া জোটের ভবিষ্যতে সাফল্যের ইঙ্গিত স্পষ্ট।
আট) পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে কৃষকের ফসলের এমএসপির আইনি অধিকারকে মান্যতা না দেওয়া ও কৃষকদের বঞ্চনা ভোটের ফলাফলে ধরা পড়েছে। বস্তুত ভোটের আগে অনুষ্ঠিত মহা পঞ্চায়েতগুলি থেকে বিজেপিকে বয়কটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
নয়) অসম সহ উত্তর পূর্ব ভারতের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিজেপির অনুকূলে ছিল না। অসমে কংগ্রেসের মুসলিম সমর্থনের ভিত্তি বেড়েছে। মণিপুরে দুটি আসনেই কংগ্রেস জয়ী হয়েছে।
দশ) ৩৭০ ধারা বিলোপের পর জম্মু কাশ্মীরের নির্বাচনে বিজেপি কাশ্মীরে প্রার্থী দিতে পারেনি। পিডিপি ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রধান পরাজিত হলেও প্রধান পরাজিত হলেও ন্যাশনাল কনফারেন্স দুটি আসনে জয়ী হয়েছে। জিতেছেন তিহার জেলে বন্দী শেখ আবদুল রশিদ। লাদাখে জিতেছেন একজন নির্দল। জম্মুতে বিজেপি জিতলেও কংগ্রেস জোর টক্কর দিয়েছে।
(৫)
_______________________
উপরোক্ত বিশ্লেষণে যে আংশিক ছবি দেখা গেল তাতে এটা স্পষ্ট যে সারা দেশজুড়ে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষের ফলশ্রুতি হল ইন্ডিয়া জোটের সাফল্য। বিভিন্ন রাজ্যে এই অসন্তোষের রূপ যেহেতু ভিন্ন তাই ইন্ডিয়া জোটভূক্ত দলগুলি বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে নির্বাচনী কৌশল অবলম্বন করে বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করার উদ্যোগ নিয়েছে। বেশিরভাগ রাজ্যে ঐক্যবদ্ধ লড়াই হলেও আমাদের রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস এককভাবে লড়াই করেছে। কিন্তু তৃণমুল কংগ্রেসের বিজেপি বিরোধিতা ছিল লড়াইয়ের প্রধান অভিমুখ।
কিন্তু এই বিরোধিতা ছাড়াও তৃণমূল কংগ্রেস তাদের সরকারের জনমুখী প্রকল্প, বিশেষ করে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ও কেন্দ্র কর্তৃক রাজ্যের টাকা আটকে রাখার অভিযোগ সোচ্চারে প্রচার করেছে। ইতিপূর্বে এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মোদির গ্যারান্টিতেও মানুষ আস্থা রাখতে পারেননি।
অবশ্য আমাদের রাজ্যে যে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রচারের কিছু ইতিবাচক ভূমিকা ছিল তাও পূর্বে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের সাফল্য শুধুমাত্র জনবাদী প্রকল্পের হাত ধরে আসেনি। এসেছে ধর্মীয় বিভাজন ও সামাজিক বিভাজনের হাত ধরে। তার সঙ্গে ছিল শাসক দলের পরিকল্পিত পেশিশক্তি ও বাহুবল প্রয়োগ। নির্বাচনের পরে সেই পেশিশক্তি ও বাহুবলের নির্লজ্জ প্রকাশ রাজ্যবাসীকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্য সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রাজ্যে সামাজিক ও ধর্মীয় বিভাজনের রাস্তা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার পরিসর এখানে নেই। শুধু বলবার কথা এই যে, তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক সাফল্যের চাবিকাঠি হল কিছু জনমুখী প্রকল্প ও ৩২ শতাংশ মুসলিম ভোটের সিংহভাগ দখলে রাখা। এই কাজের প্রধান সহায়ক তাদের প্রতিপক্ষ বলে পরিচিত বিজেপি ও আরএসএস। এই লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী দিল্লি-কলকাতা নিত্যযাত্রীর মতো রাজ্যে সভা ও রোড-শো এবং প্রতি সভায় তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাজ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বড়সড় নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। রাজ্যে কোনও বিরোধীদলকে তাঁরা রক্ষাকর্তা ভাবতে পারেননি। এমতাবস্থায় রাজ্যের শাসকদলই হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁদের রক্ষাকর্তা।
মুখ্যমন্ত্রী মুসলমানদের ঈদের সমাবেশে থেকে মুসলমানদের এককাট্টা হয়ে পাশে দাঁড়াবার বার্তা দিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে, জনমুখী প্রকল্প, মুসলিম ভোটের সিংহভাগ দখলে রাখা এবং বাহুবলের পরিকল্পিত ব্যবহারের ফলশ্রুতি হল তৃণমুল কংগ্রেসের নির্বাচনী সাফল্য।
তথ্য সূত্র: (১) অশোক সরকার, আবাপ, ২৪.০৬.২৪
(২) ফ্রন্টলাইন ২৮.০৬.২৪