বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
চল্লিশ না পেরোতেই কানে শোনার শক্তি হারিয়েছিলেন ধনকুমার হাজরা। বয়স যখন হল চুয়ান্ন, তখন পেলেন হিয়ারিং এড। তার পরে প্রায়ই ভদ্রলোককে দেখা যেত তাঁর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে। পথচলতি লোকদের ডেকে ডেকে বলতেন, “একটু কথা বল ভাই আমার সঙ্গে, এখন আমি কানে শুনতে পাই।”
এ কেবল মায়াময় কৌতুক-কাহিনি হয়ে থাকত, যদি না জানা যেত যে ওই প্রৌঢ়কে তাঁর জীবন ফিরিয়ে-দেওয়া হিয়ারিং এড যন্ত্রখানি দেয়নি তাঁর পরিবার, সরকারি হাসপাতাল বা কোনও এনজিও। তাঁর কানে শোনার শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিল গ্রাম উন্নয়ন সমিতি। দক্ষিণ দিনাজপুরের বেশ কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েত তখন — সেই ২০১০ সালে — কাজ করছে একটি প্রকল্পের অধীনে, যা গ্রামের মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া, অর্থাৎ বিকেন্দ্রিকরণে শক্তিসঞ্চার করতে চেয়েছিল। ‘স্ট্রেনদেনিং রুরাল ডেভেলপমেন্ট’ নামে এই প্রকল্পটি (২০০৬- ২০১১) শাসন-ক্ষমতাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল গ্রাম পঞ্চায়েতেরও তলার ধাপে, বুথ বা গ্রাম সংসদ স্তরে। গ্রাম সংসদের সভায় গ্রামেরই জনা দশেক মানুষকে নিয়ে তৈরি হত ‘গ্রাম উন্নয়ন সমিতি।’ তার সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হত অনুদানের কিছু টাকা (নেহাতই নগন্য, বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকা) যা তারা গ্রামের উন্নয়নের ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারত। সেই স্বাধীনতা আর সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কত কী করেছিলেন গ্রামের মানুষ, তা সত্যিই ছিল দেখার মতো। গ্রামের মানুষের যে সব কষ্ট, যে সব প্রয়োজন ‘গ্রাম পঞ্চায়েত’ নামক সরকারি দফতরে পরিণত বিল্ডিং-এর চেয়ারগুলিকে স্পর্শ করতে পারে না, তার অনেকগুলিতে সাড়া দিয়েছিল গ্রাম উন্নয়ন সমিতি। ২০১০ সালে এই প্রকল্পের একটা মূল্যায়ন করার সুযোগ হয়েছিল এই প্রতিবেদকের। স্বশাসনের শক্তি, তা সে যতই সীমিত হোক, দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।
আজ এত দিন পরে কেন সে কথা তোলা? সে প্রকল্প কবেই চুকেবুকে গিয়েছে। স্বশাসনই বা আজ কোথায়? পশ্চিমবঙ্গের নবম পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্য যেন দেখছে শ্ব-শাসন — উন্মত্ত পথকুকুরের দলের মতো কিছু লোক গ্রামের, ব্লক সদরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে নিজের নিজের ‘এলাকা’ বাঁচাতে। তাদের খেয়োখেয়িকেই বলা হচ্ছে ‘ভোটের লড়াই’। কার কামড়ে কত জোর, কার দলে কত কুকুর, এই হল আজ শাসন-যোগ্যতার একমাত্র পরীক্ষা। এই নির্বাচনী খেলায় পঞ্চায়েতই রয়ে গিয়েছে মাঠের বাইরে। খেলাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেমিফাইনাল ম্যাচ — ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের একমাত্র তাৎপর্য যেন ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলের পূর্বাভাস দেওয়া। শাসক দল প্রচার করছে তার অনুদানের বহর নিয়ে, যার বিলিব্যবস্থায় খানিক সহায়তা (এবং সেই সুযোগে হিঁয়া কা মাল হুঁয়া) করা ছাড়া পঞ্চায়েত সদস্যদের কোনও ভূমিকা নেই। আর বিরোধীরা প্রচার করছে শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের বড় বড় দুর্নীতি নিয়ে — তার সঙ্গেও পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ভাল-মন্দের সম্পর্ক খুব সামান্য। কিছু বাহুবলী দুষ্কৃতী, কিছু অপরাধ-কবলিত এলাকা বাদ দিলে, পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ গ্রামবাসী বড় মাপের কেলেঙ্কারির ভুক্তভোগী মাত্র, সহযোগী নয়। এ সব দুর্নীতির চক্র যে চলতে পারছে, তা গ্রামীণ স্বশাসনের শক্তিহীনতার দিকেই ইশারা করে।
ভোটের দিন কী হয় দেখতে, আর ভোটের ফল কী হয় দেখতে প্রবল উত্তেজনা নিয়ে বহু মানুষ অপেক্ষা করছেন। যদিও এঁদেরও প্রায় সকলেই জানেন, যে-ই জিতুক না কেন, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে যা চলছে তা-ই চলবে। গ্রামবাসীদের ইচ্ছা অনুসারে, তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণে এবং নজরদারিতে কাজ করবে পঞ্চায়েত, সে আশা কতটুকু? তৃণমূল বা বিজেপি, কোনও দলই শাসনক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণে বিশ্বাসী নয়, পুলিশ-প্রশাসনের উপর তাদের ভরসা। কেন্দ্রের কংগ্রেস-শাসিত সরকার পঞ্চায়েত আইন পাশ করলেও (১৯৯৩) কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যগুলি পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে অর্থ, কর্মী বা কাজের ক্ষেত্র (‘ফান্ডস, ফাংশনস, ফাংশনারিজ়’) হস্তান্তর করার নজির গড়তে পারেনি। আর বামপন্থীরা? তারা পশ্চিমবঙ্গেই বিকেন্দ্রিত প্রশাসনের দৃষ্টান্ত প্রথম স্থাপন করেছিল, এবং পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ভূমি সংস্কার করে বিশ্বের নজর কেড়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই দেখা গেল, অ্যাকসিলটেরে যত না চাপ পড়ছে, ব্রেকে চাপ পড়ছে তার চাইতে বেশি। ফলে নব্বইয়ের দশকে বিকেন্দ্রিকরণ, অর্থাৎ গ্রামের স্বশাসন ব্যবস্থার হাতে প্রশাসন ক্ষমতা তুলে দেওয়ার নিরিখে এগিয়ে গিয়েছে আর এক বাম-শাসিত রাজ্য, কেরল। কেরলে এক একটি গ্রাম পঞ্চায়েতে সাত-আটটি সরকারি দফতরের কর্মচারী ‘ডেপুটেশন’-এ কাজ করেন, গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের অধীনস্থ কর্মচারী হিসাবে। পঞ্চায়েতগুলি রাজ্য বাজেটের চল্লিশ শতাংশ পায়। এ রাজ্যে রাজস্বের পাঁচ-সাত শতাংশ পায় পঞ্চায়েত, সরকারি কর্মীদের পঞ্চায়েতের অধীনে কাজ করতে পাঠানোর তো প্রশ্নই ওঠেনি কখনও।
তা সত্ত্বেও এ রাজ্যে বিকেন্দ্রিকরণের মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছিল বাম আমলে, প্রধানত কিছু বাম-মনস্ক আধিকারিক, আর সাম্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত কিছু শিক্ষক, সমাজকর্মীর আগ্রহে। বামফ্রন্টের শাসনকালে ২৯ বার পঞ্চায়েত আইনে সংশোধন হয়েছে। ২০০৩ সালে গ্রাম উন্নয়ন সমিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে নির্বাচিত সদস্যের সঙ্গে নিকটতম ভোটে পরাজিত প্রার্থীও সদস্য হিসাবে স্থান পেয়েছে। অর্থাৎ বিরোধীর জন্য রাজনৈতিক জমি ছাড়তে নারাজ হলেও, প্রাতিষ্ঠানিক একটা ‘স্পেস’ তৈরি করে তৃণমূল স্তরে গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার একটা চেষ্টা ছিল বামেদের একাংশের। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ‘গ্রামবাসীর দ্বারা গ্রাম উন্নয়ন’-এর আদর্শে কাজ করেন অধ্যাপক অজিত নারায়ণ বসু ও তাঁর অনুগামীরা। এগুলিকে বলা চলে সহভাগী পরিকল্পনার মডেল। এর পরেই ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক সহায়তায় গ্রাম উন্নয়ন সমিতিগুলিকে শক্তিশালী ও সক্রিয় করার প্রকল্প শুরু হয়, ২০০৬ সালে। কিন্তু নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনের জেরে বামফ্রন্ট সরকার তখন জনসমর্থনের জমি হারাচ্ছে। ২০০৮ সালে পঞ্চায়েতে সিপিএম-এর প্রতিস্পর্ধী হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেসের আত্মপ্রকাশের পর বিকেন্দ্রিকরণের প্রতি আরও বিরূপ হয়ে ওঠে বাম সরকার। তৎকালীন পঞ্চায়েত মন্ত্রী আনিসুর রহমান গ্রাম উন্নয়ন সমিতির হাত থেকে স্বাধীন ভাবে কাজ করার ক্ষমতা কেড়ে নেন। এর কিছু দিন পরেই বামেরা বিদায় নেয় ক্ষমতা থেকে। ফলে বাম শাসনের শেষেই কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল গ্রামের মানুষের চাহিদা, ইচ্ছা, পরামর্শ শোনার রাস্তা, তাদের সক্রিয় অংশিদারিত্বে উন্নয়নের এক্সপেরিমেন্ট।
বাম আমলে সব স্তরেই প্রশাসন ছিল দল-নির্ভর, তৃণমূল আমলে দল ও প্রশাসন, দুটোই ব্যক্তিনির্ভর। অতএব বিকেন্দ্রিকরণের প্রশ্নই ওঠে না। পঞ্চায়েত ‘দখল’ কেবলমাত্র দলীয় আধিপত্যের অভিজ্ঞান হয়ে রইল, স্বশাসনের ধারণা আমলই পেল না। প্রকল্পের কাজে পঞ্চায়েতের ভূমিকা হ্রাস পেল, বিডিও-জেলাশাসক কথায় কথায় গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান কিংবা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিকে তলব করে ধমক দেন। মনোনয়ন পর্বের শেষ দিনে এক সাংবাদিককে বাঁকুড়ার বিদায়ী জেলা সভাধিপতি মৃত্যুঞ্জয় মুর্মু জানিয়েছেন, কোন এলাকায় কোন কাজ গুরুত্ব পাবে, গত বছর দুয়েক তা প্রশাসনই ঠিক করছে। “আমাদের মত কানে তোলা হয়নি।” এমনকি, কোথায় কী কাজের তালিকা হবে বলে স্থির হয়েছে, কোন তহবিলের টাকা কোথায়, কতটা খরচ হচ্ছে, তা ব্লক বা জেলা প্রশাসনের কাছে চেয়েও তিনি হাতে পাননি বলে অভিযোগ। যদিও আইনত সভাধিপতির মর্যাদা রাজ্যের প্রতিমন্ত্রীর সমান।
পঞ্চায়েত নিজের বিবেচনা অনুসারে খরচের জন্য যে বরাদ্দ (‘আনটায়েড ফান্ড) পায়, তা-ও কীসে খরচ করতে হবে, সে নির্দেশ দেওয়া হয় উপরমহল থেকে। এ ভাবেও পঞ্চায়েতের স্বাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সরকারের দেওয়া ‘টার্গেট পূরণ করার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়নোই যেন পঞ্চায়েতের কাজ। পঞ্চায়েত নিজের বিবেচনা অনুসারে খরচের জন্য যে বরাদ্দ (‘আনটায়েড ফান্ড’) পায়, তা-ও কীসে খরচ করতে হবে, সে নির্দেশ দেওয়া হয় উপরমহল থেকে। ফলে সরকারের দেওয়া ‘টার্গেট’ পূরণ করার জন্য ঊর্ধ্বশাস দৌড় ছাড়া পঞ্চায়েতের কোনও কাজ রইল না। সে ‘টার্গেট’ পূরণ করা আদৌ গ্রামের মানুষের প্রয়োজন ছিল কি না, সে প্রশ্নের তো অবকাশই নেই। গ্রাম পঞ্চায়েত হয়ে দাঁড়িয়েছে আধা-করণিক, আধা-সাক্ষীগোপাল। গোদের উপর বিষফোঁড়া ঠিকাদারতন্ত্র। টেন্ডার পেতে হন্যে কন্ট্রাকটরদের কাছে পঞ্চায়েত এক মধুভাণ্ড বই কিছু নয়। ধানের সরকারি সহায়ক মূল্যের মধুও চাক বেঁধে খেয়ে নিয়েছে পঞ্চায়েতের হর্তাকর্তারাই, সাধারণ চাষিকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি।
ভারতীয় রাজনীতিতে দুর্নীতি অস্বাভাবিক কিছু নয়। সমস্যা হয় যখন সেই লোকেদের পাল্লা ভারী হয়ে ওঠে, যারা জনসমর্থন পাওয়ার, বা ধরে রাখার, তোয়াক্কা করে না। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ দোহন করাই যাদের একমাত্র লক্ষ্য। উপর থেকে প্রার্থী ঠিক করে দেওয়ার রীতিও জনসমর্থন আদায়ের প্রয়োজনকে লঘু করে দিয়েছে। ফলে পঞ্চায়েত সদস্যদের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে, ক্ষোভ গাঢ় হয়েছে। আন্দাজ পেয়ে শীর্ষ নেতাদের বারবার স্টিয়ারিং ঘোরাতে হয়েছে। কখনও জনসভায় পঞ্চায়েত নেতাদের কাটমানি ফেরত দেওয়ার নির্দেশ জারি করেছে তৃণমূল নেতৃত্ব, কখনও বড় বড় নেতাদের ফোন নম্বর প্রচার করা হয়েছে সরাসরি নালিশ জানানোর জন্য। কখনও বড় নেতা গ্রামে জনসংযোগ করতে গিয়ে এক কথায় পঞ্চায়েত সদস্যদের পদচ্যুত করেছেন। এ সবের ফলে নিজের দলের জনপ্রতিনিধির উপর অনাস্থার প্রকাশ তো ঘটেইছে, পঞ্চায়েতের প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদাও এতে আহত হয়েছে।
এমন অসময়ে তাই একটু ভেবে দেখা চাই, কেন এক সময়ে এত করে চাওয়া হয়েছিল গ্রামের মানুষের সহযোগে গ্রাম-উন্নয়ন? কারণগুলি বহু আলোচিত — এর এক দিকে ছিল আরও স্বচ্ছ, তৎপর, সংবেদনশীল এবং কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা পাওয়ার আগ্রহ, অন্য দিকে ছিল গণতন্ত্রকে আরও গভীরে, মাটির আরও কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ। সবার সঙ্গে মিলে সবার ভালর জন্য কাজ করতে পারলে দরিদ্র, নিঃস্ব মানুষের মনেও সার্থকতার যে বোধ জন্মায়, তার প্রয়োজন পুষ্টি বা শিক্ষা পাওয়ার চেয়ে কম নয়। তবে তাত্ত্বিক আলোচনায় না গিয়ে বরং দেখা যাক, কী করতে পেরেছিল এই ধারণা? ছোটখাট কিছু সুবিধের কথাই ধরা যাক। প্রথম যা চোখে পড়ে তা হল, গ্রামে ছোট-বড় প্রচুর চাহিদা অপূর্ণ রয়ে যায়, কারণ তা কোনও প্রকল্পের অধীনে পড়ে না। গ্রাম উন্নয়ন সমিতি সেগুলোর দিকে তাকিয়েছিল। ধনকুমার হাজরার হিয়ারিং এড একটা দৃষ্টান্ত। আর একটি গ্রামে বাড়ি বাড়ি সমীক্ষা করা হয়েছিল, কোন ছাত্রছাত্রীর কী বই দরকার। যার যেটা প্রয়োজন, সেটা কিনে দেওয়া হয়েছিল। সমষ্টির প্রয়োজনও মেটনো হয়েছে এ ভাবে। ভাটরার পাশে বড়কাশিপুর সংসদে পুকুরের ধারে দেখেছিলাম ‘স্নানাগার।’ তেমন কিছুই নয় — এক চিলতে জমিতে চারটে ইটের দেওয়াল, মাথায় একটা টিনের ছাদ। আব্রুরক্ষার জন্য ওইটুকুই গ্রামের মেয়েদের কাছে কত দরকারি ছিল, গ্রাম উন্নয়ন সমিতির নিজস্ব তহবিল না থাকলে, আর সমিতিতে গ্রামের মেয়েদের কণ্ঠ শোনা না গেলে, তা কি জানা যেত? দক্ষিণ দিনাজপুরের গ্রামগুলিতে ২১৩টি স্নানাগারের খোঁজ মিলেছিল। নিজেদের প্রয়োজন যে তাঁরা নিজেরাই মেটাতে পেরেছেন, সেই তৃপ্তি থেকে জন্মেছিল মেয়েদের আত্মপ্রত্যয়। পঞ্চায়েতের নেতাদের দরজায় হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকলে যা মিলত না।
দ্বিতীয় যা চোখে পড়ে তা হল, গ্রামের মানুষ যদি নিজেরাই প্রতিটি পরিবারের স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পদ এবং অভাব-চাহিদার একটা তালিকা বানান (যে কাজটা হাতে-কলমে করে দেখিয়েছিলেন অধ্যাপক বসু) তা হলে সরকারি অর্থের অপচয় অনেক কমতে পারে। এখন নানা প্রকল্পের জন্য প্রাপক তালিকা তৈরি হচ্ছে, এবং তার প্রতিটিই তৈরি করছে ব্লক স্তরের কোনও দফতর প্রেরিত কর্মীরা। তাতে বিস্তর জল মেশার অভিযোগ উঠছে। সমস্যা হচ্ছে, অনেক সময়ে তালিকা প্রস্তুত করার, বা যাচাই করার কর্মীরা বুঝেশুনেও কিছু করতে পারেন না। যেমন, তিনতলা বাড়ির মালিক যখন পড়শির পোড়ো ঘর বা গোয়াল ঘরের ছবিকে নিজের ঘর বলে চালাতে চান, তখন কর্মীরা নাচার — কীসের ভিত্তিতে আপত্তি করবেন? সেই সঙ্গে, নাম বাদ না দেওয়ার জন্য তাঁদের এমন চাপ দেওয়া হয়, যে তাঁরা বাধ্য হন অনুপযুক্তের নামও তালিকায় লিখতে। গ্রাম সংসদের নিজস্ব পারিবারিক সম্পদের তালিকা তৈরি থাকলে, তার সঙ্গে সরকারি তালিকা মিলিয়ে দেখার মাধ্যমে বহু অনুপযুক্ত ব্যক্তি বাদ পড়তে পারত। অনুদান থেকে প্রশিক্ষণ, সবই পৌঁছতে পারত যোগ্যতর মানুষের হাতে।
সর্বোপরি, গ্রাম সংসদ স্তরে কিছু মানুষ যখন গ্রামের উন্নয়নের কোনও কাজের দায়িত্ব পায়, তখন উন্নয়নের কাজে ‘ওরা-আমরা’ মেরুকরণ কাজ করতে পারে না। সেখানে দলমত নির্বিশেষে এক সঙ্গেই কাজ করার ঝোঁক লক্ষ করা যায়। বস্তুত গ্রাম উন্নয়ন সমিতিতে কে যে কোন দলের, তা ঠাহর করা কঠিন হওয়াটা বড় নেতাদের কাছে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গ্রামীণ স্তরে দু’দশ টাকার দুর্নীতিকে শহুরে নেতারা খুব বড় করে দেখান। কিন্তু গ্রামের স্তরে উন্নয়নের কাজের প্রক্রিয়াতে দুর্নীতি ঢাকা অনেক কঠিন। ব্লক, জেলা স্তরে নেতা-আধিকারিকরা হাত মিলিয়ে পুকুর চুরি করতে পারেন, কেউ তা টের পায় না। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতে দুর্নীতি বরাবরই হয়েছে, কিন্তু দুর্নীতির বিপুলতার জন্য কেন্দ্রের অনুদান এত দীর্ঘ দিন আটকে যাওয়ার ঘটনা আগে ঘটেনি। দুর্নীতির ক্ষতির উপর যোগ হচ্ছে কাজ না পাওয়া, ঘর না পাওয়ার ক্ষতি। গ্রাম ছেড়ে ভিন রাজ্যে কাজে যেতে বাধ্য হচ্ছেন যত মানুষ, সরকারি মতে তাদের সংখ্যা ৩৮ লক্ষ, বেসরকারি মতে সংখ্যাটা তার অন্তত দেড়গুণ। স্বশাসনের ধারণার প্রতি আর একটু শ্রদ্ধাশীল হলে কি এই সঙ্কট দেখা দিত? গ্রামের সম্পদকে গ্রামবাসী কি আর একটু ভাল ভাবে কাজে লাগাতে পারত না?
তবে গ্রাম সংসদ স্তরকে শক্তিশালী করার প্রকল্পটি এ-ও দেখিয়েছিল যে, গ্রামবাসীরা মিলে পরিকল্পনা করা, কাজ করা, হিসাব দাখিল করা — এগুলো ঠিক মতো করতে হলে তাঁদের নিয়ত সহায়তা জোগাতে হবে। সীমিত সময়, সীমিত সাধ্যের প্রকল্পের কর্মীদের পক্ষে যা সম্ভব নয়। এক সময়ে আশা ছিল, রাজনৈতিক কর্মীরাই সেই সহায়তা জোগাবেন। অথবা, গণতন্ত্রের আদর্শে, মানুষের সক্ষমতার আদর্শে অনুপ্রাণিত শাসক দল প্রশাসনিক সহায়তা জোগাবে। এখন স্রোত বইছে উল্টো দিকে। কেবল পঞ্চায়েত কেন, শ্রম থেকে কৃষি, সব বিভাগে তৃণমূল স্তরের যে সরকারি কর্মীদের গ্রামের মানুষের সঙ্গে সংযোগ রেখে কাজ করার কথা, গ্রামবাসীর অসুবিধা-অসহায়তা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, সেই সব কর্মীদের বিডিও কিংবা ডিএম অফিসে ফাইল লেখার কাজ দেওয়া হচ্ছে। না হলে শূন্য রাখা হচ্ছে তাদের পদ। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে নিজের অপ্রাপ্তি, নিজের প্রতি অন্যায়ের বিষয়ে অন্যকে জানানোর একটাই ভাষা রয়েছে গ্রামবাসীর হাতে — হিংসা।
গ্রামবাসীর সক্ষমতার জেরে হিয়ারিং এড পেয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের সেই প্রৌঢ়। গ্রামবাসীর সক্ষমতা যত কমেছে, নিজের কথা নেতাদের কানে পৌঁছনো তত দুঃসাধ্য হয়েছে। নির্বাচনের প্রচার পর্বেও আজ নেতারা মানুষের কথা শুনতে আগ্রহী নন। কেবলই ‘মানুষ সব দেখছে’ ‘মানুষই উত্তর দেবে’ বলে ভোটদাতার মুখে নিজের ইচ্ছেমতো কথা বসিয়ে চলেছেন। যেন নেতা মুখ খুললে আর কারও কিছু বলার থাকতে পারে না, তাই নেতার আর কান খুলে রাখার দরকার নেই। আজ নেতার লক্ষণ দাঁড়িয়েছে — যে একই সঙ্গে বাচাল এবং বধির। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র, স্থানীয় সরকারের স্বাতন্ত্র্য, দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষদের স্বশাসনের দ্বারা উন্নয়ন, এ সব ধারণা নস্যাৎ করার ফল, প্রশাসনের বধিরতা।