বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

ধর্ম যখন বৈষম্যের হাতিয়ার

ধর্ম যখন বৈষম্যের হাতিয়ার

মুর্শিদা খাতুন

photo

মুসলমান পরিবারে আমার জন্ম। আমি বেলডাঙ্গা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। আমার কাজের পরিসর তাই মুসলমান সমাজের মেয়েদের নিয়ে। কোনও বিশেষ ধর্মের সমালোচনা করাটা আমার উদ্দেশ্য নয়। মুসলমান সমাজে মেয়েরা কী অবস্থায় আছে তার একটা চিত্র তুলে ধরব। সেখান থেকে কী ভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়, তার আলোচনা হবে। আলোচনার মধ্যে ‘ধর্ম’ শব্দটা আসবে বারবার। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ধর্ম বিশারদ নই। কেউ আহত হলে, কেউ আমার কথায় কষ্ট পেলে, আমাকে ক্ষমা করবেন।
আমাদের সমাজে মেয়েরা জন্মানোর পর থেকেই বৈষম্যের মুখে পড়ে। মুসলমান পরিবারে একটি মেয়ে জন্মালে আর একটি ছেলে জন্মালে নামকরণের আকিকা অনুষ্ঠান হয়। আকিকা অনুষ্ঠানে কন্যা সন্তানের জন্য একটা খাসি আর পুত্র সন্তানের জন্য দুটো খাসি বরাদ্দ হয়। সেখান থেকেই শুরু হয় বৈষম্য।
সন্তান প্রতিপালনের সময় থেকেই পড়াশোনা বিষয়ে বৈষম্যমূলক ব্যবহার সমাজ থেকে পেতে হয়। গ্রাম অথবা শহর, খেটে-খাওয়া মানুষ থেকে বর্ধিষ্ণু পরিবার, সব ক্ষেত্রেই পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাত মুসলমান সমাজেও রয়েছে। সরকারি স্কুলে যে মেয়েরা পড়তে আসে, তাদের প্রায় নব্বই শতাংশ মেয়েরা অ্যানিমিক। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের পুষ্টির অভাব। তাদের মায়েদের দিকে তাকানো যায় না, বাবারা পরিযায়ী শ্রমিক। মায়েরা কোনও রকমে দু’তিনটে বাচ্চা নিয়ে থাকে। কাজ বলতে বেশির ভাগ বিড়ি শ্রমিক, অন্যের বাড়িতে কাজ করে, না হলে সামান্য সেলাইয়ের কাজ করে জীবন অতিবাহিত করে। যে মেয়েরা কোনও রকমে পড়াশোনা করছে, আমরা তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করি। তবে বেশির ভাগ সময় ধরে রাখতে পারি না। বাধা হয়ে দাঁড়ায় ধর্মের অজুহাত।
অদ্ভুত লাগে, একজন নাবালিকার সংজ্ঞা মুসলমান ধর্মে বদলে যায়। সাধারণ ভাবে মেয়েদের বিয়ের বয়স আঠেরো বছর। কিন্তু মুসলিম ল বোর্ডের যে আইন, তাতে পনেরো পেরোলেই মেয়ে ‘সাবালিকা’ হয়ে যায়। বুঝতে পারি না, এটা কোন ভাবে জায়েজ। মুসলমান পরিবারে জন্মালে মেয়ের পনেরো বছরে সাবালিকা কেন হয়ে যাবে! আসলে তো তখনও তারা নাবালিকা। এমনিতেই পুষ্টির অভাব। তার উপরে নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে হচ্ছে, মা হচ্ছে। বিশেষ করে মুর্শিদাবাদের মতো জেলা থেকে পনেরো বছর বা তার নীচের মেয়েরা মা হচ্ছে, শুনেছি এটা সারা বিশ্বে রেকর্ড। নাবালিকা মায়ের সংখ্যা প্রচুর, গ্রাম-শহর সর্বত্রই। আমরা বাধা দিতে গেলে পুরো সমাজ আমাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। এই সিস্টেমটা আমাদের প্রতিহত করে, কোণঠাসা করে দেয়। আমাদের লড়াই যাতে স্তিমিত হয়ে যায়, তার সব চেষ্টাই করে। আমাদের লড়াই করার জেদের কাছে যখন পারে না, তখন ধর্মীয় আর রাজনৈতিক শক্তি সম্মিলিত হয়ে আমাদের সামনে দেওয়াল তোলে।
সাচার কমিটির রিপোর্টে তথ্য দিয়ে মুসলমানদের সামগ্রিক অবস্থা দেখানো হয়েছে। তবে মুসলমান নারীর অবস্থা নিয়ে এই রিপোর্টে কিছু বিস্তারিত বলা হয়নি। কিছু জায়গার বলা হলেও তা নিয়ে বেশি চর্চা হয়নি। মুসলমান প্রান্তিক শ্রেণীর পরিবারে মেয়েদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। বিশেষ করে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাচ, গান করা কিংবা খেলাধুলার কোনও বিভাগে অংশ নেওয়া, ইত্যাদি বিষয়ে মুসলমান মেয়েদের পরিবারের থেকে আসে ভীষণ আপত্তি। কোনও মেয়ে যদি খেলোয়াড় হয়, তা হলে সে গ্রাম থেকে হিজাব পরে আসে। ব্যাগে করে খেলার পোশাক নিয়ে আসে। খেলার পোশাক পরে প্র্যাকটিস করে। খেলার প্যান্ট পরাটা অপরাধ। ছবি তুলে তার বাবা মার কাছে পাঠানো হয়। তাদের শুনতে হয়, ‘শহরে গিয়ে দেখো, মেয়ে হাফ প্যান্ট পরে কাবাডি প্র্যাকটিস করছে।’
মেয়ে ভাল খেলে রাজ্য স্তরে চান্স পেলে, বা অন্য কোথাও টুর্নামেন্টে যাওয়ার ব্যাপার হলে যেতে দেওয়া হয় না। অজুহাত দেয় যে মেয়ে খারাপ হয়ে যাবে। মেয়ের বিয়ে হবে না। জীবনে একটাই লক্ষ্য, মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে। সেই বিয়েটা কাদের সঙ্গে হচ্ছে? যারা প্রান্তিক পরিবারের ছেলে, নিজেরা শিশুশ্রমের বলি। গ্রামের নাবালিকা মেয়েকে বিয়ে করে রেখে অন্য রাজ্যে কাজে চলে যাচ্ছে। অনেকে বাইরে রাজ্যেও বিয়ে করছে। এরা একাধিক বিয়ে করছে।
আমার মনে হয় ভারতের সব নাগরিক সমান। মুসলমান আইনে ছেলেরা চারখানা বিয়ে করতে পারে, এ নিয়ে আলোচনা করার কোনও জায়গা নেই। সবাই সঙ্কোচ করে কারণ এটা ধর্মীয় বিষয়, এ নিয়ে চর্চা করা যাবে না। ধর্মে আঘাত লাগবে। অথচ আমাদের মেয়েদের প্রাণ চলে যাচ্ছে। ধর্মীয় দুর্বলতাকে হাতিয়ার করে মেয়েদের উপরে এই বৈষম্য চলছে। আর কবে, কখন, কোন মঞ্চে মুসলমান মেয়েদের নিয়ে কথা হবে!
এই প্রান্তিক মেয়েদের পাশে কারা এসে দাঁড়াবে? যারা এই মেয়েদের জন্য একক ভাবে লড়ে যাচ্ছে তাদের পাশে কারা এসে দাঁড়াবে? ‘সেকুলার’ শব্দটিকে ভুল ভাবে বিচার করে মেয়েদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ১৯৩৫ সালে ইংরেজরা পার্সোনাল ল বোর্ড তৈরি করেছিল। বিভাজনের রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সেই নিয়মকে হাতিয়ার করে আজও ভারতের মুসলমান মেয়েদের ধর্মীয় শরিয়তি আইনের বলি করা হবে কেন? সংবিধান কি মুসলমান মেয়েদের জন্য আলাদা?
মুসলমান মেয়েরা পোশাকের কারণে স্কুলে যেতে পারছে না। মেয়েরা স্বেচ্ছায় বোরখা পরে না। পরিবারের অনুমতি পাবে না বলে বাধ্য হয়ে স্কুলে বোরখা বা হিজাব পরে যেতে হয়; না হলে সে স্কুলে আসতে পারবে না। আর তাকে যদি বোরখা পরার জন্য স্কুলে ঢুকতে দেওয়া না হয়, তা হলে সে উন্নত শিক্ষা পাবে কোথা থেকে! হিজাব আর বোরখা পরা নিয়ে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অশান্তি হয়েছে। এই শিশু কন্যারাও ভারতের সন্তান। তাদের শিক্ষাকে সুনিশ্চিত করবে কে? হিজাব, বোরখা পরেই মেয়েরা পড়বে, খেলবে। এই মেয়েদের পাশে বৃহত্তর নাগরিক সমাজ যদি না দাঁড়ায়, এই লড়াই চালানো সম্ভব হবে না।
আমি লড়াই করি বলে আমাকে ‘বেলডাঙার তসলিমা’ বলা হয়। শুধু থামানোর জন্য যত গঞ্জনা। আমি প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে এই মেয়েদের পড়াশোনা, খেলা যাতে চলতে পারে তার সব রকম উপায় বার করি। মেয়েরা খেলে ফুলহাতা জামা পরে। এ ভাবে খেলা যায় না। তা-ও ওরা খেলে। ওরা স্বপ্নপূরণের চেষ্টা করে।
আমাকে, অর্থাৎ একজন মুসলমান নারীকে থামিয়ে দেওয়ার সব রকম চেষ্টা করা হয়। আমার বিরুদ্ধে প্রচার করা হয়; যাতে আমার কথা কেউ না শোনে। আমাকে কোণঠাসা করে দেওয়া হয়। শুক্রবারে নামাজের সময় মাইকে বলে প্রচার করা হয় যে ‘ওই স্কুলে ব্রা-প্যান্ট পরে মেয়েরা কাবাডি খেলে।’ স্থানীয় মানুষ ক্ষেপে যায়, চলে আসে স্কুল ঘেরাও করতে। তাদের মোকাবিলা করতে একা সামনে দাঁড়াতে হয়। পেছনে পনেরোশো-ষোলশো মেয়ে। কেউ রক্ষা করার থাকে না। কে দেবে সুরক্ষা?
টেস্ট পরীক্ষার সময় রোজা রাখলে মেয়েরা অনেক সময় মাথা ঘুরে পড়ে যায় বা অজ্ঞান হয়ে যায়। ধর্মের বিধান আছে অসুস্থ হয়ে পড়লে রোজা ভাঙতে পারবে। ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে-যাওয়া মেয়েদের, মায়েদেরকে এ কথা বোঝালেও তারা বুঝতে চায় না। তখনও গোটা সমাজ চলে আসে আমাদের স্কুল ঘেরাও করতে, আমার বাড়ি ঘেরাও করতে। ‘আপনি কেন রোজা করতে বারণ করেছেন!’
রাজনৈতিক নেতারা ধর্মকে সম্বল করে আমাদের মতো মানুষদের ক্রমাগত ভয় দেখাচ্ছে। আমরা যারা বিকাশ ঘটানো, আলো দেখাবার, শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছি, তাদের গলা টিপে ধরা হচ্ছে। মুসলমান মেয়েরা কী নিদারুণ কষ্টের মধ্যে আছে, সবাই খোঁজ নিন। ছোট ছোট মেয়েদের লুকিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা মা হয়ে যাচ্ছে। তাদের গর্ভপাত করানো হচ্ছে, নাবালিকা মায়েরা বহুমুখী অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে চলেছে। আমার আবেদন, এদের পাশে দাঁড়ান। q
অভয়া মঞ্চের সভায় প্রদত্ত ভাষণ, ১ ডিসেম্বর, ২০২৫

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.