বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
ওরা কি চিরদিনই থেকে যাবে বঞ্চিতের দলে? বয়ে বেড়াবে বঞ্চনার বোঝা? যুগ যুগ ধরে দাবি জানিয়েই কি ক্ষান্ত হতে হবে ওদের? সরকার আসে, বইয়ে দেয় প্রতিশ্রুতির ধারা। কিন্তু শ্রমজীবী মহিলাদের দিন বদলায় না। বিগত তিন দশক ধরে অসংগঠিত শ্রমজীবী মহিলাদের সংগঠন গড়ে তুলেছি। পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাদেরকে নিয়ে রাস্তায় নেমেছি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার পাথরপ্রতিমা ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং মথুরাপুর ব্লকের ঢোলা থেকে অসংগঠিত মহিলাদের নিয়ে যে যাত্রা শুরু করেছিলাম তা পরিব্যাপ্ত হয়েছে উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার সীমান্তবর্তী বাগদা ব্লকের পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েতের একাধিক গ্রামে। নয় নয় করেও কেটে গেছে প্রায় তিনটি যুগেরও বেশি সময়। এক বার বিচার করে দেখুন তো, তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করার সুবাদে একজন সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার সংগঠিত কর্মীরা কত টাকা উপার্জন করেছেন, আর অসংগঠিত কর্মীরা কত টাকা উপার্জন করেছেন? অসংগঠিত শ্রমজীবী মহিলাদের অবস্থা তো আরো শোচনীয়। সম কাজে সম মজুরির যে লড়াই তিন দশক আগে শুরু করেছিলাম আজও অসংগঠিত মহিলাদের মুখে সেই একই শ্লোগান। “সম কাজে সম মজুরি চাই”। “একশ দিনের কাজ দিতে না পারলে আইন মেনে বেকার ভাতা দিতে হবে”। “অবিলম্বে বকেয়া মজুরি দিতে হবে”। “বিড়ি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সুনিশ্চিত করতে হবে”। তিন দশক পরেও অসংগঠিত মহিলা শ্রমিকদের শ্লোগান সবর্স্ব হয়ে থাকতে হচ্ছে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কি হতে পারে? সবচেয়ে বেশি বিস্ময়ের হল বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত যে সমস্ত সমাজকর্মীরা অসংগঠিত মহিলা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির জন্য গলা ফাটায়, তারা নিজেরাও বছরের পর বছর সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে চলেছে।
আমাদের রাজ্যে অসংগঠিত মহিলা শ্রমিকদের একটি বড় অংশই গৃহ পরিচারিকার কাজে যুক্ত। অন্য একটি অংশের কাছে আয়ের বড় উৎস হল একশ দিনের কাজ, যা মূলত পঞ্চায়েতের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। বহু মহিলা বিড়ি বাঁধার কাজের সঙ্গে যুক্ত। অন্যান্য কিছু কাজেও মহিলারা যুক্ত থেকে অসংগঠিত ভাবে কাজ করে। এ ব্যাপারে কিছু কিছু ছবি তুলে ধরছি। উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার গাইঘাটা ব্লকের চাঁদপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের মণ্ডলপাড়া ১ ও ২নং সংসদে অন্তত একশ জন মহিলা শ্রমিক তাদের তিরিশ দিনের বকেয়া মজুরি আজও পায়নি। পঞ্চায়েত, ব্লক অফিস এবং জেলা পরিষদে গিয়েও তারা কোনও সুবিচার পায়নি। রাজ্য বলে, কেন্দ্রের বঞ্চনা, আর কেন্দ্রের অভিমত হল, একশ দিনের কাজের হিসেব না দেওয়ার ফলেই এই অবস্থা। তাহলে ভুগছে কারা? সেই পুরানো প্রবাদের আশ্রয় নিতে হয়, “রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।”
বনগাঁ ব্লকের কালুপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০০ জনেরও বেশি মহিলা শ্রমিক বিগত এক বছরে তাদের বকেয়া মজুরি পায় নি। তাছাড়া ৬টি সংসদের ৩০০রও বেশি মহিলা শ্রমিক কাজের আবেদন করেও বিগত এক বছরের মধ্যে একদিনও কাজ পায় নি। ১৫ দিনের মধ্যে কাজ দিতে না পারলে বেকার ভাতা দেওয়ার কথা একশ দিনের কাজের আইনেই উল্লিখিত আছে। কোথায় সেই ভাতা? একশ দিনের কাজের আইন চালু হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে কোনও অসংগঠিত শ্রমিককে কাজ দিতে না পারার জন্য বেকার ভাতা দেওয়ার নজির অত্যন্ত কম। তাহলে খাতায় কলমে বন্দী এই আইন শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আদৌ কি কোনও কাজে লাগছে? গ্রামাঞ্চলে একশ দিনের কাজের বেশির ভাগটাই হল মাটি কাটার কাজ। এই কাজে মহিলা শ্রমিকরা ১০০–১২০ টাকার বেশি মজুরি পেলে নিজেদের ধন্য মনে করে। অথচ পুরুষদের মাটি কাটার মজুরি এর চেয়ে ঢের বেশি। তাই বলি, বিগত ৩০ বছরেও শ্লোগান সর্বস্ব সম কাজে সম মজুরি বাস্তব রূপ পায়নি। দিনের পর দিন রক্তাল্পতায় ভোগা গ্রামের মহিলাদের শারীরিক সক্ষমতা এক্ষেত্রে প্রশাসনের বিবেচনায় আসে না। বলুন তো, সরকারি, বেসরকারি বা সংগঠিত শ্রেণীর কর্মীরা যখন একই পদে কর্মরত তখন তদের কি ভিন্ন ভিন্ন মাস মাইনে হয়? এখানে কি সবার কাজের যোগ্যতা সমান? শ্রমজীবী মহিলাদের প্রশ্ন অনেক। কিন্তু নিরুত্তর থাকাটাই সরকার ও প্রশাসনের বাহাদুরি বলেই মনে হয়।
উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বনগাঁ ও বাগদা ব্লকে প্রচুর মহিলা শ্রমিক বিড়ি বাঁধার কাজ করেন। এরা সকলেই অসংগঠিত মহিলা শ্রমিক। হাজার বিড়ি বেঁধে ১৫০ টাকার বেশি মজুরি কেউই পায় না। বিড়ি শ্রমিকদের উপর সমীক্ষা চালিয়ে তাদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে আরটিআই করেছি। তার কিছু উত্তর পেলেও অন্য অংশের উত্তর ৬ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও মেলেনি। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিতে বনগাঁ সংসদীয় এলাকায় ৮০,০০০ বিড়ি শ্রমিকের নানা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বলা দরকার, উত্তর ২৪ পরগণা জেলার মসলন্দপুরের কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি অফিস আছে যেখানে বিড়ি শ্রমিকদের জন্য চিকিৎসা পরিষেবা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। আমি এই অফিসে বনগাঁ ও বাগদা ব্লকের বিড়ি শ্রমিকদের নিয়ে ডেপুটেশন দেওয়ার পর ভ্রাম্যমান মেডিকেল ইউনিটের মাধ্যমে গাইঘাটার মণ্ডলপাড়ায় একটি, বাগদা ব্লকের হেলেঞ্চা ও বাগদা গ্রাম পঞ্চায়েতের বিভিন্ন সংসদে ৫টি ভ্রাম্যমান চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থা করেছিলাম ২০২১-২০২২ সালে। পরবর্তী পর্যায়ে নিজাম প্যালেসে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম কল্যাণ দপ্তরের অধিকর্তার সঙ্গে দেখা করে ভ্রাম্যমান চিকিৎসা পরিষেবায় যে সমস্ত ঘাটতি রয়েছে তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়। আমাদের মূল দাবি ছিল, বিড়ি শ্রমিক অধ্যূষিত বনগাঁ ও বাগদা ব্লকে প্রতি সপ্তাহে তিনদিন করে ভ্রাম্যমান চিকিৎসা শিবিরের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাতে উপযুক্ত চিকিৎসা পরিকাঠামো থাকতে হবে। এই ভ্রাম্যমান চিকিৎসা পরিষেবার অন্য একটি বড় দিক হল, এখানে বিনামুল্যে ওষুধপত্র পাওয়া যায়।
অসংগঠিত মহিলা শ্রমিকদের সাতকাহন এখানেই শেষ নয়। এই সমস্ত বিড়ি শ্রমিকদের জন্য ২০১৬-২০১৭ সালে বিনামূল্যে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা ছিল, যাদের ঘর নেই তাদের জন্য আবাস যোজনার টাকা ছিল, জীবনের একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্য বিনামূল্য দীঘাতে হলিডে হোমের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এখন তা অতীত। রাজ্য বা কেন্দ্র কেউই শ্রমজীবী মানষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা ভাবেন না। শ্রমজীবী মানুষের দুর্ভাগ্য হল, তারা আর্থিক ভাবে দুর্বল, পিছিয়ে পড়া শ্রেণী হিসাবে চিহ্নিত, নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাওয়ার মতই অবস্থা। তাদের কাছে ন্যায্য বিচার চাওয়ার জন্য হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট তো দূর অস্ত, নিম্ন আদালতে যাওয়ার মতো ক্ষমতাও নেই।
গ্রামাঞ্চলে এমন কিছু ক্ষেত্রে মহিলা শ্রমিকরা কাজ করে যেখানে দৈনিক পঞ্চাশ টাকা আয় করাও তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য। গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ চাষ-বাস ও পশুপালনের উপর নির্ভরশীল। বনগাঁ ও বাগদা ব্লকের প্রচুর মহিলা পটলে ফুল ছোঁয়ানো অর্থাৎ পরাগ মিলনের কাজ করে। ভোর পাঁচটায় উঠে মাঠে যেতে হয়। সকাল ৮টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। রোদ উঠলে আর কাজ হয় না। একাজে দিনে পঞ্চাশ টাকার বেশি মজুরি পায় না। এতে কি দিন চলে?
এখানকার অনেক মহিলাই আবার পাটের দড়ি বাঁধার কাজে যুক্ত। সেখানেও দৈনিক ৪০ টাকার বেশি আয় হয় না। কিছু কিছু ফড়েরা আছেন, যারা তাদের পাট দিয়ে যান আর তারা দড়ি বেঁধে দেন। কে মালিক, কোথায় থাকেন, এ ধরনের ব্যবসায় কত লাভ হয় তারা তার কিছুই জানে না। ফড়েরা কিছুই বলতে চায় না। এই লোক ঠকানো ও মজুরি কম পাওয়ার ব্যাপারগুলো দেখার জন্য ব্লক অফিসে একজন পরিদর্শক থাকেন। কিন্তু এসব ব্যাপারে তার কোনও ভূমিকা নেই।
অসংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর জন্য সরকারের মাথাব্যথার শেষ নেই। যোজনার পর যোজনা, অনন্ত যোজনা, অফুরান ভাবনা। সামাজিক সুরক্ষা যোজনায় স্বাভাবিক মৃত্যুতে ৫০ হাজার টাকা, দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে ১,০০,০০০ টাকা, মেয়ে বি এ পাশ করলে ২৫ হাজার টাকা, ছেলে দশম/ একাদশ/ দ্বাদশে পড়লে যথাক্রমে এক হাজার/এগারশ/ বারশ টাকা। অথচ এ টাকা পেতে কেটে যায় কাল, প্রাপকের মৃত্যুর সময় আসে ঘনিয়ে, কারও কি বলার আছে এ নিয়ে? শ্রম দপ্তরের খাতায়, প্রকল্পের আইনে অনেক কিছু লেখা থাকে। অথচ স্বাধীনতার ৭৫ বছরেও শ্রমজীবী মহিলাদের জীবন যন্ত্রণার ছবি কতটুকু বদলেছে? এই প্রশ্নটাই বারবার ঘুরে ফিরে আসে আমাদের মত সমাজ কর্মীদের মনে।
এখানেই শেষ নয়? সমাজ কর্মী হিসাবে আরও প্রশ্ন জাগে, মহিলা শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্রে সম্মান, মর্যাদা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে কি? বর্তমানে আর্থিক সংকটের মুখে সংসার চালাতে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই বাচ্চা রেখে কাজে বেরোতে হয়। এই বাচ্চাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা কোথায়? তাই সরকারেরও ভাবার সময় এসেছে, অসংগঠিত মহিলা শ্রমিকদের শিশুদের নিরাপদে রাখার জন্য এই মুহূর্তে ক্রেশের ব্যবস্থা করা কতটা জরুরি?
শপিং মল, মেগামার্ট এঁদের ছুঁয়ে যায় না। ৭৫তম স্বাধীনতার উজ্জ্বল আলোর নিচে এক ফালি অন্ধকার। ওরা থাকে ওধারে। কেন্দ্র-রাজ্য নিরুত্তর। যখন যাঁরা ক্ষমতায়, অনেক আস্ফালন। প্রকল্প, সংকল্পের হুড়োহুড়িতে মহিলা শ্রমিকরা আজও খুঁজে বেড়ায় নিজেদের দারিদ্র্য দূর করার বিকল্প। আমার তিরিশ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা আজও একটু একটু করে অন্ধকারে আলোর চিহ্ন খুঁজে বেড়ায়, সাম্যের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু আর কতদিন? অপেক্ষমান আমরা-ওরা সবাই যে ক্লান্ত!
লেখিকা সাংবেড়িয়া প্রতিকার সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সম্পাদিকা।