বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

পাটশিল্পের প্রতি কেন এই অবহেলা?

পাটশিল্পের প্রতি কেন এই অবহেলা?

নবেন্দু দাশগুপ্ত

photo

রাজ্যে শ্রমনিবিড় শিল্পের মধ্যে অন্যতম হল চট শিল্প। এই শিল্পের উপর দু’লক্ষাধিক শ্রমিক ও কয়েক হাজার পাটচাষির জীবন জীবিকা নির্ভরশীল। চটের বাজারে সঙ্কট বা শ্রমিকদের সমস্যা হলে রাজ্যব্যাপী আলোড়ন হয়। চটকলের বর্তমান অবস্থা বুঝতে হলে কোভিড ও তার পরবর্তী সময়কাল থেকে বিষয়টি দেখতে হবে। উৎপাদনে একদিকে আধুনিক যন্ত্রের আমদানি, অন্যদিকে পরিচালন ব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার টানাপোড়েন চলছে। বাজারে সিন্থেটিক ব্যাগের ছড়াছড়ি যা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে চলেছে। মিলগুলো প্রধানত বস্তা তৈরি করে, উৎপাদনে কোন বৈচিত্র্য নেই। তাই রপ্তানি খুব সামান্য। অথচ পাটজাত পণ্যের বিরাট বাজার আছে যদি চাহিদা অনুযায়ী তাকে আধুনিক রুচিসম্মত ও বৈচিত্র্যময় করে তোলা যায়।

কাজ আছে, শ্রমিক নেই



২৩ ডিসেম্বর ২০২১ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কাজ আছে, তবু চেয়েও শ্রমিক অমিল চটকলে’ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রশ্ন হল নতুন প্রজন্মের বেকার যুবকরা চটকলে ঢুকতে চাইছে না কেন? কর্মরত শ্রমিকদের অবস্থা বুঝতে একটু পিছন ফিরে দেখা যাক। বামফ্রন্টের আমলে শ্রমিকদের এন্ট্রি লেভেল (সর্বনিম্ন মজুরি) মজুরি ২০০২ সালে ১০০ টাকা এবং ২০১০ সালে ১৫৭ টাকা ছিল। অর্থাৎ ৮ বছরে বৃদ্ধি মাত্র ৫৭ টাকা। শ্রমিকরা খুবই কম বেতনে কাজ করতেন। এই সময় থেকেই জুটমিলের কাজের প্রতি অনীহা তৈরি হয়। এরপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে টিএমসি সরকার নির্বাচিত হল। তৃণমূল সরকারের সময় চটকলে এন্ট্রি লেভেল (ন্যূনতম মজুরি) মজুরি ২০১৫ সালে ২৫৮ টাকা, ২০১৯ সালে ৩৭০ টাকা হয় যা অসংগঠিত ক্ষেত্রের মজুরি থেকেও কম, ফলে নতুন প্রজন্মের যুবকরা চটকলে ঢুকছে না। তবে মহিলাদের চটকলের কাজে ঢোকার প্রবণতা বেড়েছে।
২০২৪ সালে চুক্তিতে এন্ট্রি লেভেল (ন্যূনতম মজুরি) মজুরি সামান্য বেড়ে হয় ৪৮৫ টাকা। এই মূল মজুরির উপর মহার্ঘভাতা কার্যকর হয়। বর্তমানে রাজ্যে ১১৩টি নথিভুক্ত জুটমিল আছে। এই মিলগুলোতে যত সংখ্যক শ্রমিক আছেন, তার ১৫-২০ শতাংশেরও কম নথিভুক্ত। হাতে নগদ বেশি অর্থ পাওয়ার জন্যে মিলের সিংহভাগ শ্রমিক বাইরের খাতা বা ভাউচারে কাজ করছেন। নথিভুক্ত শ্রমিকদের বেসিক ও মহার্ঘভাতার উপর অতিরিক্ত (ফ্রিঞ্জ বেনিফিট) ৪৪.৫ শতাংশ টাকা প্রাপ্য। কিন্তু সেটা তাঁরা সময় মতো হাতে পাচ্ছেন না। অ-নথিভুক্ত শ্রমিকদের ফিঞ্জ বেনিফিটের গল্প নেই, তারা শুধু মাত্র মজুরি পান। কোনও রকম সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তারা নেই।
চট শিল্পের বাজার নিশ্চিত, উৎপাদিত পণ্য পুরোটাই কেন্দ্রীয় সরকার কিনে নেয়। মালিকদের কম বিনিয়োগে ঝুঁকি বিহীন নিশ্চিত মুনাফা। চটকলে কর্মসংস্থানের বিরাট সুযোগ আছে। রাজ্য সরকার বিজ্ঞাপন দিয়েছিল এক লক্ষ কর্মীকে মাসোহারা ও থাকার জায়গার সুযোগ করে দিয়ে নিয়োগ করা হবে। কিন্তু বেকার যুবকরা কম মজুরি ও কাজের বোঝার জন্যে চটকলে ঢুকছেন না। প্রতিটি মিলে কর্মরত কর্মীদের অনুপস্থিতি ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে গেল। এমন অবস্থা তৈরি হল যে কর্মীর অভাবেই জুটমিল উঠে যবার উপক্রম হল।
কর্মী ঘাটতিতে ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (ইজমা) এবং শ্রম দপ্তর উভয়েরই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। মিল ও শ্রমিক বাঁচাতে ইউনিয়নগুলো যৌথভাবে শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো পুনর্গঠন, কর্মীদের বর্গীয়করণ, কর্মস্থলে স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশ, বাসস্থানকে আধুনিক বাসযোগ্য করার জন্য মালিকপক্ষ ও শ্রম দপ্তরকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেয়। তখন সংকটের ঘড়ির কাঁটা এতো দ্রুত ঘুরছিল, মালিকপক্ষ মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনায় রাজি হয়ে যায়। তারা মিটিংয়ে জানালেন শ্রমিকদের কিছুটা মজুরি বৃদ্ধি করা হবে। এই প্রস্তাব ছাড়া ইজমার আর কোনও পথ খোলা ছিল না। ২০২২ সালে চটকলের অবস্থা দাঁড়ালো ‘কাজ আছে, শ্রমিক নেই’।
২০২৪ সালে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হল। ২০১৯ সালের চুক্তির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিচারপতি শ্রী প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায়ের (অবসর প্রাপ্ত) পৌরোহিত্যে তিন সদস্যের কমিটি গঠিত হল। এই কমিটি সুপারিশ করে চটকলে ৯০% এবং ২০% অনুপাতে স্থায়ী এবং বিশেষ বদলির অনুপাত বজায় রাখতে হবে। এই সময় শ্রমকমিশনারকে আহ্বায়ক করে এবং শিল্প বিভাগের প্রতিনিধি, আইজেএমএ, নন-আইজেএমএ এবং ছয়টি সেন্ট্রাল ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। বিশেষজ্ঞ কমিটি মজুরি কাঠামোর উন্নতি, পাটকল শ্রমিকদের বর্গীকরণ এবং কাজের অবস্থার উন্নতির জন্যে সুপারিশ করে। ৪টি গ্রেডে কর্মীদের বর্গীকরণ এবং প্রতিটি গ্রেডের অধীনে বেতনের স্কেল প্রবর্তনের পক্ষে কথা বলা হয়।
কমিটির সুপারিশ ছিল দীর্ঘদিনের বকেয়াগুলি দ্রুত মিটিয়ে দেওয়া, গ্র্যাচুইটি স্কিমকে এলআইসি’র সঙ্গে যুক্ত করা, ভবিষ্যনিধি প্রকল্পে মিলের ট্রাস্টি ভেঙে দিয়ে পিএফ দপ্তরের হাতে তুলে দেওয়া ইত্যাদি। প্রায় দু’বছর আলোচনা সাপেক্ষে ৩ জানুয়ারি ২০২৪ সালে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়। গত জানুয়ারি মাসে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির পর থেকেই চটকলে কৃত্রিম সঙ্কট শুরু হয়েছে। মিল কর্তৃপক্ষ চুক্তিকে ছেঁড়া কাগজে পরিণত করার চক্রান্ত শুরু করে দিল।
চুক্তি অনুযায়ী বেশিরভাগ মিল ৭.৫% বর্ধিত ঘর ভাড়াই শুধু দিচ্ছে। কিন্তু চুক্তির অন্যান্য বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছে। চুক্তিতে আছে যারা ১৫ বছর কাজ করছেন তারা ‘স্পেশাল বদলি’ ও যারা ২০ বছর কাজ করছেন তাদের সবাইকে ‘স্থায়ী’ করা হবে। বাসস্থান বাসযোগ্য করার কথাও আছে। মাসে বেসিকে ১৩০ টাকা বৃদ্ধি তাও দিচ্ছে না। গ্রেডেশন এখনো লাগু হয়নি। ফলে ফিটমেন্ট বেনিফিট সেমি স্কিলড ৫ টাকা, স্কিলড ১০ টাকা এবং হাই স্কিলড ১৫ টাকা অতিরিক্ত অর্থ শ্রমিকরা পাচ্ছেন না। মহিলা শ্রমিকদের অবসরের বয়স ৫৫ বছর থেকে বেড়ে ৫৮ হলেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। চুক্তিতে মিলে আধুনিকীকরণের বিষয় লেখা আছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ চুক্তির বেশিরভাগ অংশ কর্যকর করছে না। অধিক উৎপাদনের জন্য নতুন নতুন মেশিন বসাচ্ছে। তাঁত বিভাগে স্বয়ংক্রিয় এস-৪ এবং ভিক্টর লুম দিয়ে শুরু হয়, এখন চেইন বিমিং, ওয়ার্প ওয়াইন্ডিং, স্পিনিং এবং ফিনিশার কার্ড রোল ফিডিং পর্যন্ত আধুনিক মেশিনে কাজ হচ্ছে। পুরোনো তাঁতে একজন তাঁতিকে দুটো তাঁত চালাতে হতো, এস-৪ লুমে একজন তাঁতিকে কোথাও ৬টা বা তার বেশি তাঁত চালানোর লক্ষ্যমাত্রা মিল কর্তৃপক্ষ ঠিক করে দিচ্ছে। স্বয়ংক্রিয় হাই স্পিড লুমে উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
যেখানে চুক্তিতে লেখা আছে প্রডাক্টিভিটি কাউন্সিল বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে ম্যান, মেশিন অনুপাত এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে হবে, কর্তৃপক্ষ অধিক মুনাফার স্বার্থে আধুনিকীকরণ ইচ্ছামত একতরফাভাবে লাগু করছে। কোথাও স্ট্রেট ডিউটি, কোথাও মহিলাদের রাতে কাজ করানো ইত্যাদি যে বিষয়গুলি সব ইউনিয়নের সহমতের ভিত্তিতে হওয়ার কথা, তা মানা হচ্ছে না। বিপরীতে শ্রমিকদের স্বার্থে স্থায়ীকরণ করা, হাজিরা ভাতা দেওয়া, ঠিকা ও ভাউচার প্রথা তুলে দেওয়া, বকেয়া গ্র্যাচুইটি প্রদানের ব্যবস্থা করা, নতুন শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি বীমার সঙ্গে যুক্ত করা, মহিলা শ্রমিকদের যৌন হয়রানি রোধে কর্তৃপক্ষের বিশেষ কোনও হেলদোল নেই। জোরজবরদস্তি করে শ্রমিকদের এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে ট্রান্সফার করানো হচ্ছে। ২০২২ সাল ছিল ‘কাজ আছে, শ্রমিক নেই’। ২০২৪ সালে বিপরীত পরিস্থিতি তৈরি হল ‘শ্রমিক আছে, কাজ নেই’। অর্ডারে ঘাটতি দেখিয়ে মিলে কাজের ঘন্টা ও দিন কমিয়ে দিচ্ছে। অভিজ্ঞ মহলের অনেকেই বলছেন এস ৪ লুম দিয়ে অধিক উৎপাদন হচ্ছে। দিন বা সময় কমানোর জন্য কর্তৃপক্ষ চটকলের স্ট্যান্ডিং অর্ডারের নিয়ম অনুযায়ী লে-অফ দিচ্ছে না।
সমগ্র চটকলে কয়েক দশক জুড়ে নৈরাজ্য জাঁকিয়ে বসেছে। মজুরি থেকে বাসস্থান কোনও কিছুই ঠিক ছিল না। এবারের চুক্তিতে সব প্রশ্নে আলোচনা হয়েছে এবং চটকলকে পূর্ণাঙ্গ শিল্পের রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। চুক্তিতে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, তা সত্ত্বেও বলা যায় সর্বশেষ চুক্তি অন্যবারের থেকে কিছুটা আলাদা।
এক বছর অতিক্রান্ত মালিক পক্ষ চুক্তি কার্যকর করছে না, রাজ্যের শ্রম দপ্তর চুক্তি মানাতে বাধ্য করতে পারছে না। কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রক নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইউনিয়নগুলো মাসে ২০৮ ঘন্টা কাজ এবং চুক্তিকে পুরোপুরি লাগু করার জন্য আবারও গেটে গেটে ধর্ণা, অবস্থান শুরু করেছে। চটশিল্প কাঠামোটাই যখন ধ্বংসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছে তখন মিল ও শ্রমিক বাঁচাতে কেন্দ্রীয় ইউনিয়নগুলো উদ্যোগ নিচ্ছে। ইউনিয়নগুলোর কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ আধুনিক যন্ত্র ও সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর অন্তর্বিরোধ নিরসনে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করে চটকলকে আধুনিক শিল্পের দিকে এগিয়ে দেওয়া।
পরিবেশ বান্ধব পাটজাত পণ্যকে ব্যাপকহারে ব্যবহারের জন্য এবং চটকলের উন্নয়নের স্বার্থে সরকারি স্তরে উদ্যোগ নিতে হবে। বাধ্যতামূলক জুট প্যাকেজিং আইন শুধুমাত্র সরকারি রেশন দোকানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রাখা, খোলা বাজারে সিন্থেটিক ব্যাগে খাদ্যশস্য বিক্রি বন্ধ করা। প্যাকেজিং আইন চালু হলে পাটজাত পণ্যের সঙ্কুচিত বাজার কিছুটা উন্মুক্ত হবে। তাতে জুটমিলে আধুনিকীকরণেও কর্মী নিয়োগ বাড়বে। পাটজাত পণ্যকে বৈচিত্র্যময় করে তোলার সুযোগকে কাজে লাগানো এবং রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য সম্প্রসারিত করা। জুটমিলের হাল ফেরাতে পারে একমাত্র সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.