বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
সাপ কি হাঁচে? বিশেষজ্ঞরা প্রশ্নটা হেসেই উড়িয়ে দেন — ফুসফস আর পাকস্থলীর মধ্যে যে পেশি (ডায়াফ্রাম) থাকার দরকার হাঁচার জন্য, সাপের দেহে সেটা কোথায়, যে সাপ হাঁচবে? তা বলে ‘সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে’ কথাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দীর্ঘ দিনের দেখা-শোনায় ক্রমশ একটা বোধ তৈরি হয়, শ্বাস-প্রশ্বাসে, বা কথাবার্তায়, ঠিক কী বোঝাতে চাইছে উল্টো দিকের জীবটি। এমনকি, বেদে-মশাই একটু পরিপক্ব হলে আগাম বলে দিতে পারেন, সাপ এ বার হাঁচতে চলেছে। তেমনই, যাঁরা লেখালেখি করেন, কিংবা নানা সভা-সমিতিতে ‘বক্তব্য পেশ’ করার জন্য মাঝেমাঝে আমন্ত্রিত হন, তাঁরাও আন্দাজ করতে পারেন, দর্শকমহল থেকে কী প্রশ্ন আসতে চলেছে। উদাহরণ — শ্রমজীবী মানুষের প্রতি যে ব্যবহারটা করে সরকার আর ব্যবসায়ী, তা একটু তথ্য আর গল্প দিয়ে পাঁচজনের সামনে তুলে ধরুন। দেখবেন ও দিক থেকে ছিটকে আসবে প্রশ্ন, ‘কিন্তু সলিউশনটা কী?’
মনে হতে পারে, এ হল আগ্রহের প্রকাশ। বেচারিদের উদ্ধারের উপায় খুঁজতে প্রশ্নকর্তার মন আকুলি-বিকুলি করছে। কিন্তু মন যত পাকে, তত শব্দের অর্থের চাইতে প্রশ্নকর্তার ভুরুর কুঞ্চন, ঠোঁটের বক্রতার অর্থটা প্রকট হতে থাকে। বোঝা যায়, সাপের ফোঁস যেমন হাঁচি নয়, তেমনি এই প্রশ্নও আসলে জিজ্ঞাসা নয়, এ হল অনুযোগ। সমাধান যদি জানা না-ই থাকে, তা হলে প্রশ্ন তোলা কেন? কেন মিথ্যে খুঁচিয়ে ঘা করা?
যিনি অন্যায়কে তুলে ধরবেন তিনি অন্যায় নিরসনের উপায়ও বাতলে দেবেন — এই প্রত্যাশা যেন দেখিয়ে দেয় নাগরিক সমাজের প্রবাহে কতখানি বড় হয়েছে রাজনীতির চড়া। ‘আমাকে বলো, আমি সব সমস্যার সমাধান করে দেব,’ এ হল নেতার কথা। দল, বা দলের সরকার, এখানে ‘ওয়ান স্টপ সলিউশন।’ যে কোনও সমস্যার সমাধানের একটাই শর্ত — ‘আমার মিছিলে যোগ দাও, আমার সংগঠন করো।’ তাতে দোষ নেই, জনসমর্থন আদায় করা দলীয় রাজনীতির কাজ। কিন্তু কী সেই সমাধান, তা পেতে গেলে কার স্বার্থে আঘাত লাগতে পারে, তাতে নতুন কোনও অন্যায় দেখা দেবে কি না, তা খোলাখুলি বিচার করাও রাজনীতিরই কাজ। যদিও দলীয় রাজনীতি সে কথা ভুলতে বসেছে। দলগুলির অভ্যন্তরেও খোলামেলা আলোচনা নিষিদ্ধ। সংসদে বা বিধানসভায় বিতর্কের জায়গা নিয়েছে বয়কট।
এর বিপ্রতীপে দাঁড়ানোর কথা নাগরিক সমাজের। কিন্তু হায়, তার জমি লিজ় নিয়ে রাজনীতির চাষ চলছে। এক একটা মতের এক একটা ঘর, তাদের দরজা-জানলা বন্ধ, কেউ কারও মুখ দেখে না। অথচ, শ্রমজীবী-কৃষিজীবী মানুষের, নারী-দলিত-মুসলিমের যত ক্ষতি, যত অসম্মান, তার সমাধান নির্মাণের প্রথম শর্ত হল সেগুলিকে গণ-আলোচনার জমিতে টেনে নিয়ে আসা। না হলে বোঝা যায় না যে, প্রশাসনিক নীতি আর অর্থনীতির যে সব ব্যবস্থা এমন ঠগ-জোচ্চুরিকে লাইসেন্স দিচ্ছে, সেগুলো আসলে কাদের স্বার্থ রক্ষা করছে। বড় বড় পন্ডিত, পুঁজিপতি আর নেতাদের টিকি কোথায় বাঁধা। অসাম্য চলতে পারছে, তার প্রধান কারণ এই যে তাকে সকলের সামনে, সকলের মধ্যে, বিচারের জন্য তুলে ধরা হচ্ছে না। জাত-পাত, নারী-পুরুষ, কোনও বৈষম্যই ধোপে টেকে না, যখন তাকে আছড়ানো হয় ‘পাবলিক রিজ়ন’ বা সমবেত যুক্তির ঘাটে। যে কোনও সমস্যার মুখোমুখি হলেই যে আজকের শিক্ষিত, সম্পন্ন নাগরিক ‘ওই তো নেতা, ওই তো সরকারি অফিসার, ওখানে যান’ বলে আঙুল তোলে, তার কারণ সে নিজে যুক্তির বৃত্তে ঢুকতে চায় না।
এর সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত গৃহশ্রমিকদের আন্দোলন। ১৬ জুন আন্তর্জাতিক গৃহশ্রমিক দিবস উপলক্ষে রাজ্য সম্মেলনের আগে পশ্চিমবঙ্গ গৃহপরিচারিকা সমিতি কিছু প্রচার চালায়। দেওয়াল লিখন, বক্তৃতা, হ্যান্ডবিলে তাদের দাবি ছিল সবেতন ছুটি, ন্যূনতম মজুরি, পেনশনের ব্যবস্থা, ইত্যাদি। সংবাদে, সমাজমাধ্যমে কিছু লেখালিখিও হল। যে সব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল নাগরিকদের, তার মধ্যে রয়েছে যে, “আমি আমার কাজের লোককে বাড়ির লোক বলেই মনে করি।” অথবা, “ওদের বরেরা তো মদ খেয়ে পেটায়, আমরাই তো বাঁচিয়ে রেখেছি।”
পশ্চিমবঙ্গে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ নারী গৃহশ্রমিক (ই-শ্রম পোর্টালে নাম তুলেছেন বাইশ লক্ষ) যে একটা অন্যায্য ব্যবস্থার ফাঁদে পড়ে বিশ্রামহীন, কাজের নিরাপত্তাহীন, সম্মানহীন একটা ব্যবস্থায় কর্মজীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন, এটা কি এই শিক্ষিত মানুষদের দৃষ্টি এড়াচ্ছে? চুরির মিথ্যা অভিযোগ, যৌন হয়রানির সামনে এই মেয়েরা কতটা অসহায়, কাজের জায়গায় বাথরুম ব্যবহার করতে না দেওয়ায় কতটা বিপন্ন, তা কি মধ্যবিত্ত গৃহস্থ জানে না? জানে বইকি, কিন্তু মুখে ‘বদল চাই’ বললেও বদলের প্রথম পদক্ষেপ সে নেবে না — প্রশ্ন করবে না নিজেকে। গৃহশ্রমিকের সঙ্গে কথোপকথনের শুরু করতেই সে রাজি নয়।
একই ভাবে আর শ্রমিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল আলোচনা এড়াচ্ছে। গৃহশ্রমিকরা শাসক দলের এক বড় দলের নেতার কাছে তাঁদের দাবিপত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি চিঠি দেখেই চেঁচিয়ে বলেছেন, “যাঁদের কথায় আপনারা নাচছেন, তাঁদের বলুন এখানে ও সব হবে না।” কথা শুরুর আগেই শাটার ডাউন। অথচ, শ্রমজীবীর সঙ্কট সমাধানের প্রথম ধাপ নিয়োগকারী এবং নিযুক্তের আলোচনা। মধ্যস্থতা করা কথা রাজনীতির।
সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকলের অংশগ্রহণে আলোচনা, বা ‘পাবলিক ডিসকোর্স’-এর কোনও জায়গা ছিল না। আধুনিক ইউরোপ থেকে ‘পাবলিক স্ফিয়ার’ বা জনপরিসরের ধারণা এসেছে ভারতে। গোড়ায় অল্প কিছু শিক্ষিত মানুষের পরিসর হলেও, ক্রমে তা বিস্তৃত হয়েছে। বাংলার রেনেসাঁসের একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল গণ-আলোচনার প্রবর্তন। তার আধার ছিল সংবাদপত্র, মাসিক পত্রিকা। উনিশ শতকে বিধবা মহিলারা বিদ্যাসাগরকে সমর্থন করে চিঠি লিখছেন, গণিকারা প্রতিবাদ করছেন কলকাতা থেকে তাঁদের উচ্ছেদের চেষ্টার, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহের বিরোধিতায় মেয়েরাও কলম ধরছেন। কৈবর্ত সমাজ, মুসলিম সমাজ তাদের নিজস্ব পত্রিকা বের করছে। বিশ শতকে এসে বেরোচ্ছে ‘শ্রমিক’ (১৯২৪) ‘লাঙল’ (১৯২৫) পত্রিকা। রক্ষণশীলতার সঙ্গে প্রগতিবাদের লাঠালাঠি চলেছে।
এর অধিকাংশই হয়তো মামুলি কথা। কিন্তু মূল্যবান এই ধারণাটা যে, অন্য পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পরে (১৯০৫) যখন উত্তাল হল বাংলা, তখনও রবীন্দ্রনাথ-প্রমুখ কিছু মানুষ বিলিতি-বর্জন, ব্রিটিশ-আক্রমণের উন্মাদনা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে চেয়েছিলেন সমাজের ভিতরে নানা অন্যায়ের দিকে — অস্পৃশ্যতা, সাম্প্রদায়িকতা, নারীবিদ্বেষ, আলস্য, স্বার্থান্ধতা। ইংরেজ তাড়ানোর চাইতে বেশি জোর দিয়েছিলেন স্বদেশি উৎপাদন, সমবায় নির্মাণ, পল্লিগঠন, সাম্প্রদায়িক ঐক্যের দিকে। সহজ সমাধানের খোঁজ পরিহার করতে আহ্বান করেছিলেন।
গান্ধীর প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা সত্ত্বেও আমরা দেখি, গান্ধী যখনই মুক্তির কোনও সহজ সমাধান বাতলেছেন — বিলিতি কাপড় পোড়াও, চরকা কাটো, ইংরেজের শিক্ষা, চাকরি ত্যাগ করো — তখনই তার বিরোধিতা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। একে রাজনৈতিক সমাজ বনাম নাগরিক সমাজের দ্বন্দ্বের একটি রূপ বলেও দেখা চলে। সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বহু মানুষের শক্তি একত্রিত করতে হলে কিছু উপায় — যেগুলি সহজ না হলেও সাধ্যের মধ্যে — চিহ্নিত করতেই হয় নেতাকে। এবং বিশ্বাস তৈরি করতে হয় নেতার শক্তিতে, যাঁর হাতের লাঠি সমুদ্র চিরে পথ করে দিতে পারে জনতাকে। কিন্তু নাগরিক? অসহযোগ গণআন্দোলনের উন্মাদনার সামনে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রায় গোঁয়ারের মতো বলে চলেছেন, চরকা কেটে দেশ স্বাধীন হবে না, অসহযোগ ভারতকে সঙ্কীর্ণ, বিশ্ব-বিচ্ছিন্ন করবে। সমস্যা দেশের মানুষের মনে — গান্ধীর আহ্বানে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম এক মঞ্চে এলেও, নিজেদের মধ্যে তারা এক হয়নি। ব্রিটিশ চলে গেলে তারা কি শান্তিতে একত্র থাকতে পারবে?
কে ঠিক, সেটা প্রশ্ন নয়। কথাটা এই যে, যারা রবীন্দ্রনাথ আর গান্ধীর বই দিয়ে ঘর সাজাচ্ছে, তারাও আজ ভাবতে নারাজ, তার কোন ধারণাগুলি ন্যায়ের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। তাই সে আলোচনা চায় না, কেবল চটজলদি সমাধান চায়। এর সুযোগ নিচ্ছে রাজনীতি। ‘কে চেঁচাচ্ছে রে? ওর জন্য একটা প্রকল্প বানা।’ নারী, দলিত, আদিবাসী, শ্রমজীবীর ‘কল্যাণ’-এর বান ডেকেছে — আজ ভাতা, কাল বিমা, পরশু পেনশন। যেন প্রকল্পই ন্যায়। প্রকল্পই সাম্য। প্রকল্পে নাম লেখানোই উন্নয়ন। মালিক, মহাজন, দালাল, ঠিকাদার, আড়কাঠিদের ফাঁদটি কিন্তু অক্ষত। যেমন সমাজ, তেমন সমাধান।