বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

শতবর্ষ পরেও একই লড়াই করছেন মহিলা আইনজীবীরা

শতবর্ষ পরেও একই লড়াই করছেন মহিলা আইনজীবীরা

মনস্বিতা দে

photo

পেশাগতভাবে একজন আইনজীবী চার ধরনের কাজ করে থাকেন। এক, কোনও কোম্পানী বা দফতরের অধীনে ল’ অফিসার হিসাবে, দুই, ল’ ফার্মে চাকরি, তিন, সিনিয়ারের অধীনে প্র্যাকটিস, চার, স্বাধীন বা আধা-স্বাধীন ভাবে কাজ করা যায়। প্রথম ধরনের পেশায় সেই দফতরের গঠন অনুযায়ী তার বেতন, পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, চিকিৎসার খরচ, মাতৃত্বের ছুটি ইত্যাদির বন্দোবস্ত থাকে। বাকি তিন ধরনের পেশায় সামাজিক সুরক্ষা বলে কিছুই থাকে না। এমনকি কেউ অসুস্থতার কারণে ছুটি নেওয়ার পরে ছুটি কোনও কারণে দীর্ঘ হলে তাঁকে বিনা নোটিশে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে তিনি কোনও আর্থিক ক্ষতিপূরণও দাবি করতে পারেন না। পরবর্তী কাজ খুঁজতে তাঁর যে সময়টুকু লাগবে তা কাটে অর্থাভাবে।
সদ্য পাশ করা আইনজীবী প্রথম যখন ল’ ফার্মে কাজ পান তখন তা শুরু হয় সামান্য মাইনেতে। কলকাতার বিখ্যাত ল’ ফার্মগুলোতে শুরুতে মাসে মাত্র দশ-বারো হাজার টাকা মাইনে দেওয়া হয়। আর ততটা নাম করা ফার্ম না হলে মাইনে শুরু হয় প্রায় সাত হাজার টাকা থেকে। ফলত যদি কলকাতার বাইরে থেকে এসে চাকরিটি করতে হয়, তা হলে যাতায়াত খরচ ধরে মাসের শেষে হাতে কিছুই থাকে না।
খ্যাতনামা সিনিয়রের কাছে কাজ করলে জুনিয়র দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা সাপ্তাহিক স্টাইপেন্ড পান। সিনিয়র তেমন খ্যাতনামী না হলে জুনিয়রের স্টাইপেন্ড দু’শো টাকা থেকে সাতশো টাকার মধ্যে হতে পারে। পারিশ্রমিক দেওয়ার কোনও নির্দিষ্ট হার নেই। ওকালতনামা তৈরি করা বা মামলার জন্য আদালতে গেলে জুনিয়র উকিলরা সিনিয়রের ফি থেকে সাধারণত ১৫ শতাংশের মতো ভাগ পান।
ওকালতিতে কাজের মধ্যে দিয়েই পেশাগত শিক্ষার শুরু। চাকরিক্ষেত্রে অফিসের চৌহদ্দির মধ্যেই থাকতে হলে হাতে-কলমে শেখার সুযোগ যায় কমে। যে সিনিয়রেরা সাপ্তাহিক বা মাসিক মাইনে দেন, তাঁরা জুনিয়রদের বাইরে কাজ করতে দেন না। বিশেষত মহিলা জুনিয়রদের ‘ব্রিফ হ্যান্ডেলিং’ করতেই দেওয়া হয় না। দেখা যায় তিনি চা জলখাবারের বন্দোবস্ত করেন, ক্লায়েন্ট এলে রিসেপশনিস্টদের মতো আপ্যায়ন করেন। দিনের পর দিন এই সব কাজ করতে করতে মেয়েটির ওকালতিটা করাই হয় না। বারো ঘণ্টা বাড়ির বাইরে থেকে, অতি সামান্য মাইনে পেয়ে, তারপরে যদি তিনি কোর্টে গিয়ে মামলাটুকুও না করতে পারেন, তাহলে বাড়ির থেকে স্বাভাবিকভাবেই কাজ ছেড়ে দিতে জোর করা হয়। এর ফলে তাঁদের পড়াশোনা ও কেরিয়ার দুইই মাটি হয়ে যাচ্ছে।
বিবাহিতা আইনজীবীদের ক্ষেত্রে পেশায় থাকা আরও কঠিন। সাধারণত বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি থাকতে শুরু করেন, ‘জুরিশডিকশন’ যায় বদলে। নতুন জায়গায় ‘বার অ্যাসোসিয়েশন’ এর সদস্য হওয়া থেকে সিনিয়রদের সঙ্গে পরিচিতি ও কাজের সুযোগ খোঁজা, সবটাই একেবারে নতুন করে শুরু করতে হয়।
কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে না উকিলদের। বহু ক্ষেত্রে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয়। সারাদিন কাজ করে বাড়ি ফিরেও অনলাইনে মিটিং বা ফোনে যোগাযোগ, এ সব চলতেই থাকে। আর. জি. কর মামলার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে পর দিন কেস ফাইল করতে হবে বলে সারা রাত ধরে কাজ করেছেন মহিলা আইনজীবীরা। বহু ক্ষেত্রেই সন্তানধারণের সময়ে এমন রাতদিন কাজ করতে গিয়ে গর্ভপাত হয়ে যায়। এছাড়া প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে কাজ করার কারণে ‘হাইপার টেনশন’ ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এগুলিকে এই পেশার পেশাগত রোগ বলা চলে।
কর্মস্থলের ন্যূনতম সুবিধাগুলিও পাননা আইনজীবীরা। বহু ক্ষেত্রেই আইনজীবীদের আলাদা শৌচালয় থাকে না। এমনকি নতুন ‘বিচারভবন’ বাড়িটিতেও শৌচালয় নেই। এর ফলেও রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েন অনেকে। তেমনই নেই স্তন্যদানের নিজস্ব ঘর, শিশুদের জন্য ‘ক্রেশ’। এছাড়া কোনও সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হন বহু মহিলা আইনজীবী।
ভারতবর্ষে প্রথম ১৯২৩ সালে মহিলারা আইনত এই পেশার অধিকার পান। সে সময়ও তাঁরা এই একই সমস্যাগুলির সম্মুখীন হয়েছিলেন। আজ একশ বছর পরে যখন সদ্য কলেজের গণ্ডী পেরনো মেয়েটি আইন-জগতের কর্মক্ষেত্রে এসে দাঁড়ায় তখন এই শতাব্দীপ্রাচীন সমস্যাগুলি তার পথরোধ করে। এই অসহনীয় পরিস্থিতিতেও সে পূর্বসূরীদের মতোই চেষ্টা করে যায়, লড়াই করে চলে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.