বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

দেউচা-পাচামির মহিলারা

দেউচা-পাচামির মহিলারা

অভিজ্ঞান সরকার

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ মার্চ, ২০২২— ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় দেউচা-পাচামিতে কয়লাখনি শিল্প গড়ে উঠবে ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণার পরবর্তী তিন মাসে কয়লাখনিকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের উচ্ছেদ, জমি অধিগ্রহণ ও সরকারি কায়দায় উন্নয়নকে ঘিরে যে প্রতিবাদের সূচনা হয়েছে তা তৃণমূলের এক দশকের শাসনকালে তা অভিনব। পরিস্থিতি অনেকটা ২০০৬ সালে সিঙ্গুরে টাটার কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রাথমিক পর্যায়ের সঙ্গে তুলনীয়, সে সময়ও বিধানসভায় বিপুল জনমত নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর বামফ্রন্ট বেসরকারি শিল্পউদ্যোগ স্থাপনে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সিঙ্গুরের কৃষকরা প্রায় অলক্ষ্যে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তাকেই পুঁজি করে মমতা বন্দোপাধ্যায় বাংলার ক্ষমতা দখলের পুনঃপ্রচেষ্টা শুরু করেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের অগণিত কৃষক-মহিলারা মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সমর্থনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, জমি ভিটে মাটি হারিয়ে দিশেহারা অনিশ্চিত জীবনের ভয় থেকে।
২০২২ সালে দেউচা-পাচামি, হরিনশিঙ্গা-দেওয়ানগঞ্জের বাসিন্দা আদিবাসী ও মুসলিম মহিলারা একই অনিশ্চিয়তায় ভুগছেন। তার পূর্বসুরীর মত বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর খেয়াল হয়েছে ওইখানে কয়লা শিল্প করতে হবে। কি ধরনের শিল্প, কত কর্মসংস্থান হবে তার কোনও বৈজ্ঞানিক রূপরেখা নেই। অবাস্তব, মিথ্যা প্রতিশ্রতির বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন সাংবাদিক সম্মেলনে। আর বুলডোজারের আক্রমণের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন ওখানকার মানুষ। অঞ্চলের প্রায় এক তৃতীয়াংশ সাঁওতাল আদিবাসী; এছাড়া রয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষ। সরকার পক্ষ থেকে গ্রামসভার আয়োজন, খনি প্রকল্পের বিবরণ এবং পুনর্বাসন প্যাকেজ উপস্থাপন করে গ্রামসভাগুলির দ্বারা গ্রামবাসীদের কাছ থেকে সম্মতি নেওয়ার আইনি প্রক্রিয়ার একটিও সরকার পালন করেনি। পরিবর্তে, গোপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষজনের কাছ থেকে তথাকথিত সম্মতি আদায় করার একটি বেআইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে। মিডিয়া রিপোর্ট থেকে আরও জানা গেছে যে কৃষকদের গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের দ্বারা নির্মমভাবে দমন করা হচ্ছে। আদিবাসী গ্রামবাসী ও তাদের সমর্থনকারী আন্দোলনকর্মীদের ওপর সন্ত্রাসের চালানো হচ্ছে এবং অনেককেই গ্রেপ্তার করে জেলে রাখা হয়েছে।
আবার গত তিনমাসে একাধিক বার দেওয়ানগঞ্জ – হরিণশিঙ্গাতে কয়লাখনির বিরুদ্ধে স্থানীয় মহিলাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে ছোট খাটো সংঘর্ষ, তৃণমুলের পেটোয়া আদিবাসী নেতাদের ঘিরে ধরা, মিছিল ও মিটিং এ আশি শতাংশের বেশি উপস্থিতি প্রমাণ করে যে মহিলারা এই আন্দোলনের চালিকা শক্তি। মনে রাখা দরকার, এই আন্দোলনের নেতৃত্ব হিসাবে যাদের দেখা গেছে, বেশির ভাগই পুরুষ। বর্তমানেও নেতৃত্বে পুরুষদেরই প্রাধান্য। কিন্তু প্রতিরোধের উদ্দীপনা ও জঙ্গিপনা মহিলাদের মধ্যে অনেক বেশি। উচ্ছেদ বিরোধী যে কোনও আন্দোলনেই এটি এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য বোধহয়। সামাজিক অর্থনৈতিক কারণে, পিতৃতন্ত্রের বাঁধনে গ্রামের মহিলাদের বাইরের জগতে চলাফেরা কম হয়, জমি-ভিটের সঙ্গে আত্মীয়তার টান বেশি। সেই জমি-ভিটে হারানোর বিপন্নতা একরোখা মানসিকতাকে পোক্ত করে। ছেলেরা বেশি সেয়ানা – গ্রাম থেকে মফঃস্বল শহরে যাতায়াতের সুযোগ, ক্লাব সংস্কৃতি, মস্তানি, মদ, বাইক, ডিজে, পাথর খাদানের কাঁচা টাকা – সব মিলে ছেলে ছোকরাদের মূল্যবোধ, নৈতিকতার অবক্ষয় ও বিদঘুটে সংস্কৃতির বিকাশ একসঙ্গে ঘটেছে বিশ্বায়ন পরবর্তী গ্রাম সমাজে, দেউচা পাচামিতেও। ফলে আন্দোলনকারী মহিলারাই আশা ভরসার যায়গা।
কি বলছেন আন্দোলনকারী মহিলারা? দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙ্গার গ্রামগুলিতে সমীক্ষা চালাতে গিয়ে, কয়লা খনি নিয়ে প্রশ্ন করতে গিয়ে অভিনব অভিজ্ঞতা হয়েছে। এক জন মহিলা হয়ত কিছু বক্তব্য রাখছিলেন, তার জোরালো কন্ঠস্বরে পাড়া গমগম করছে যে জমি দেবেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন দু’জন করে ঘর ছেড়ে বেরাতে শুরু করলেন অন্যান্যরা। জমজমাট হয়ে গেল চত্বর। সকলেই নিজের বিরোধিতার কথা নিজের মত করে বলে যাচ্ছেন, কলতানের মতো, নিজস্ব ভঙ্গিতে, এমনকি সাঁওতালিতে, যদিও আমরা বাংলাতেই জিজ্ঞেস করছিলাম। রাগ-ক্ষোভ-যন্ত্রণা কতক্ষণ আর ‘দেকো’দের বিদেশি ভাষায় বলা যায়? একবর্ণও সাঁওতালি না বুঝেও অনুভব করছিলাম বিরক্তি-ঘৃণা-ভয়-বিদ্রোহের উদগিরণ হচ্ছে আমাদের আশে আশে। সাঁওতালদের বাড়িগুলো মাটির, ভিতরে আঙিনা, হাঁস মুরগি ছোট বাচ্চা চড়ে বেরায় সেখানে। বাইরে রাঙানো, বাঁদনা পরবের সময় ওই রঙ করা হয়েছে, যাকে আর্থ কালার বলে তাই দিয়ে। মুসলিম বাড়িগুলির মূলত ইঁটের, প্লাস্টার নাই, সেই বাড়ি থেকেও বেরিয়ে আসলেন কয়েকজন মহিলা, জমি দিতে অনিচ্ছুক। আদিবাসী মহিলাদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাদের স্বর খুবই উৎসাহব্যঞ্জক ছিল। আমরা দেওয়ানগঞ্জে যখন পৌঁছেছিলাম, স্থানীয় নেতারা আমাদের রাম মন্দিরের মাঠে আসতে বলেছিল। জংলা আদিবাসী গ্রামে রাম মন্দির! পৌঁছে দেখি কাঠা দশেক জমি নিয়ে চকচকে এবং কুৎসিত রাম মন্দির তৈয়ার হয়েছে প্রাইমারি স্কুলের মাঠের পাশে, বছর দুয়েক আগে। হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় ফ্যাসিস্টরা বীরভূম তথা বাংলার প্রায় প্রতিটা গ্রামে হনুমান বা রামের মন্দির বানিয়েছে গত কয়বছরে। বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ রোপন হয়েছে সর্বত্র। আদিবাসী মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে মুসলিম মহিলাদের জমি না দেবার, ভিটে না ছাড়ার দৃঢ় উচ্চারণ খানিক স্বস্তি দিয়েছিল।
‘আমরা এখানেই মরব, কোনও দিন যাবো না’ – প্রশ্ন করলাম যদি বাড়ি বানিয়ে দেয়? ‘রানিগঞ্জের ওখানে আদিবাসীদের কি দিয়েছে? আমরা জানি না’! ‘বলেছিল ওখানে চাকরি দিব, ক’জন পেয়েছে? আদিবাসীরা তো ওখানে কয়লা চুরি করে এখন, উচ্ছেদের পর’। ‘ইন্দিরা আবাসের টাকা পাই নাই এতদিন, লাগবেও না, এখানেই থাকবো’। ‘আমাদের মেরে দিক, তারপর খনি করুক, বাড়ি করুক’। ‘এতদিন মিডিয়া কোথায় ছিল, এসপি, ডিএসপি কোথায় ছিল, এখন আমাদের তাড়াতে এসেছে?’
‘তোমরা তো গোটা দেশ বেরাইছো, তোমরা বলো – আমাদের নাতি পুতি আছে, বউ ছেলে মেয়ে আছে, মেরম (ছাগল)- সিম (মুরগি) – গেডে (হাঁস) আছে, আমাদের ওই খুপরি (ছোট ঘর) এর মধ্যে হবে?’ প্রশ্ন করলেন একজন। মমতা বন্দোপাধ্যায়পুনর্বাসন প্যাকেজে আদিবাসী পরিবারগুলির জন্য পাঁচশ স্ক্যোয়ার ফিটের ঘর বরাদ্দ করেছিলেন নভেম্বর মাসে, বিরোধিতার আভাস পেয়ে সদ্য সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন পাঁচশ স্ক্যোয়ার ফিট বাড়িয়ে সাতশ স্ক্যোয়ার ফিট করা হয়েছে – যাঁহা বাহান্ন, তাহাই তিপ্পান্ন।
মুখ্যমন্ত্রী তো বলছেন টাকা দেবে জমি নিলে? ‘এতদিন কিছু দেয় নাই, এখন টাকা দিবে? আমাদের টাকা দরকার নেই, চাষবাস করে খাব’, ‘আমরা আদিবাসী, পাহাড় পর্বত খুলে জমি করব, মমতা আমাদের মত, আদিবাসীর মত পারবে? মমতা আমাদের সঙ্গে আসুক, করুক জমি। আদিবাসী প্রথম শুরু করে জমি করা। না আসতে পারলে বোম ফেলে দিক, আমরা যাব না’।
‘এইখানেই কয়লা, আর অন্য কোথাও কয়লা নাই! যেখানেই আদিবাসী, সেখানেই কয়লা, সেখানেই তেল, সেখানেই সোনা? আপনাদের কোথায় বাড়ি, আপনাদের দেশ যাবো, সেখানেই থাকবো, আপনি এখানে এসে থাকেন। আমরা আপনাদের বাড়ি চলে যাই। রাস্তা নাই, হাসপাতাল দেউচায়, সেগুলো কোনও দিন বানায় নি, এখন এসেছে আমাদের তুলতে?’
‘আমরা ওকে সিংহাসনে বসাইছি, সিংহাসন আমাদের ছেড়ে দিক তো, আমরা জমি ছেড়ে দেব’, বললেন একজন মুসলিম মহিলা। ‘যাদের জমি আছে টাকা পাবে, আমাদের জমি নাই, দিন খাটি, আমরা যাবো কোথায়’? ঐতিহাসিক জমির অধিকারের প্রশ্ন তুললেন উনি।
মহিলাদের সঙ্গে কথোপকথনের কিছু অংশ এখানে দেওয়া হয়েছে এখানে। তাদের শারীরিক ভাষা, উচ্চকিত স্বর প্রায় হিস্টেরিক। এই হিস্টিরিয়াকে অভিবাদন - শাসকের আগ্রাসী হিংসাত্মক দমনের মুখে, সমাজ জুড়ে অসহ্য মেলা-পার্বন-উৎসবের অতিশায্যে, নধরকান্তি শান্তির পায়রার ফরফরানির যুগে দেউচা-পাচামি-হরিনসিঙ্গার মহিলাদের হিস্টেরিক প্রতিস্পর্ধা সামাজিক সুস্থতার দ্যোতক।
পুনশ্চ: কয়লাখনি বিরোধী এই আন্দোলনে কোথাও হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় ফ্যাসিস্ট বিজেপির উপস্থিতি নেই, তাদের দৌড় রাম আর হনুমান মন্দির বানানো পর্যন্ত - কর্পোরেট পুঁজির চামচেগিরি করা ও সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করা।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.