বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
যারা দিনেও ঘুমিয়ে থাকে, মেয়েরা রাত জাগবে শুনে তাদের চটকা ভেঙে গেছে। শুরু হয়েছে বাঁকা মন্তব্য, বিষাক্ত ইঙ্গিত, চোখ রাঙানো।
এক কত্তা বললেন, মেয়েরা রাতে জমায়েত করছে সেলফি তুলতে।
তা হলে আর কী, লজ্জায় সিঁটিয়ে গেলাম। আজ যারা রাত জাগবে, তাদের মধ্যে থাকবে ডাক্তার, নার্স, আশাকর্মী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, ছাত্রী, মজুর, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, শিল্পী, আইনজীবী, আয়া, গৃহপরিচারিকা, শেফ, প্রকাশক, সংসার-সামলানিয়া, সংগঠন-করনেওয়ালি, তাতে কী? তারা যখন মেয়ে, তখন নির্ঘাৎ সেলফি তুলতে এসেছে।
তো, এমন একটা শহর তৈরি করো না ভাইটি, যে শহরে যেখানে ইচ্ছে, যখন ইচ্ছে, সেলফি তোলা যায়। যাতে রাত তিনটেয় খিদিরপুর ডক, কিংবা পোস্তা বাজার, কিংবা পরমা আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলে পোস্ট করতে পারি আমরা, এই মুখ্যু হুজুগে মেয়েরা? বদ মন্তব্য, বদ স্পর্শ, গাড়িতে তোলার জন্য টানাটানি, ধর্ষণ-খুন, এ সব কিছুর ভয় না করে নিজের মুখকে রাখতে পারি শহরের যে কোনও রাস্তার সামনে?
মনে রেখো, আমার সেলফিই শহরের সেলফি। রাজ্যের সেলফি।
আর এক কত্তাবাবু বললেন, মেয়েরা স্বামীর মার সামলাতে পারে না, ধর্ষকের মোকাবিলা করতে যাচ্ছে। এর পর যেন ঘরে মার খেয়ে রাতে ফোন না করে।
আজ্ঞে স্যর, আপনি যদি পুলিশকে নিজের কাজ করতে দিতেন, দলের খুঁটিতে তার টিকি না বাঁধতেন, তা হলে কোনও মেয়েকেই ফোন করতে হতো না নেতাকে। থানায় ফোন করলেই কাজ হতো।
আরও শুনুন, আপনি নিগৃহীতা মেয়েটিরও প্রতিনিধি। দিনে-রাতে যে কোনও সময়ে আপনাকে ফোন করার অধিকার সব মেয়ের আছে। ‘ফোন করবেন না’ বলার অধিকার আপনার নেই।
আরও অনেক কত্তা-গিন্নিমা কীবোর্ডে আঙুল নেড়ে জ্ঞান ঝাড়ছেন। মিছিল-মিটিং করে কিস্যু হয় না। এ সব হুজুগ। অবস্থার পরিবর্তন করতে গেলে আগে এই করতে হবে, ওই করতে হবে। সে সব জরুরি কাজ না করে মিছিল করার মানে হয় না।
ঠিকই বলেছেন স্যর, ম্যাম, মিছিলে গেলেই সব কিছু বদলে যায় না। তবে কিনা, সারা বিশ্বে দেখা গিয়েছে, কোনও কিছু বদল করতে গেলে গোটাকতক মিছিল, গণঅবস্থান করতে হয়। তা ছাড়া পুজোর হুজুগ জমাতে কত টাকাই না দিতে হয়। আমরা বোকারা তো নিজেদের টাকায় হুজুগ করছি। আপনার করের টাকায় মিছিল-সমাবেশ করছি না।
যাঁরা বলছেন, রাত-জাগা মেয়েদের পিছনে আসলে রয়েছে বিজেপি, সিপিএম, অমুক দল, তমুক নেতা, তাঁদের বলি — এ রাজ্যের মেয়েদের পিছনে কেউ নেই, কিছু নেই। আছে শুধু অতল খাদ। সামনে হিংস্র হাত, দু’পাশে কাঁটাবন। নিয়ত-অসম্মান, নিয়ত-হয়রানির উপর আমাদের বসবাস। এই আমাদের অবস্থানের জমি।
মেয়েদের শ্রমের, দেহের ফায়দা তুলেই দেশ চলছে। তাদের সংহতির, সংগঠনের শক্তির সুযোগ কেউ নেওয়ার চেষ্টা করবে না, তা কি হতে পারে? অবশ্যই দলীয় রাজনীতি মেয়েদের ঘাড়ে নানা অ্যাজেন্ডা চাপানোর চেষ্টা করবে।
সেটা বিরক্তিকর, কিন্তু কী করা যাবে? রান্নাঘর পরিষ্কার করতে গেলে আরশোলা বেরোবেই। নর্দমা সাফ করতে গেলে পাঁক।
সুযোগসন্ধানী, স্বার্থান্বেষী, ক্ষুদ্রচিত্ত, ক্যামেরা-লোলুপ মানুষ কিছু আজ রাতের নানা জমায়েতে থাকবেই। তাদের জন্য কে আমাদের ভুল বুঝল, তা নিয়ে আজ আমরা মাথা ঘামাব না। যে বুঝতে চায়, সে ঠিকই বুঝবে। যে চায় না, সে ভুলই খুঁজবে।
আজ আমরা বুঝিয়ে দেব, এ রাত আমাদের রাত। দিনে-রাতে যে মেয়েরা মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়, এ দেশ তাদের দেশ। যারা মেয়েদের ভয় দেখায়, লজ্জা দিতে চায়, ছোট করতে চায়, কলেজ-কারখানা-অফিস থেকে মেয়েদের ঠেলে দিতে চায় বাইরে, এ দেশ তাদের নয়।
যারা মনে করে রাস্তা পুরুষের, মেয়েরা সেখানে এলে লাঞ্ছিত হওয়াই স্বাভাবিক, যারা মনে করে ট্রেনে-বাসে মেয়েদের বুকে-নিতম্বে হাত দেওয়া একটা নির্দোষ আমোদ, যারা মনে করে কাজ করতে গেলে মেয়েদের ‘সতী-সাবিত্রী’ সেজে থাকা চলে না, তাই কুপ্রস্তাব শুনে খেপে উঠলে সেটা মেয়েদের বাড়াবাড়ি, যারা মনে করে যৌন নির্যাতনের নালিশগুলো মিথ্যে অভিযোগ, পুরুষকে বিপদে ফেলার ছক, যারা ভাবে ধর্ষণ-নির্যাতনের যে কোনও অভিযোগ ক’টা টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা যায় — আজ রাতে আমরা জাগব তাদের ধিক্কার দিতে।
কখনও কথা দিয়ে, কখনও নৈঃশব্দ্য দিয়ে আমরা বলব — আরজি কর হাসপাতালে গভীর রাতে আমাদের মেয়েকে তোমরা রক্ষা করতে পারোনি। আজ রাতে আমরা মা হয়ে, বোন হয়ে, বন্ধু হয়ে তাকে ঘিরে রয়েছি। তোমরা যাকে তড়িঘড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিলে, তার দেহের আগুন থেকে জ্বলছে আমাদের মোমবাতির আগুন। শোনো, সে কথা বলছে আমাদের কণ্ঠ দিয়ে। তার অশ্রু, ক্রোধ, তার বাঁচার মরিয়া আকাঙ্ক্ষা, প্রাণ পাচ্ছে যাদবপুরে, অ্যাকাডেমিতে, কলেজ স্ট্রিটে, গড়িয়ায়, রাজ্যের জেলায় জেলায়, মোড়ে মোড়ে। এই দেখো, সে এসে দাঁড়িয়েছে তোমাদের সামনে।
দেখতে পারবে তুমি? বরং ঘরে থাকো, ভাইটি। আজ রাতে রাস্তায় নেমো না।