বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

সুরক্ষার অবহেলায় শ্রমিক মৃত্যু

সুরক্ষার অবহেলায় শ্রমিক মৃত্যু

রুমি গঙ্গোপাধ্যায়

photo

ছেলেবেলায় সাত সকালে ইস্কুল যাওয়ার সময় দেখতাম স্টেশন রোডে বাসরাস্তার ধারে প্রায় শ’খানেক মানুষ উবু হয়ে বসে বিড়ি খাচ্ছে, চায়ের ভাড়ে চুমুক দিচ্ছে। বাবা বলত, ওরা শ্রমিক। অনেক দূর দূর থেকে ভোর রাতের ট্রেন ধরে কাজের খোঁজে শহরে এসেছে। রোজই আসে। কোনও দিন ওদের কাজ মিলত, কোনও দিন মিলত না।
মা একদিন বলত বাগানটা পরিষ্কার করতে হবে। পরের রবিবার সকালে বাবার সঙ্গে যেতাম সেই শ্রমিকদের কাছে। কেউ খোঁজ করলে তারা এগিয়ে আসত। কাজ বুঝিয়ে দরদস্তুর করে মজুরি ঠিক হতো। দিনভর বাগানের কাজ। উৎসুক হয়ে দেখতাম তাঁর কোদাল দিয়ে মাটি কোপানোর কায়দা, সরসর করে গাছে উঠে পড়া। কাজের মাঝে রকমারি গল্প করত। বেলা পড়লে কাজ শেষে মজুরির সঙ্গে খানিক সরষের তেল আদায় করত। তেল মাখতে মাখতে বাড়ির পথ ধরত। আমি ভাবতে বসতাম, লোকটি এবার বাড়ি যাবে, ওর মেয়ে বাবার অপেক্ষায় আছে...।
সে বয়সে জানতাম না, এ দেশের অজস্র শ্রমিক রোজ কাজে বেরোয়। কিন্তু তারা যে বাড়িতে ফিরবে তেমন নিশ্চয়তা নেই। অনেকেই কাজে গিয়ে আর বাড়ি ফেরে না। গত ৩ ফেব্রুয়ারি বানতলায় বর্জ্য পরিষ্কার করতে নেমে নিকাশি নালায় তলিয়ে গেছিলেন ফরজ়েম শেখ, হাসি শেখ এবং সুমন সর্দার। মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা ওরা। দীর্ঘ দিনের অপরিষ্কার নালা সাফাই করাচ্ছিল কলকাতা পুরসভা। প্রথমে এক জন নেমেছিলেন। তিনি উঠছেন না দেখে বাকি দু’জনও পর পর নামেন। তিন জনের কেউ আর ওঠেননি। পরে ডুবুরি নামিয়ে দেহ উদ্ধার হয়। নর্দমার বিষবাষ্পে মারা যান ওরা।
কেন মরে গেল, তার কাটাছেড়া করতে গিয়ে তিন শ্রমিকের ওপরই দায় চাপিয়েছিল পুরসভা। ওরা নাকি সুরক্ষা ব্যবস্থা না মেনেই নেমে গিয়েছিল! এই ঘটনার মাত্র ক’দিন আগে ২৯ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট কলকাতা-সহ দেশের ছ’টি বড় শহরে ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং’ বা ম্যানহোলে মানুষ নামিয়ে সাফাই এর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। বলা হয়েছিল, বিশেষ পরিস্থিতিতে ম্যানহোলে মানুষ নামালে, আগে নিশ্চিত হতে হবে ভিতরে প্রাণঘাতী গ্যাস আছে কি না। এক্ষেত্রে আগে না হলেও তিন শ্রমিকের প্রাণের বিনিময়ে জানা গিয়েছিল ম্যানহোলে বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতি।
সুপ্রিম কোর্টের আরও নির্দেশ ছিল, ম্যানহোলে নামানোর সময় কর্মীকে বিশেষ ধরনের এপ্রন, দস্তানা, গামবুট ও মাস্ক পরতে হবে। ওই শ্রমিকদের জন্য সে সব ব্যবস্থা আদৌ ছিল? নিদেনপক্ষে নালায় নামার আগে কোমরে বাঁধার দড়ি?
নিকাশি নালায় মানুষ নামিয়ে কাজের প্রথা দীর্ঘ দিনের। এতে মৃত্যুর ঘটনা কম নয়। ২০১৩ সালে এই প্রথা নিষিদ্ধ করে আদালত বলেছিল, মানুষকে দিয়ে ম্যানহোল সাফাই, মলমূত্র সাফাই বা বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজ করানো যাবে না। কিন্তু বাস্তব ছবি অন্যরকম। এক জন শ্রমিক তলিয়ে গেলে তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টায় আরও কয়েকজন নামে ও মারা যায় — এমনটাই দস্তুর। সরকারি হিসেবে ২০১৬-২০২৩ সালের মধ্যে তিনশোরও বেশি শ্রমিক ম্যানহোলে প্রাণ দিয়েছেন।
এদের অনেকেরই এই কাজের প্রশিক্ষণ বা পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকে না। মাটি কাটা মজুর বা নির্মাণ কাজ করেন এমন শ্রমিকদেরই প্রয়োজন মতো নামিয়ে দেওয়া হয়। চার বছর আগে কুঁদঘাটে একটি ড্রেনেজ পাম্পিং স্টেশনে পর পর সাত জন শ্রমিক তলিয়ে গিয়েছিলেন। তাতে কার কী যায় আসে! এই কাজ কখনও পুরসভা, কখনও বাণিজ্যিক সংস্থা বা বৃহৎ আবাসন বা ব্যক্তি বিশেষের হলেও এই সব শ্রমিকরা কাজ করেন ঠিকাদারের তত্ত্বাবধানে। তাই দায়টা ঠিক কার তা নির্ণয়ই হয় না। সুপ্রিম কোর্ট শ্রমিক-সুরক্ষার জন্য বিধি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। শ্রমিক-মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ ধার্য করেছে মোটা অঙ্কের অর্থ। অভাবি শ্রমিক বা তার পরিবার এ বিষয়ে অজ্ঞাত। তাই কত জন শ্রমিক বাস্তবে সেই ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন সে আর এক তদন্তের বিষয়।
প্রায়ই শোনা যায় বাজি কারখারনার শ্রমিকের মৃত্যুর খবর। বছর দুই আগে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় দুই মহিলা শ্রমিক অম্বিকা মাইতি ও মাধবি বাগ মারা যান আতশবাজির কারখানায় বিস্ফোরণে। সঙ্গে আরও ৬ জন পুরুষ শ্রমিক। কর্মরত শ্রমিকদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রাস্তায়, মাঠে, পুকুরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনা হল, এর আগেও তিনবার ওই বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছে। ২০০০ সালে দ্বিতীয় বিস্ফোরণে মালিকের নিজের ভাই সহ তিন শ্রমিক মারা যান। সেবার ঘটনা কোর্ট অবধি গড়ায়। পরে জামিন পেয়ে আবার রমরমিয়ে চলতে থাকে কারখানাটি। স্থানীয়দের বক্তব্য ছিল বেআইনি কারখানা সচল রাখতে মালিক প্রয়োজন মতো রাজনৈতিক শিবির পরিবর্তন করে নিতেন। পুলিশের সঙ্গে ভালই যোগ। ফলত কারখানা চালাতে অসুবিধে হয়নি।
যে কোনও সময় মৃত্যু হতে পারে জেনেও শ্রমিকরা কেন সেখানে কাজ করেন? একশো দিনের কাজ বন্ধ। অম্বিকা মাইতি ও মাধবি বাগরা একশো দিনের কাজ করে মজুরি পায়নি। ঘরে অভাব। বাজি কারখানায় দিনের দিন তিনশো টাকা মজুরি মেলে। বাধ্য হয়েই গরিব শ্রমিক জীবন বাজি রেখে বাজি কারখানায় কাজ করে। বিজেপির অভিযোগ, ‘একশো দিনের কাজ’-এ বহু ভুয়ো শ্রমিকের নাম তুলে তৃণমূল টাকা আত্মসাৎ করেছে। অতএব টাকা বন্ধ। অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের গোলকধাঁধায় প্রাণ যায় শ্রমিকের। বিস্ফোরণে শ্রমিক মারা গেলে তা ‘খবর’ হয়। এইটুকুই। গত মাসেই গুজরাতে ১৮ জন ও অন্ধ্রপ্রদেশে ৮ জন মারা গিয়েছে। কিছু দিন ধরপাকড় চলে। সময়ের নিয়মে সব এক সময় থিতিয়ে পড়ে। বাকি সব কারখানা নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে আগের মতোই চলতে থাকে। গত বছর মধ্যপ্রদেশে বাজি কারখানায় সাত শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আহত ১৭৪ জন। তদন্তে জানা গিয়েছিল বারুদ বোঝাই কারখানাটিতে কোনও অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থাই ছিল না। তবে এই বাজারে মজুরির টাকা বকেয়া থাকবে না, এই আশায় স্থানীয় বহু মানুষ সপরিবারে ওই কারখানায় কাজ করতেন।
শ্রমিক মৃত্যুর আর এক ফাঁদ বৈদ্যুতিক খুঁটি। গত ফেব্রুয়ারিতে রাজস্থানে নির্মীয়মাণ বিদ্যুতের টাওয়ার ভেঙে মৃত্যু হয়েছে মালদহের ইংরেজবাজারের বাসিন্দা সামিউল শেখের। হঠাৎ নির্মীয়মাণ টাওয়ারটি ভেঙে পড়ে যায়। টাওয়ারের উপরে ছিলেন সামিউল। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এখানেও সেই সুরক্ষাবিধি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। গত ডিসেম্বরে মধ্যপ্রদেশের সীধী জেলার আমদাদ গ্রামে টাওয়ার ভেঙে মারা যান বাংলার তিন শ্রমিক। গত জুনে একই ভাবে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয় গোয়াতে। আর বাংলাদেশে তো এ ঘটনা প্রায়ই ঘটে।
তবে শ্রমিক মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে নির্মাণশিল্প। তুলনামূলক ভাবে এখানে কাজও বেশি, মৃত্যুও বেশি। দেশ বিদেশে বহু শ্রমিক মারা যান এই কাজে। অনেকে আহত হয়ে পঙ্গু হন। ঘটনা ঘটার পর দেখা যায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই রমরমিয়ে চলছিল কাজ। কলকাতা পুরসভা নিরাপত্তা সংক্রান্ত বেশ কিছু নির্দেশিকা জারি করে রেখেছে। সে নির্দেশিকা আদৌ মানা হয় না, তা বলে দেয় বিবিধ দুর্ঘটনা।
চিনার পার্কের একটি নির্মাণ স্থলে মারা যান বছর পঞ্চাশের এক শ্রমিক। তিনি নির্মাণ সামগ্রী উপরে তোলার একটি যন্ত্র চালাচ্ছিলেন। মাথায় হেলমেট ছিল না। যন্ত্রে গোলযোগ দেখা দিলে সেটির একাংশ ভেঙে শ্রমিকের মাথায় পড়ে। গত ফেব্রুয়ারিতে রাজারহাটে আবাসন তৈরির কাজ চলাকালীন মাটি চাপা পড়েন দুই জন। গত মার্চে তেলেঙ্গনায় ছ-তলা বাড়ি ভেঙে মৃত্যু হল ছয় জন শ্রমিকের। বাংলাদেশে গত বছর কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় সাতশোর বেশি শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে নির্মাণশিল্পে ৮৪ জন।
সম্প্রতি সৌদি আরবের মেগা প্রকল্প ‘দ্য লাইন’কে কেন্দ্র করে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে আইটিভি। ‘কিংডম আনকভারড: ইনসাইড সৌদি আরাবিয়া’ নামের তথ্যচিত্রটিতে দেখানো হয়েছিল সেখানে নির্মাণকাজে ২০১৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রায় ২১ হাজার শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। এরা আফ্রিকা, ভারত, বাংলাদেশ এবং নেপালের বাসিন্দা। দাবি করা হয়েছে, দ্রুত কাজ শেষ করার লক্ষে তীব্র গরমে শ্রমিকদের দিনে ১৬ ঘণ্টা করে খাটানো হচ্ছে। তাতেই বহু শ্রমিক মারা গেছেন। সৌদি আরব যদিও এই তথ্য অস্বীকার করেছে।
কর্মক্ষেত্রে কাজের ঘন্টা নির্দিষ্ট করতে চেয়ে, যথাযথ বিশ্রাম ও মর্যাদা দাবি করে ১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো শহরের শ্রমিকরা রাস্তায় নেমেছিলেন। দেড় শতাব্দী পেরিয়ে শ্রমিক অধিকার নিয়ে নানা আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের মতো দেশে শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা খুবই শোচনীয়। তাঁদের শারীরিক নিরাপত্তাটুকুও প্রশ্নের মুখে, কর্মক্ষেত্রে তা নিশ্চিত করতে পারে না। শ্রমিক-সুরক্ষা কিছু নির্দেশিকার মধ্যে আটকে আছে। কাজের বেলা শ্রমিককে তার ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। সুরক্ষার অবহেলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে পরের দুর্ঘটনা ও শ্রমিকের মৃত্যু কেবল সময়ের অপেক্ষা।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.