বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
এই পত্রিকার আগের সংখ্যায় (মার্চ ২০২৪) ‘শ্রমজীবী সংবাদ’ বিভাগে এক পৃষ্ঠার একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন ছিল, যার শিরোনাম: অন্ধ্রপ্রদেশে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ধর্মঘটের জয়। সংক্ষিপ্ত, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেদনে পরিবেশিত মূল তথ্যটি এক বার স্মরণ করে নেওয়া যাক। অন্ধ্রপ্রদেশের লক্ষাধিক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকা তাঁদের বেতন বৃদ্ধি, অন্যান্য সুযোগসুবিধা বাড়ানো বা চালু করা, কাজের নিরাপত্তা, ইত্যাদি এগারো দফা (পিপল’স ডেমোক্র্যাসি পত্রিকার ২৮ জানুয়ারি সংখ্যার একটি প্রতিবেদন অনুসারে তেরো দফা) দাবি আদায়ের জন্য অনেক দিন ধরে আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। গত ডিসেম্বর থেকে সেই আন্দোলন জোরদার হয়, শুরু হয় অনশন ও ধর্মঘট। ওয়াইএসআর কংগ্রেসের জগনমোহন রেড্ডির নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার এই আন্দোলন ভাঙার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল, অত্যাবশ্যক পরিষেবা রক্ষার নামে ‘এসমা’ জারি করতেও পিছপা হয়নি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী রেড্ডি শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হন। তাঁর সরকার কর্মীদের বেশ কিছু দাবি মেনে নেওয়ার পরে ধর্মঘট শেষ হয়।
ঘটনাটি একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এমনটা যে ঘটতে পেরেছে, সেটাই তো প্রথম কথা। এই সাফল্য কেবল অন্ধ্রপ্রদেশের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের নয়, সারা দেশের শ্রমজীবী মানুষকে ভরসা এবং সাহস দেবে যে, সংগঠিত ভাবে চাপ দিতে পারলে দাবি আদায় করা যায়। কর্মীদের যা প্রকৃত প্রাপ্য, তার থেকে সেই আদায়ের মাত্রা অবশ্যই অনেক কম, মাত্রাটিকে বাড়ানোর জন্য নিরন্তর চাপ সৃষ্টি করে চলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পথ নেই; কিন্তু ঠিক সেই কারণেই, এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনেই, ওই ভরসা এবং সাহস বিশেষ মূল্যবান। আর তাই এই সাফল্যের খবর যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া জরুরি। বস্তুত সেই পৌঁছে দেওয়ার কাজটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড।
দ্বিতীয়ত, এই সাফল্য দেখিয়ে দিল সংগঠনের গুরুত্ব কতখানি। আইএফটিইউ, এআইটিইউসি এবং সিআইটিইউ— তিনটি শ্রমিক সংগঠন এ ক্ষেত্রে একজোট হয়ে সংগ্রাম চালিয়েছে। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর ধর্মঘট ডাকার মধ্যে দিয়ে সেই সংগ্রাম তীব্রতর আকার ধারণ করে। গত ১৭ জানুয়ারি অনির্দিষ্ট কালের জন্য অনশন শুরু হয়, তিন-চার দিনের মধ্যে অনশনরত কয়েক জনের শারীরিক অবস্থা উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে, তখন আমাদের মহান গণতান্ত্রিক দেশের সংবেদনশীল প্রশাসনের পরিচিত রীতিতে মধ্যরাতে পুলিশ পাঠানো হয়, তার পরে সেখানে যা যা ঘটবার সবই ঘটে। কিন্তু সংগঠন ও কর্মীদের মনোবল ভাঙে না, বরং আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে ওঠে, সামাজিক সংগঠন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এককাট্টা হয়। অবশেষে ২২ জানুয়ারি রাত্রে সরকার নত হয়।
তৃতীয় কথা, আন্দোলনের সময়টি তার সাফল্যের পথে অনেকখানি সহায়ক হয়েছে। কেবল লোকসভা নির্বাচন নয়, তার সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধ্রপ্রদেশে বিধানসভার ভোটও আসন্ন। এমন একটা সময়ে লক্ষ মানুষের নাছোড় আন্দোলন চলতে থাকলে এবং বৃহত্তর সমাজ ও রাজনীতির প্রতিনিধিরা ক্রমশই তার পাশে এসে দাঁড়ালে ভোটের অঙ্কে বড় রকমের গোলমাল হতে পারে। অতএব বেগতিক দেখে শাসকরা বোঝাপড়ার পথে এসেছেন। তার জন্য বাড়তি খরচাপাতির বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে। সেটা ভোটের বাজারে বিনিয়োগ। নির্বাচন শিয়রে এসে দাঁড়ালে সেই বিনিয়োগ না করলেই নয়।
এই কার্যকারণসূত্রগুলি কেবল যা ঘটেছে তার তাৎপর্য বুঝতেই সাহায্য করে না, কী ঘটানো সম্ভব এবং কীভাবেই বা— সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেও খুব বড় রকমের সহায় হতে পারে। মনে রাখা দরকার, শ্রমজীবী মানুষের বিভিন্ন বর্গের মধ্যে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকারা নানা দিক থেকেই অন্যতম ‘দুর্বল’ বর্গ বলে বিবেচিত হতে পারে। এ দেশে গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে ‘উদার নীতি’র ভেকধারী নিয়োলিবারেল পুঁজিতন্ত্রের আগ্রাসী অভিযানের দাপটে সামগ্রিক ভাবেই শ্রমিক শ্রেণীর দুর্বলতা উত্তরোত্তর বেড়েছে, শ্রমিকদের যেটুকু অধিকার বা নিরাপত্তা ছিল, গত এক দশকে অতিকায় পুঁজির কুক্ষিগত রাষ্ট্র শ্রম নীতি সংশোধনের নামে সেটুকুও হরণ করতে বদ্ধপরিকর। এই পরিপ্রেক্ষিতে অঙ্গনওয়াড়ির মতো ক্ষেত্রগুলিতে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের অবস্থান, বিশেষত তাঁদের দর-কষাকষির সামর্থ্য, আরও কমে যাওয়া স্বাভাবিক। তাঁরা মেয়ে বলে এই সমস্যা দ্বিগুণ বেশি। এই বিশেষ সমস্যাকে সঙ্গে নিয়ে, অসামর্থ্যের এই বাড়তি কারণগুলিকে অতিক্রম করে যখন তাঁদের আন্দোলন কিছুটা সুফল অর্জন করতে পারে, তখন একটা মৌলিক সত্য নতুন করে প্রমাণিত হয়। সেটা এই যে, ভয়ানক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়েও শ্রমিকরা অগ্রসর হতে পারেন, যদি তাঁদের সংগঠন জোরদার থাকে।
এই সত্যটিই সাম্প্রতিক কালে প্রমাণিত হয়েছে অন্য নানা ক্ষেত্রেও। যেমন পশ্চিমবঙ্গে মিড-ডে মিল ওয়ার্কার বা রন্ধনকর্মীদের লাগাতার আন্দোলনের চাপে পড়ে রাজ্য সরকার শেষ অবধি তাঁদের প্রাপ্য টাকা কিঞ্চিৎ বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। প্রাপ্য এখনও লজ্জাকর রকমের কম, বস্তুত অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু এক দশকে যে বরাদ্দ একেবারেই ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থায় ছিল, হাজার দরবার করেও সরকারি রাজনীতিক এবং আমলাদের নড়ানো যায়নি, দু’বছর ধরে রন্ধনকর্মীদের নাছোড় উদ্যোগের ফলে তা সামান্য হলেও বেড়েছে— এর মূল্য অপরিসীম। এটাও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয় যে এই রাজ্যের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরাও নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে অধুনা বাড়তি উদ্যমে সচল ও সরব হয়েছেন। স্পষ্টতই, এক দিকে রন্ধনকর্মীদের সাফল্য এবং অন্য দিকে অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্যের ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তাঁদের উৎসাহ দিয়েছে, ভরসা দিয়েছে। মূল শিক্ষা এক এবং অদ্বিতীয়: সংগঠন জোরদার রাখা এবং সংগ্রাম জারি রাখা।
আপাতদৃষ্টিতে দুর্বল কর্মীরা সংগঠিত লড়াই চালাতে পারলে যে দর-কষাকষিতে অন্তত কিছুটা সফল হতে পারেন, তার আরও একটি নজির আমরা এই রাজ্যে এবং অন্যত্রও দেখেছি, সে বিষয়ে এই পত্রিকাতেই ইতিপূর্বে কিছু আলোচনাও হয়েছে। খরিদ্দারের কাছে বিভিন্ন ধরনের পণ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিযুক্ত ডেলিভারি কর্মীরা প্রবল শক্তিমান অতিকায় কোম্পানির বিরুদ্ধে কার্যত আইনের কোনও সাহায্য ছাড়াই আন্দোলন চালিয়ে নিজেদের প্রাপ্য বাড়াতে পেরেছেন। লক্ষ্যণীয়, তাঁদের সাফল্যের পিছনেও সংগঠনের সক্রিয়তার পাশাপাশি সময়-নির্বাচনের বড় অবদান ছিল: উৎসবের মরসুমে বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহের কাজ বন্ধ রাখার অস্ত্রটি ব্যবহার করে তাঁরা কোম্পানির কর্তাদের মীমাংসা পথে আসতে বাধ্য করেছেন। যখন যার বিরুদ্ধে যে অস্ত্র কার্যকর হয় তখন সেটা ব্যবহার করতে হবে, এটাই যুদ্ধবিদ্যার গোড়ার কথা, মহাভারতেও তার বিস্তর নজির আছে। অতএব, ভোটের আগে রাজনীতিকদের উপর বিশেষ করে চাপ দিতে হয়, উৎসবের বাজারে পুঁজিমালিকদের উপর।
আবার, সংগঠনের শক্তি যে কেবল শ্রমিক আন্দোলনের চিরাচরিত বিধান এবং রীতি থেকেই আসে না, সামাজিক বাস্তবতার বিভিন্ন পরিসর থেকেই যে তা সংগ্রহ করা যায় এবং কাজে লাগানো যায়, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, আশা কর্মী বা রন্ধনকর্মীদের সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলি তারও মূল্যবান দৃষ্টান্ত। তাঁরা প্রায় সকলেই সম্পূর্ণত মেয়ে। মেয়ে হিসাবে তাঁদের সামাজিক অবস্থান দুর্বল, পুঁজিমালিক এবং সরকার দুই গোত্রের ক্ষমতাবানেরাই সচরাচর যে দুর্বলতার সুযোগ নিতে অতি তৎপর। যেমন ধরা যাক, মিড-ডে কর্মীদের এত কম টাকা কেন দেওয়া হবে, এই প্রশ্নের উত্তরে সরকারি কর্তাদের বলতে শোনা গিয়েছে: ওরা তো স্বেচ্ছাসেবী! এবং এমন একটা ভয়ঙ্কর তঞ্চকতার কথা বলেও তাঁরা পার পেয়ে যেতে পারেন, কারণ আমাদের সমাজও এখনও মনে মনে এই ধারণা পুষে রেখেছে যে মেয়েরা— গরিব ঘরের ‘অশিক্ষিত’ মেয়েরা— রান্নাবান্না বা শিশু পরিচর্যার মতো কাজ করে যেটুকু পায়, সেটাই তো তাদের বাড়তি পাওনা, ওই সব কাজ তো তারা আবহমান কাল ধরে এমনিই করে আসছে!
কিন্তু দেখবার বিষয় হল, ওই মেয়েরা তাঁদের সামাজিক অবস্থানের বাস্তব থেকেই ক্রমশ এক নতুন সংহতির বোধ অর্জন করেছেন। এই বোধ তাঁদের সমবেত কাজের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে, কিন্তু একই সঙ্গে তার পিছনে মেয়ে হিসাবে তাঁদের সামাজিক জীবনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতারও বড় ভূমিকা আছে। আমাদের সমাজে, বিশেষত গ্রামে বা ছোট শহরে শ্রমজীবী ঘরের মেয়েদের পারস্পরিক সংযোগ আজও অনেকটা কার্যকর, নিছক উৎসবে ও ব্যসনে নয়, আটপৌরে জীবনযাত্রার পদে পদে তাঁদের পরস্পরের পাশে দাঁড়াতে হয়, বিপদে-আপদে একসঙ্গে দাঁতে দাঁত চেপে লড়তে হয়, স্থানীয় ক্ষমতাবানদের অত্যাচার এবং অপমান সহ্য করতে হয় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। এই যৌথতাকে কোনও মহান বা দ্বন্দ্বহীন সমবায়-ধর্ম হিসাবে দেখবার রোম্যান্টিক কল্পনায় গা ভাসানোর প্রশ্ন ওঠে না, সমাজজীবনে পারস্পরিক রেষারেষি এবং কলহবিবাদ অবশ্যই বিপুল, কিন্তু সেই সংঘাতও জীবনযাপনের যৌথতারই অঙ্গ। রন্ধনকর্মীরা যখন দল বেঁধে প্রশাসনিক আধিকারিকদের দফতরে বা মহানগরের রাজপথে নিজেদের প্রাপ্য (এবং মিড-ডে মিলের বরাদ্দ) বাড়ানোর লড়াইয়ে নামেন, তাঁদের কথায় ও আচরণে এই যৌথতার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে, যা কেবল শ্রমিক বিক্ষোভের মুষ্টিবদ্ধ হাত তোলার সংহতি নয়, যার ভিতরে নিহিত থাকে লোকসমাজের নিজস্ব ‘সিস্টারহুড’, রোজকার অগণিত দ্বন্দ্ব এবং সহযোগের মধ্য দিয়ে যা শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে।
বলা বাহুল্য, এটা এক ধরনের সমাজবাস্তব থেকে গড়ে ওঠা এক ধরনের যৌথতা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক পরিস্থিতি থেকে যৌথতার নানা ধরন তৈরি হয়, যা সংহতি নির্মাণের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। আরও একবার ডেলিভারি কর্মীদের দিকে নজর দিতে পারি। তাঁদের কাজের ধরনটি আপাতদৃষ্টিতে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে রাখে, কারণ প্রত্যেককে নিজের নিজের মোবাইল বাহিত নির্দেশ অনুযায়ী নিজের নিজের বাহন চালিয়ে নির্দিষ্ট ক্রেতার কাছে পণ্য সরবরাহ করতে হয়। কিন্তু একটু চোখ খোলা রাখলেই দেখা যাবে, তাঁদের এক বড় অংশের ক্ষেত্রে কাজের প্রকৃতিটিই এক ধরনের সামাজিক সংযোগের সূত্র হয়ে উঠতে পারে। অতি বড় উদাসীন নাগরিকও নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে, শহরের সমস্ত অঞ্চলেই বিভিন্ন ধরনের খাবারের দোকানের সামনে বা কাছাকাছি অনেক কর্মী অপেক্ষায় থাকেন— অর্ডার আসার অপেক্ষা অথবা দোকান থেকে অর্ডার মাফিক প্যাকেটটি নেওয়ার অপেক্ষা। এই বিচ্ছিন্ন অপেক্ষার সূত্র ধরেই তাঁদের পারস্পরিক দেখা, মেলামেশা, যোগাযোগ, প্রয়োজনে পরস্পরকে কাজের ক্ষেত্রে বা ব্যক্তিগত জীবনে সহযোগিতার দৃষ্টান্তও বিরল নয়। বছরখানেক আগে প্রকাশিত অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের এক নম্বর আকাশগঙ্গা উপন্যাসে তার কিছু ছবি আছে, যা কেবল সাহিত্যের সত্য নয়, সেই ছবিগুলি অনেকাংশেই লেখকের পর্যবেক্ষণের ফসল, অর্থাৎ বাস্তবের প্রতিমূর্তি। কিন্তু তার বাইরেও সরাসরি প্রমাণ আছে: ডেলিভারি কর্মীদের যে সংগঠিত আন্দোলনের কথা বলেছি, তাঁদের অনেকের দৈনন্দিন সংযোগ না থাকলে সেই আন্দোলন সফল হতো না। সেই সংযোগ থেকে গড়ে-ওঠা বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা তাঁদের আন্দোলনকে শক্তি দিয়েছে, এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে, পুঁজি এবং পুঁজির স্বার্থবাহী রাষ্ট্রের চাপের মুখে ভেঙে না পড়ার সাহস ও সামর্থ্য জুগিয়েছে।
গল্পটা আসলে সহজ এবং স্পষ্ট। বিভিন্ন বর্গের, বিভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক অবস্থান ও কাজের চরিত্র অনুসারে তাঁদের পারস্পরিক সংযোগ গড়ে ওঠে। সেই সংযোগকে সংগঠনের স্তরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করা— এটাই পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আবশ্যিক শর্ত। যাকে ‘রুল অব ক্যাপিটাল’ বা পুঁজির শাসন বলে চিনি, এ দেশে তার স্বরূপ এখন সম্পূর্ণ উন্মোচিত। রাষ্ট্রক্ষমতা এবং অতিকায় পুঁজির মধ্যে আঁতাঁত এক অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। রাষ্ট্রশক্তি— কেবল কেন্দ্রের নয়, পশ্চিমবঙ্গ সহ বহু রাজ্যের সরকারি ক্ষমতা— যাদের হাতে, তারা এই আঁতাঁতের ধারক ও বাহক হিসাবেই সক্রিয়। নিয়োলিবারেল পুঁজির সর্বগ্রাসী শাসনকে প্রতিহত না করতে পারলে এই শক্তির মোকাবিলা অসম্ভব। সেটাই শ্রমজীবী মানুষের রাজনীতির কাজ।
সেই রাজনীতির কোনও পূর্বনির্ধারিত মডেল নেই, থাকতে পারে না, বাস্তব পরিস্থিতির ভিত্তিতেই তাকে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু সেই গড়ে তোলার পথটির নাম অবধারিত ভাবেই বামপন্থা। সুতরাং, বিভিন্ন বর্গের শ্রমজীবীদের স্বার্থ, দাবিদাওয়া এবং সংগ্রামের মধ্যে সংযোগ সাধন করে, সেই সংগ্রামের পিছনে কার্যকর বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যৌথতা ও সংহতির মধ্যে নিহিত সামর্থ্য ও সম্ভাবনাকে যথাশক্তি কাজে লাগিয়ে পুঁজি/রাষ্ট্রের প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির শক্তি সংগ্রহ করার দায়িত্ব বামপন্থীদেরই। ‘জনগণের গণতন্ত্র’কে শ্রমজীবী মানুষের গণতন্ত্র হিসাবে পুনরুদ্ধার করার মধ্যে দিয়েই সেই দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। আমাদের দেশে, বিশেষত আমাদের রাজ্যে বামপন্থী রাজনীতির অনুশীলনে এই সত্যটিকে তার প্রাপ্য মূল্য আজও দেওয়া হয়নি, বিভিন্ন শ্রমজীবী বর্গকে একটা কেতাবি ছকে বেঁধে ফেলে তাদের উপর থেকে চালনা করার চেষ্টা চলেছে। এই ইতিহাস বদলানোর কাজ শুরু করা দরকার।
সে-কাজ শুরু করার পক্ষে এখন সময় অতি প্রশস্ত। আমরা আরও একটা বড় নির্বাচনের মুখোমুখি। এক গভীর অন্ধকারের মুখোমুখি বললেও সম্ভবত ভুল হবে না। ভারতীয় গণতন্ত্রের বর্তমান চিত্রটি যদি উদ্বেগজনক হয়, তবে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে বহুগুণ বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে। বস্তুত, আইনসভা, সংবিধান, নির্বাচন ইত্যাদির সমাহারে গড়ে তোলা গণতন্ত্রের গোটা ব্যবস্থাটাই অতঃপর এক সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদের ঘনতমসায় বিলীন হয়ে যাবে, এমন এক হতাশার সুর আমাদের চার পাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। হতাশা অহেতুক নয়, কিন্তু তা দিয়ে এক পা-ও এগোনো যায় না। এই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়েই আলো খুঁজতে হবে। আলো আছে। একটা নয়, অনেক আলো। কেবল অন্ধ্রপ্রদেশ নয়, কেবল পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা দেশ জুড়ে নানা বিন্দুতে শ্রমজীবীরাই আলো জ্বালাচ্ছেন, জ্বালিয়ে রাখছেন। সেগুলিকে খুঁজে নেওয়া, মিলিয়ে নেওয়া, এগিয়ে চলা— এটাই এখন কাজ।