বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
কলকাতার গার্ডেনরিচে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মাঝরাতে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে নির্মীয়মান বেআইনি বহুতল বাড়ি। পুকুর বুজিয়ে ওই বহুতল নির্মাণ করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ। ঘুমের মধ্যেই বেঘোরে মারা যান ১১ জন হতভাগ্য। আহত হয়েছেন আরো অন্তত ১৫ জন। শ্রেণী পরিচয়ে নিহত ও আহত সকলেই প্রান্তিক শ্রমজীবী। নিহতদের মধ্যে ছিলেন দু’ জন নির্মাণ শ্রমিক – হুগলির ১৮ বছরের শেখ আব্দুল্লা এবং মুর্শিদাবাদের ২৪ বছরের নাসিমউদ্দিন এসেছিলেন ওই নির্মীয়মান বহুতলের কাজ করতে রোজগারের আশায় – সারা দিনের পরিশ্রমের পর ঘুমের মধ্যেই শেষ হয়ে গেলেন। পাশের বস্তির ২ জন মহিলা সামা বেগম (৪৫) ও হাসিনা খাতুন (৬০) সহ ৯ জন নিম্নবিত্ত প্রান্তিক মানুষ ঘুমের মধ্যে বেঘোরে মারা যান। পাঁচতলা ওই নির্মীয়মাণ বাড়ির নীচেই ছিল তাদের টালির ঘর। এটাই যেন এই দেশ ও রাজ্যের হতভাগ্য শ্রমজীবীদের দিনলিপি। তাঁরা মারা যাবেন লকডাউনে দীর্ঘ পথযাত্রায়, তাঁরা মৃত্যু কোলে ঢলে পড়বেন বাহানাগা ট্রেন দুর্ঘটনায়, মিজোরামে বা গার্ডেনরিচে।
গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রোমোটার ও জমির মালিক। নৈপথ্যের আসল অপরাধীরা কি শাস্তি পাবে। ওই প্রোমোটারের সঙ্গে শাসক দলের সম্পর্ক এলাকার মানুষের জানা। বাধা দিতে গেলে হুমকি। প্রতিবাদ করলে নাকি গুলি খাওয়ার ভয়। এলাকার কাউন্সিলার, বিধায়ক, কলকাতার মেয়র থেকে পুরমন্ত্রী সকলেই শাসক দলের। মেয়রের খাসতালুকে ঘিঞ্জি এলাকায় বৈধ নকশা ও অনুমোদন ছাড়াই বহুতল বিল্ডিং তৈরি হয়ে চলেছে। বহুক্ষেত্রেই নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে নির্মাণ হচ্ছে। দুটি বহুতলের মাঝখানের পাঁচ ফুট জায়গার এক চিলতে জমিতে মাথা তুলেছে বেআইনি বিল্ডিং। কোথাও একটি বহুতল বিল্ডিং হেলে পড়ছে পাশের বহুতল বিল্ডিংয়ের গায়ে।
ভোটের আগে নির্মীয়মান বেআইনি বহুতল ভেঙে এত মানুষের মৃত্যুতে শাসকরা স্বভাবতই কিছুটা বেকায়দায়। হামদরদী দেখাতে পুরসভা ও সরকারের কোষাগারের টাকায় নিহত ও আহতের জন্য ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করতে দেরি হয়নি। তৎপরতা দেখাতে গিয়ে পুরসভা পুলিশ নিয়ে হেলে পড়া বিল্ডিংয়ের উপরের দিকের বেআইনি অংশ ভাঙার বদলে একতলার ছাদ ফুটো করে এবং বাসিন্দাদের বিক্ষোভের মুখে পুরসভার কর্মীদের ফিরে যেতে হয়।
নাগরিকদের এক চিলতে আকাশ-আলো-বাতাসের অধিকার ধ্বংস করে বেআইনি নির্মাণ হয়ে চলেছে। ফাঁকা জায়গা, খেলার মাঠ, সরকারি জমি লুঠ হচ্ছে। পুকুর ও জলাভূমি বুজিয়ে, এমনকি পূর্ব কলকাতার জলাভূমি এলাকায় অবাধে নির্মাণ কাজ হয়ে চলেছে। কলকাতা শহরে ৪২২২টি জলাভূমি ও পুকুর ভরাট করা হয়েছে। ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ।
কেবল গার্ডেনরিচ, তোপসিয়া, তিলজলা নয় অবৈধ নির্মাণ, বেআইনি বিল্ডিং, পুকুর বোজানো, লুঠ, কালো টাকা, প্রোমোটার-পুরসভা-পুলিসের অশুভ চক্র কলকাতা, বৃহত্তর কলকাতা থেকে মফস্বল শহরগুলিতে ছাড়িয়ে পড়েছে। শুরু হয়েছিল এই শতাব্দীর প্রথমভাগ থেকে। রুজি-রোজগারের আশায় নগরমুখী মানুষের স্রোত, নগর-আবাসনের ঘাটতি এবং নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবীদের শহর এলায় মাথা গোঁজার স্থান করার আকাঙ্ক্ষা এই ব্যবসার সামাজিক ভিত্তি। স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের ফলে উদ্বাস্তু কলোনির মানুষদের ফ্রি-হোল্ড জমির দলিল দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। শর্ত ছিল একটাই দলিল পাওয়ার পর অন্তত ১০ বছর জমি হস্তান্তর করা যাবে না। কিন্তু সেই সময়সীমা পার হয়ে যাওয়া পর পুরানো উদ্বাস্তু কলোনিগুলিতে প্রোমোটিং ব্যবসা শুরু হয়। ছোট পুঁজির মালিকরা এই ব্যবসায় মুনাফার সম্ভাবনায় বিনিয়োগ করতে শুরু করে। প্রোমোটারদের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে সাধারণ মানুষ ও বাম পার্টিগুলির মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয়।
তৃণমূল শাসনে এই কারবার ফুলে ফেঁপে উঠেছে। বেকার যুবকদের সহজ উপার্জনের রাস্তা হয়ে গেছে। জড়িয়ে পড়েছে ক্লাবগুলি। শাসকদের ছত্রছায়ায় পুরসভা-পুলিসের যোগসাজসে এই কারবারে যুক্ত যুবকরা হয়ে দাঁড়িয়েছে শাসকদের ভোট লুঠের মেশিনারি। অপরাধের উৎস খুঁজতে লুম্পেন পুঁজির উৎস এবং এবং তার সঙ্গে বড় পুঁজির যোগসাজস খুঁজে বার করতে হবে। নিম্নবিত্ত প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের আবাসনের সমস্যার সমাধান এবং বেকার যুবকদের কাজ ও চাকরি সমস্যার সমাধান ছাড়া বেআইনি নির্মাণের অপরাধের মূল উপড়ে ফেলা যাবে না – বেআইনি নির্মাণের কাজে আসা শ্রমিক এবং বস্তিবাসী মানুষের মৃত্যু ও দুর্ঘটনা বন্ধ করা যাবে না। এই অপরাধ বন্ধ করতে প্রয়োজন মানুষের সচেতনতা, সক্রিয় উদ্যোগ এবং সংগঠন।