বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
“বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা।”
কথাগুলো লেখা হয়েছিল শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটকে; সম্ভবত ১৯১৮ থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝে কোনও সময়ে। সত্যিই সিরাজদ্দৌলার সময়ে ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে’ দুর্যোগ কতটা ঘনিয়েছিল, তা ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়। কিন্তু একশো বছর পরে, বর্তমানে যে পশ্চিম বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘন কালো মেঘ জমেছে, তা প্রতিদিনই বোঝা যাচ্ছে।
যাঁরা সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিকভাবে চিরকাল বাঙালি-বিরোধী, এবং প্রথম থেকেই বাংলা ও বাঙালির সর্বনাশকারী ‘বাংলাভাগ’-এর গোঁড়া সমর্থক, তাঁরা হঠাৎ কোমর বেঁধে ‘বাঙালি অস্মিতা’ নিয়ে নাটক শুরু করেছে! যাঁদের নেতৃত্ব বাংলা ভাষা আর বাঙালির মনীষা নিয়ে একেবারেই গণ্ডমূর্খ, এবং ‘বাংলা ভাগ’ উদযাপনে বিশেষ আগ্রহী, তাঁরাও ‘বাংলা ভাষা ও বাঙালি’ নিয়ে ভীষণ তৎপরতা দেখাতে শুরু করেছে!
‘বাংলা ভাগ’-এর সমর্থক এই দুই পক্ষেরই আসল লক্ষ্য বাংলা বা বাঙালি কিছুই না। সোজাসাপ্টা ভাষায়, ২০২৬ সালে পশ্চিম বাংলার বিধানসভা নির্বাচন। “আমরাই বাংলা ও বাঙালির রক্ষাকারী দল” – এটা প্রমাণের সংসদীয় প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ছলে বলে কৌশলে বাঙালি ভোট কতটা কব্জা করা যায়, তারই মহড়া এগুলো।
সারা ভারত জুড়ে যাঁরা বাংলাভাষীদের তাড়াচ্ছে নিজ নিজ রাজ্য থেকে, সেই বিজেপি’র এই ‘বাঙালি প্রেম’-এর প্রতারণা সহ্য করতে হবে? বাংলা ভাষায় কথা বললেই যাঁদের ‘বাংলাদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং সীমান্তের ওপারে বিজেপি সরকারের বিএসএফ তাঁদের ঠেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আর পশ্চিমবাংলার মাটিতে এসে ‘বাঙালি প্রেম’-এর যাত্রাপালা করে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে সব বিজেপি নেতৃত্ব।
এই নব-যাত্রাপালার আরেক শরিক পশ্চিমবাংলার শাসক তৃণমূল কংগ্রেস। তাঁরা গত ১৪ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাঙালি বিরোধী কাজ করে চলেছেন। ক্ষমতায় আসার পর থেকে কখনও ‘সারদা’ বা চাকরি চুরির মতো অর্থনৈতিক জালিয়াতিতে লক্ষ লক্ষ বাঙালি জনগণের সর্বনাশ হয়েছে। সরকার কার্যত চোর-জোচ্চোরদের রক্ষা করতেই যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন এবং এখনও তা-ই করে চলেছেন। ‘মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী’ এপ্রসঙ্গে জানিয়েছেন, “যা গেছে, তা গেছে।” এইসব জালিয়াতিতে সরকারি বিভিন্ন রথী-মহারথীদের নাম জড়িয়েছে। গরু চুরি, বালি চুরি, পাথর চুরি, ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থনৈতিক অপরাধেও নাম জড়িয়েছে শাসক শিবিরের বহু কেষ্টবিষ্টুদের। তাঁদের বিরুদ্ধে ‘দল’ কোনও ব্যবস্থাই নেয় নি। সাম্প্রতিককালে ‘মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী’ বিচিত্র এক যুক্তি হাজির করেছেন – “প্রমাণিত না হলে অভিযুক্ত বলা যায় না”! ‘অভিযুক্ত’দের সম্পর্কে ঠিকঠাক তদন্ত করলেই ‘দোষী’ প্রমাণিত হয়। কিন্তু যদি কোনও অপরাধীকে ‘অভিযুক্ত’ বলাই না যায়, তবে তার বিরুদ্ধে তদন্তের প্রশ্নই ওঠে না! চোর-জোচ্চোরের দল যে কখনও কোথাওই ‘প্রমাণ’ সাজিয়ে রেখে, ‘রসিদ’ কেটে চুরি করে না, তা হয়তো ওনার জানা নেই!
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, লক্ষ লক্ষ বাঙালি তরুণ-তরুণীকে প্রায় মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে এই তথাকথিত ‘বাংলা ও বাঙালি প্রেমী’ শাসকগোষ্ঠী। কোটিকোটি টাকা খরচ করে এমন জাদুর খেল দেখিয়েছেন এঁরা, বাঙালির সর্বনাশকারী জালিয়াতদের কারও টিকিও ছোঁয়া যায়নি; কিন্তু হাজার হাজার নিরপরাধ শিক্ষকের চাকরি চলে গেছে! পরিবার নিয়ে তাঁরা আজ প্রায় মৃত্যুর দোরগোড়ায়! একদিকে অসহায়, সহায়সম্বলহীন, অসংগঠিত লক্ষ লক্ষ বঙ্গবাসী শিক্ষক বাহিনী। অপরদিকে, জনগণের পকেটের টাকায় বলীয়ান সরকার তথা সশস্ত্র রাষ্ট্রশক্তি। এই চূড়ান্ত অসম লড়াই চলছে! চোর-জালিয়াতরা নিশ্চিন্তে, নিরুপদ্রবে জীবন কাটাচ্ছে। আর চাকরি হারানো স্কুল শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা ন্যায়সঙ্গত দাবি তোলায় বারবার পুলিশি হামলার শিকার হচ্ছেন! সমাজে চিরকাল সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় স্কুল শিক্ষকরা নির্লজ্জ পুলিশবাহিনীর এবং সরকারি মদতপুষ্ট লুম্পেনদের হাতে বারবার লাথি-লাঠি খাচ্ছেন, গ্রেপ্তার হচ্ছেন। বাঙালি শিক্ষক সমাজের সামাজিক মর্যাদাকে চরম অসম্মান করছে ‘বাংলা ও বাঙালি’-র স্বঘোষিত রক্ষাকর্তার দল।
অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য থেকে শুরু করে, বাঙালি তথা বাংলাবাসী সমাজকে এক গভীর খাদের ধারে এনে দাঁড় করিয়েছে সরকারি মোড়লরা। বহু চর্চিত ‘অভয়া’ কাণ্ডের কথা এখানে আর নতুন করে বলার দরকার নেই: রাজ্য পুলিশ আর ইউনিয়ন পুলিশের কদর্য ভূমিকা আমরা সবাই দেখেছি। বিজেপি’র ইউনিয়ন সরকার এবং তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সরকার, দুই সরকারের জনবিরোধী ভূমিকাতেই আজ বাঙালির এই বেদনাদায়ক হাল দাঁড়িয়েছে। তারপর, ভোটযুদ্ধে জেতার আগ্রহে দুই বাংলা-বিরোধী গোষ্ঠীই একথা বোঝাতে জান লড়িয়ে দিচ্ছে - “ভয় কিসের? আমরা তো আছি।”
খেয়াল রাখা দরকার, জন্মলগ্ন থেকেই তৃণমূল কংগ্রেস আরএসএস ও বিজেপি’র সমর্থন ও সাহায্যপুষ্ট। বছরের পর বছর বিজেপি মন্ত্রীসভায় পূর্ণ মন্ত্রীত্ব-ও করেছে তৃণমূল কংগ্রেস।
‘গণতান্ত্রিক’ ধ্যাষ্টামো একেই বলে!
পশ্চিমবাংলার সামনে, বর্তমান নরকযন্ত্রণা থেকে উদ্ধার পাবার পথ কী? প্রশ্নটা সত্যিই খুব কঠিন হলেও, মোটা দাগে একটা কথা বলাই যায়।
জনবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির উত্তরসূরি যাঁরা, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠিন লড়াই লড়তে হবে। শুধুমাত্র ভোট-উৎসবের সময়েই না। মাঠে-ময়দানে, কলে-কারখানায়, অফিসে-আদালতে, শিক্ষাঙ্গনে-সাংস্কৃতিক জগতে — সর্বত্র, সার্বিক লড়াই। সহজিয়া পথ কিছু নেই।
ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে যাঁরা কেবল শাসকের দালালি আর জনবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকাই পালন করেছেন; গোরু-গোবর-গোমূত্র নিয়ে চর্চাতেই যাঁরা জীবন কাটিয়েছেন; স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরোধিতাতেই যাঁদের ইতিহাস কলঙ্কিত; সেই আরএসএস-বিজেপি-কে সামাজিকভাবে পরাজিত করতে হবে।
দশকের পর দশক যাঁরা বাংলার বুকে শতসহস্র বাঙালি বামপন্থীদের হত্যা ও অত্যাচার করেছে, সেই রাজনৈতিক শক্তির গর্ভ থেকেই যাদের জন্ম এবং আজও পর্যন্ত যারা নিজেদের সেই পাপ নিয়ে জনগণের কাছে ক্ষমাভিক্ষা করেনি; আজও যাঁরা প্রতিদিন-প্রতিমুহূর্তে বাঙালি সমাজের সর্বনাশ করেই চলেছেন; সেই তৃণমূল কংগ্রেস-এর বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে হবে।
পাশাপাশি, যাঁরা চিরকাল শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন, অত্যাচার সহ্য করেছেন, জেল খেটেছেন, সেই প্রগতিশীল বামপন্থী শক্তির উত্তরসূরিদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েই লড়াই করতে হবে দক্ষিণপন্থী শাসকদের বিরুদ্ধে।
দল-মত-গোষ্ঠীগত ভেদাভেদ থাকলেও, বৃহত্তর অর্থে বামপন্থীরা এমন কোনও শক্তি না যাঁরা কখনোই ভুল বা অন্যায় করেন নি; কিংবা তাঁদের কোনও সীমাবদ্ধতা থাকে না। “মানুষ মাত্রেই ভুল হয়, ভুল হয় না শয়তানের।” বামপন্থীদেরও ‘ভুল’ হয়েছে। কিন্তু দক্ষিণপন্থীরা ‘অপরাধ’ করে; জেনেবুঝে, সচেতনভাবে। তাঁদের নীতি ও পদ্ধতি, কাজকর্ম, সবই জনবিরোধী; সবকিছুই পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষা করে। বামপন্থীদের লড়াইয়ের একটা মূল অভিমুখ থাকে। চিরকাল। দক্ষিণপন্থী প্রশাসন তথা রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করার কথা তাঁদের। জনগণের স্বার্থই তাঁদের স্বার্থ। হাজারো দুর্বলতা আর বিচ্যুতি সত্ত্বেও, বামপন্থীদের সঙ্গে দক্ষিণপন্থী শক্তির মূল তফাৎ জনগণ নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়েই বোঝেন। কোন রাজনৈতিক শক্তির আমলে চুরি হয়েছে আর কারা নিজেরাই চোর-জালিয়াত, তা জনগণ ভাল বোঝেন। শূণ্যগর্ভ ভাষণ এবং এটা-ওটা সুবিধা পাইয়ে দিয়ে, জনগণকে সাময়িকভাবে হয়তো কিছুটা বিভ্রান্ত করা যায়। কিন্তু চিরদিন এই ধাপ্পাবাজি চলে না। ১) লুম্পেনদের জন্য বারবার আদালতে কোটিকোটি টাকা খরচ করা; ২) বাঙালির সর্বনাশকারী জালিয়াতদের একের পর এক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের কেবিনে ভর্তি রেখে বাঁচানোর চেষ্টা; ৩) লুম্পেন-চূড়ামনি নেতাকে ‘বীর’-এর সম্বর্ধনা দেওয়া; ৪) অজানা উৎস থেকে আয়ের টাকায় খোদ কলকাতার সেরা অঞ্চলে ‘গরীব পরিবার’ এর পক্ষে তিরিশ’টির বেশি জমি-বাড়ির মালিক হয়ে যাওয়া – এই সব কিছুই দক্ষিণপন্থী শাসকদের ইন্দ্রজাল! তাই, বামপন্থীদের শক্তি বৃদ্ধি করা এবং তাঁদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দক্ষিণপন্থী শক্তিদের পরাজিত করাই সুস্থভাবে বাঁচার পথ।
বাঙালি জাতির সর্বনাশের অন্যতম প্রধান কারণ ‘বাংলাভাগ’। এই ১৪-১৫ অগাস্টে যে সর্বনাশের ৭৮-তম বার্ষিকী। বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস, দুই শাসকগোষ্ঠীই এই বঙ্গভঙ্গের উদযাপনে তৎপর। বিজেপি’র প্রস্তাবিত তারিখ ২০ জুন; যেদিন অবিভক্ত বাংলার কফিনে শেষ পেরেকটা পোঁতা হয়েছিল: ‘বাংলা ভাগ হবে’ এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আর, তৃণমূল কংগ্রেসের প্রস্তাবিত দিন ‘পয়লা বৈশাখ’; একটা ‘বাঙালি বাঙালি গন্ধ’ মেশানো দিন! কিন্তু মোদ্দা কথাটা হলো, ‘পশ্চিম বাংলার জন্মদিন’ মানেই হলো অবিভক্ত বাংলার মৃত্যুদিন। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি সমাজের ঐক্যবদ্ধ জীবনের অন্তিম দিন। হিন্দু-মুসলমানে সন্দেহ, অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সংঘর্ষ অবিরাম ধারায় বেড়ে ওঠার নব-সূত্রপাতের দিন। ঐক্যবদ্ধ বাঙালি সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভাষিক, রাজনৈতিক অধঃপতনের নব-সূচনার দিন।
এই বেদনাক্লিষ্ট দিনকে যাঁরা ‘উৎসব’-এর দিন হিসাবে পালন করতে পারে, তাঁরা তর্কাতীতভাবে বাঙালি-বিরোধী। এঁরা কোনওমতেই বাঙালি জাতির শুভানুধ্যায়ী হতে পারেন না। এই স্পষ্ট ধারণা নিয়েই বাঙালি জাতিকে এগিয়ে চলতে হবে ভবিষ্যতের দিকে।