বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ অক্টোবর, ২০২১— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তা, দর্শন ও কর্মকান্ডের বিরোধিতা করা যে রাজনৈতিক দলের আদর্শগত বাধ্যবাধকতা, তারাই হয়ে উঠেছে বর্তমান 'বিশ্বভারতী'-র হর্তাকর্তাবিধাতা! তারই খেসারত দিতে হচ্ছে আজকের শিক্ষাজগতকে। সাম্প্রতিক শান্তিনিকেতন তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাস থেকে শুরু করে আজপর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাচিত বর্তমান উপাচার্যের কর্মদক্ষতায় বিশ্বভারতীর নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হয়েছে! অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, গবেষক, ছাত্র-ছাত্রী, কর্মচারীবৃন্দ, আশ্রমিক, প্রতিবেশী - সকলেই যাঁর দক্ষ প্রশাসন (!)-এর ঠ্যালায় অস্থির। যাঁর ঔদ্ধত্য, উন্নাসিকতা ও অভব্যতা বিশ্বভারতীর দীর্ঘকালীন ঐতিহ্যে একেবারেই বেমানান ও অভূতপূর্ব। দেখা যাচ্ছে তাঁর সম্পর্কে একমাত্র খুশি বর্তমান উপাচার্যের নিয়োগকর্তা ও আচার্য, অর্থাৎ, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাশয়। আর, অবশ্যই তাদের স্তাবককূল।
বিশ্বভারতী চিরকালই শাসকের রক্তচক্ষু দেখতে অভ্যস্ত।
ব্রিটিশ আমলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বিশ্বভারতীর বিভিন্ন অধ্যাপক, ছাত্র, অতিথি ইত্যাদিরাও ধারাবাহিকভাবে পুলিশী উপদ্রব থেকে রেহাই পাননি। রবীন্দ্রনাথ এবং প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় সহ বিভিন্ন জনের লেখাপত্র থেকেই এ প্রসঙ্গে বহু সত্য জানা যায়।
পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদের উদয়লগ্নে রবীন্দ্রনাথ যখন তীব্রতম ভাষায় তাঁর ঘৃণা প্রকাশ করেছিলেন (১৯০১), আরএসএস সংগঠনের স্রষ্টা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার তখন নেহাতই এক শিশু। ভারতবর্ষে প্রথমসারির ব্যক্তিত্বগণের মধ্যে রবীন্দ্রনাথই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সে'দিন উপলব্ধি করেছিলেন -
"শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে
অস্ত গেল, হিংসার উৎসবে আজি বাজে
অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিনী
ভয়ংকরী। দয়াহীন সভ্যতানাগিনী
তুলেছে কুটিল ফণা চক্ষের নিমেষে
গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি তীব্র বিষে।
স্বার্থে স্বার্থে বেধেছে সংঘাত, লোভে লোভে
ঘটেছে সংগ্রাম - প্রলয়মন্থনক্ষোভে
ভদ্রবেশী বর্বরতা উঠিয়াছে জাগি
পঙ্কশয্যা হতে। লজ্জা শরম তেয়াগি
জাতিপ্রেম নাম ধরি প্রচণ্ড অন্যায়
ধর্মেরে ভাসাতে চাহে বলের বন্যায়।
কবিদল চিৎকারিছে জাগাইয়া ভীতি
শ্মশানকুক্কুরদের কাড়াকাড়ি-গীতি।" ('নৈবেদ্য' - ৬৪)
স্বাভাবিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, যুদ্ধ-বিরোধী, "ভদ্রবেশী বর্বরতা" এবং "দয়াহীন সভ্যতানাগিনী" বিরোধী রবীন্দ্রনাথ তখন থেকেই ব্রিটিশ শাসকদের বিষ নজরে পড়েন। ১৯০৭, ১৯১০, ১৯১২, ১৯১৫, ১৯২০, ১৯২৫ ইত্যাদি বিভিন্ন সালের সরকারি গোপন রিপোর্ট, আদেশনামা, পুলিশের গোপন রিপোর্ট ও কার্যকলাপ প্রভৃতি থেকেও রবীন্দ্রনাথ এবং শান্তিনিকেতন সম্পর্কে ব্রিটিশের আতঙ্ক পরিষ্কার বোঝা যায়। এমনকি, 'রাজদ্রোহ'-র অভিযোগে জেল খাটা হীরালাল সেনকে শান্তিনিকেতনে চাকরি দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথকে আদালতে হাজিরাও দিতে হয়েছিল। (তপন মল্লিক চৌধুরী-র "পুলিশের নজরদারিতে রবীন্দ্রনাথ" রচনাটি এ'ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।)
পরবর্তীকালে কংগ্রেস রাজত্বেও (গত শতাব্দীর '৭০এর দশকে), শাসকদলের নেতাদের প্রত্যক্ষ মদতে ছাত্রদের উপর সহিংস হামলাবাজি বিশ্বভারতীর ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। 'বাম' শাসনে (বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকে), স্থায়ীকরণের দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থানরত বিশ্বভারতীর অস্থায়ী কর্মীদের উপর পুলিশের আকস্মিক ও নির্দয় লাঠিচার্জ, এমনকি মহিলা কর্মীদেরও শুধুমাত্র পুরুষ পুলিশ দিয়ে নির্মমভাবে লাঠিপেটা করতে দেখেছি চোখের সামনে। বিজেপি শাসনকালে এসে, বারবার পুলিশ ডেকে আন্দোলন দমনের মতো নির্লজ্জ পদক্ষেপ তো এখন দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে উঠেছে!
সকল শাসকদলের আমলে বিশ্বভারতীর অঙ্গনে জনবিরোধী পদক্ষেপের নজির তৈরি হয়েছে, এ'কথা ঠিক। ব্রিটিশ-পরবর্তী যুগে কখনও প্রকাশ্যে তার নেতৃত্বে থেকেছে কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মী বাহিনী, কখনও পুলিশ। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সমসাময়িক ঘটনাবলীর সাথে সে'গুলোর গুণগত ফারাক আছে। কংগ্রেস রাজত্বে কিম্বা সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত 'বাম' আমলে শাসক দলগুলি বিশ্বভারতীর অঙ্গনে নানা অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটালেও, তাঁরা কেউই রবীন্দ্র-বিরোধী ছিলেন না। কিন্তু সঙ্ঘপরিবারের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী আপাদমস্তক রবীন্দ্র-বিরোধী। এটাই বিশ্বভারতীর সমকালীন সংকটের মূল।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন - "ধর্ম যদি অন্তরের জিনিস না হইয়া শাস্ত্রমত ও বাহ্য আচারকেই মুখ্য করিয়া তোলে তবে সেই ধর্ম যত বড়ো অশান্তির কারণ হয় এমন আর কিছুই না।...নিজে ধর্মের নামে পশুহত্যা করিব অথচ অন্যে ধর্মের নামে পশুহত্যা করিলেই নরহত্যার আয়োজন করিতে থাকিব, ইহাকে অত্যাচার ছাড়া আর কোনও নাম দেওয়া যায়না।" (প্রবন্ধ: 'ছোটো ও বড়ো' দ্রষ্টব্য।)
গো-হত্যার অপরাধে বারংবার ঘৃণ্য নরহত্যার আয়োজক শক্তিগুলি সেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকে সমাজ থেকে মুছে ফেলতে সচেষ্ট হবেই।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন -
"ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।...
"পূজাগৃহে তোলে রক্তমাখানো ধ্বজা, —
দেবতার নামে এ যে শয়তান ভজা।...
"ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো,
এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।" (কবিতা: 'ধর্মমোহ')
দেশের বুকে আধুনিক বিজ্ঞান ও ইতিহাসকে নাকচ ক'রে, সর্বদাই উদ্ভট ও অন্ধবিশ্বাস সম্মত 'জ্ঞানের অন্ধকার' বিতরণ করতেই যারা সদা-তৎপর, সেই উগ্র ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক শাসকবর্গ তাদের 'আদর্শগত' কারণেই রবীন্দ্রদর্শনকে মুছে দিতে চাইবে।
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের উদ্যোগে বাংলাভাগের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা যখন তৈরি হয়েছিল, বাঙালি সেদিন গর্জে উঠেছিলো। আন্দোলনের তীব্রতায় ইংরেজ শাসকরা বাধ্য হয়েছিল বাংলা-পার্টিশনের পরিকল্পনা বাতিল করতে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে, ভারতবাসী যাতে হিন্দু-মুসলমানে বিভক্ত হয়ে থাকে, সেই দুরভিসন্ধি নিয়ে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের জন্য জিন্নাহ্-র নেতৃত্বে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ এবং নেহরু-র নেতৃত্বে নিখিল ভারত কংগ্রেস দল একই রকম ভূমিকা নিয়েছিল। মূল নকশা ছিলো ব্রিটিশের; জিন্নাহ্ ছিলো 'দাবি' উত্থাপনকারী; কংগ্রেস তার সমর্থক। আর বাঙালি-বিরোধী আত্মঘাতি ভূমিকা নিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীও। শতশত বছর ধরে হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান ছিলো বাংলার ঐতিহ্য; কিন্তু তার মনে হ'লো, এই দুই ধর্মাবলম্বীরা এক দেশে থাকতেই পারবেনা! তাই, যেকোনও মূল্যে তিনি বাংলাভাগ চেয়েছিলেন; এমনকি 'ভারতভাগ' না হ'লেও। সেই শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা নিয়ে বিজেপি সর্বদাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ এবং গর্বিত! অবিভক্ত ও স্বাধীন বাংলার জন্য বঙ্গীয় কংগ্রেসের সভাপতি শরৎচন্দ্র বসু এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাশিম-দের যৌথ উদ্যোগে সেদিন জল ঢেলেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ অ্যান্ড কোং।
১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল, আবুল হাশিম যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য এবং বঙ্গভঙ্গ প্রসঙ্গ নিয়ে কোনও আলোচনায় তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: "১৯০৫ সালেও বাংলা ভারতের চিন্তানায়ক ছিলো এবং সাফল্যের সঙ্গে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের শক্তির মোকাবেলা করেছিলো। এটা খুবই পরিতাপের বিষয় যে আজকে বাংলা বুদ্ধিবৃত্তিতে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে এবং বিদেশি নেতাদের কাছে চিন্তা ও নির্দেশের জন্য অনুনয় ভিক্ষা করছে। আমি ভেবে আশ্চর্য হই, বাংলার হিন্দুদের কী হলো যাঁরা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আশুতোষ মুখার্জী, চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষচন্দ্র বোস প্রমুখ ব্যক্তির জন্য দিয়েছিলেন।
"ভারতের বর্তমান বৈপ্লবিক চিন্তাধারা তার সূত্রপাতের জন্য বাংলার কাছে ঋণী।… সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার রূপরেখা থেকে আমার এই ধারণা জন্মেছে যে এর উৎসাহ ও উদ্দীপনা ইঙ্গ-মার্কিন কায়েমী স্বার্থবাদী এবং তাদের ভারতীয় মিত্রেরা জুগিয়েছিলো।… বাংলার যুবক হিন্দু ও মুসলমানদের উচিত একতা বজায় রেখে নিজেদের দেশকে বৈদেশিক প্রভাবের শৃঙ্খল থেকে বাংলার বিলুপ্ত পুনরুদ্ধার"…
"বাংলার হিন্দু এবং মুসলমানরা তাঁদের যুগ্ম প্রচেষ্টায় নিজ নিজ অস্তিত্ব বজায় রেখে নিজেদের দেশের প্রকৃতি ও আবহাওয়ার সঙ্গে পূর্ণ সঙ্গতি রক্ষা করে এক অপূর্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিকাশ সাধন করেছিলেন মা মানব বিবর্তনের পৃথিবীর যে কোনও জাতির অবদানের সঙ্গে সহজেই তুলনীয়।"
"বিভক্ত বাংলায় পশ্চিম ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা পশ্চিমবঙ্গ একটি অবহেলিত প্রদেশ, সম্ভবত একটি কলোনিতে পরিণত হবে। বঙ্গভঙ্গের সঙ্গে তাঁরা যতই নিজেদের প্রত্যাশাকে গ্রথিত করুন, এটা আমার কাছে দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, বাংলার হিন্দুরা বিদেশি পুঁজিবাদের দিন মজুরের পর্যায়ে পরিণত হবেন।" ('আমার জীবন ও বিভাগসমূহ বাংলাদেশের রাজনীতি'; আবুল হাশিম, চিরায়ত প্রকাশন, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃ: ১২২-১২৫ দ্রষ্টব্য।)
সঙ্ঘপরিবারের পোস্টারবয় এবং বঙ্গভঙ্গের অন্যতম হোতা শ্যামাপ্রসাদের ভক্তকূলের পক্ষে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের আজীবন সাধক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরোধী না হয়ে উপায় আছে কী?
বর্তমান 'বিশ্বভারতী'-তে সবরকম অপকর্মের পিছনে মূল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মদতদাতা কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের এবং বিশ্বভারতীর 'আচার্য' স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর এক অভূতপূর্ব কর্মকৌশল দেখা যাচ্ছে।
এঁরা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী-র হত্যাকারী 'হিন্দু মহাসভা'-র সহযাত্রী ও সমর্থক; আবার জনগণকে ভুল বোঝাবার জন্য কৌশলগত কারণে গান্ধীর চশমা আজ এদের 'স্বচ্ছ ভারত' অভিযানের প্রতীক! 'আর এস এস'-কে ১৯৪৮ সালে "ঘৃণা ও হিংসার শক্তি" (Forces of Hate and Violence) হিসাবে বেআইনি ঘোষণাকারী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের তীব্র বিরোধী এরা; আবার বর্তমান সময়ে এসে কৌশলগতভাবে 'লৌহপুরুষ' প্যাটেলের ৬০০ ফূট উঁচু বিশ্বের উচ্চতম মূর্তি গড়ারও উদ্যোক্তা! এরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের অন্যতম সেনাপতি সুভাষচন্দ্র বসুর চিরকালই বিরোধী ছিলো; আবার সাম্প্রতিককালে এরা হঠাৎ হয়ে উঠেছে নব্য সুভাষভক্ত! তেমনি আদর্শগতভাবে চূড়ান্ত রবীন্দ্র-বিরোধী হ'লেও, তারা বর্তমানে রবীন্দ্রনাথের মূর্তিতে ও ছবিতে মাল্যদানের নাটকবাজিতে সক্রিয়।
'বিশ্বভারতী' সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য - "পুনরাবৃত্তি করিবা্র শিক্ষা মনের শিক্ষা নহে, তাহা কলের দ্বারাও ঘটিতে পারে।…বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য কাজ বিদ্যার উৎপাদন, তাহার গৌণ কাজ সেই বিদ্যাকে দান করা। বিদ্যার ক্ষেত্রে সেই-সকল মনীষীদিগকে আহ্বান করিতে হইবে যাঁহারা নিজের শক্তি ও সাধনা-দ্বারা অনুসন্ধান আবিস্কার ও সৃষ্টির কার্যে নিবিষ্ট আছেন।…বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের নকল করিয়া হইবে না।…এইরূপ আদর্শ বিদ্যালয়কে আমি 'বিশ্বভারতী' নাম দিবার প্রস্তাব করিয়াছি।' (বৈশাখ ১৩২৬)।
বিদ্যাকে যারা প্রতিমুহূর্তে পিছিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার সহ সকলকেই যারা 'বিশ্বাস'-ভিত্তিক 'জ্ঞান' সহযোগে তথাকথিত শিক্ষিত করতে তৎপর, 'বিশ্বভারতী'র তাৎপর্য তাদের মগজে প্রবেশ করা অসম্ভব।
রবীন্দ্রনাথ একসময়ে লিখলেন, "আজ কোনো কারণে বাংলার উৎপন্ন ফসলের প্রতি যদি মাড়োয়ারি দখল-স্থাপনের উদ্দেশে ক্রমশ প্রজার জমি ছিনিয়ে নিতে ইচ্ছা করে, তা হলে অতি সহজেই সমস্ত বাংলা তারা ঘানির পাকে ঘুরিয়ে তার সমস্ত তেল নিংড়ে নিতে পারে।" (প্রবন্ধ: 'রায়তের কথা' দ্রষ্টব্য।) আজ ভারতবর্ষে, বহুজাতিকের স্বার্থে চাষের জমি ছিনিয়ে নেবার এবং কৃষক সম্প্রদায়ের সর্বনাশ ঘটাবার ভয়ঙ্কর কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার বিরুদ্ধে মাসের পর মাস লাগাতার লাখো কৃষকের অভূতপূর্ব, জোটবদ্ধ ও তীব্র কৃষক আন্দোলন চলছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার অমানবিক নিষ্ঠুরতার সাথে সেই আন্দোলনরত কৃষকদের উপর দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। খবরে প্রকাশ, এখনও পর্যন্ত মৃত প্রতিবাদীর সংখ্যা অন্তত ৩০০ জন।
কৃষকের হিত এবং কৃষি উন্নয়নে চির-আগ্রহী রবীন্দ্রনাথ এদের চক্ষুশূল না হয়ে পারেন?
রবীন্দ্রনাথ কখনও কবিতায় লিখেছেন, "রিক্ত যারা সর্বহারা/ সর্বজয়ী বিশ্বে তারা,/ গর্বময়ী ভাগ্যদেবীর/ নয়কো তারা ক্রীতদাস।" ('হতভাগ্যের গান', ৭ আষাঢ় ১৩০৫); কখনও গানের মাধ্যমে বলেছেন, "যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন/ সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে/ সবার পিছে, সবার নীচে, সব-হারাদের মাঝে।" (১৯ আষাঢ় ১৩১৭); কখনও বিবৃতি দিয়েছেন, "সবচেয়ে গণতান্ত্রিক গভর্ণমেন্টও অত্যাচারী হয়ে উঠতে পারে যদি তার সন্ত্রাস প্রজাদের ঔদাসিন্য ও ভীরুতার প্রশ্রয় পায়।" (১৬ অক্টোবর ১৯৩৭); কখনও আবার চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, "কূটযুক্তিজালের পিছনে রহিয়াছে স্বদেশভক্তির এক বিকৃত আদর্শ; সেই আদর্শে বিভ্রান্ত হইয়া বর্তমান যুগের 'বুদ্ধিজীবীরা' তাহাদের আদর্শবাদের বড়াই করে এবং তাহাদের দেশের জনসাধারণকে ধ্বংসের পথ অবলম্বনে বাধ্য করে।" (১ সেপ্টেম্বার ১৯৩৮)
সঙ্ঘ পরিবারের মতো আপাদমস্তক "সব-হারাদের" বিরোধী, যুদ্ধপ্রিয়, "স্বদেশভক্তির বিকৃত আদর্শ" প্রচারকারী শক্তি এই রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সার্বিকভাবে মুছে দিতে চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর মৃত্যুর তিন মাস আগে (১৯৪১) "সভ্যতার সংকট" শিরোনামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। সেখানে তিনি লেখেন, "মস্কাও শহরে গিয়ে রাশিয়ার শাসনকার্যের একটি অসাধারণতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছিল -- দেখেছিলেম সেখানকার মুসলমানদের সঙ্গে রাষ্ট্র-অধিকারের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে অমুসলমানদের কোনো বিরোধ ঘটে না, …সোভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রিক সম্বন্ধ আছে বহুসংখ্যক মরুচর মুসলমান জাতির -- আমি নিজে সাক্ষ্য দিতে পারি, এই জাতিকে সকল দিকে শক্তিমান করে তোলবার জন্য তাদের অধ্যবসায় নিরন্তর।"
কট্টর কমিউনিস্ট-বিরোধী এবং আপাদমস্তক মুসলমান-বিরোধী সঙ্ঘ পরিবারের মোড়লবৃন্দ কীভাবে এই রবীন্দ্রনাথের বিরোধী না হয়ে থাকতে পারেন?
'হিন্দু ধর্ম'-র নামে কুৎসিত বিকারের তীব্রতম ও ধারাবাহিক সমালোচক, ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবীদের সহযোগী ও সমর্থক, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রশংসাকারী রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-চেতনা-কর্মকান্ড সর্বদাই বিজেপি-আরএসএস ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর আদর্শের গোড়াতেই মোক্ষম কুঠারাঘাত করে। ধর্ম, সম্প্রদায়, অর্থনীতি, শিক্ষা, রাজনীতি, সমাজচেতনা, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি যেকোনও বিষয়েই রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা সঙ্ঘপরিবারের সমগ্র 'আদর্শ'-কেই নস্যাৎ করে। সেই কারণে, এরা গভীরভাবে রবীন্দ্র-বিরোধী। কিন্তু বাংলার বুকে স্পষ্ট ভাষায় সে'কথা বলার মতো হিম্মৎ এদের আজও হয়নি। রবীন্দ্রনাথের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিও এদের দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ। তাই পশ্চিমবঙ্গের বুকে বিচিত্র ভড়ং এখন এদের নিরুপায় কর্মকৌশল। উত্তরপ্রদেশের পাঠ্যসূচী থেকে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের লেখা বাদ দিয়ে, গো-মাতার মহান সন্তান গরুদেব আদিত্যনাথের লেখা যোগ করতে এরা সাহসী হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় শান্তিনিকেতনের বুকে 'বিশ্বভারতী'-কে সুকৌশলে উঠিয়ে দেবার, এবং বিজেপি শাসিত সুদূর উত্তরাখন্ড রাজ্যের নৈনিতাল জেলায় অবস্থিত রামগড়-এ 'বিশ্বভারতী'-র "দ্বিতীয় ক্যাম্পাস" (Satellite Campus) তৈরির পরিকল্পনা নিশ্চিতভাবেই বাংলার বুক থেকে 'বিশ্বভারতী'-র প্রথম ও মূল ক্যাম্পাস-কে চিরতরে উঠিয়ে দেবার এক ধুরন্ধর হিসেবী উদ্যোগ। বিজেপি-নিযুক্ত বিশ্বভারতীর উপাচার্য মশাই স্বয়ং যখন বাঙালি কুলাঙ্গারের মতো সীমাহীন ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করে বলেন, "বিশ্বভারতী যাতে বন্ধ হয়ে যায় সেই ব্যবস্থা আমি করে দিয়ে যাবো।" ('আনন্দবাজার পত্রিকা', ১৭ মার্চ ২০২১, ডিজিটাল দ্রষ্টব্য) - তখন নিশ্চিতভাবেই বিজেপি দলের রবীন্দ্র-বিরোধী সুদূরপ্রসারী কু-মতলব ফাঁস হয়ে যায়।
বিভিন্ন সময়ে বর্তমান উপাচার্য মহাশয়ের বৈদ্যুতিক মন্তব্য, এবং গতবছর বিজেপি দলের কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন (HRD) মন্ত্রী (পরে শিক্ষামন্ত্রী) রমেশ পোখরিয়াল মহাশয়ের ব্যক্তিগত ও সক্রিয় উদ্যোগ এবং সাংবাদিক সম্মেলনের ঘোষণা, অনিবার্যভাবে সেই আশঙ্কারই জন্ম দেয়। ইনি বিশ্বভারতীর রামগড় ক্যাম্পাস সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে অতি উৎসাহী। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে, প্রয়োজনীয় জমি দেবে বিজেপি শাসিত উত্তরাখন্ড সরকার, এবং অর্থ যোগাবে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রসৃষ্ট 'বিশ্বভারতী'-র পল্লীউন্নয়ন ও সমাজসেবা সংক্রান্ত কাজকর্মের কার্যত বারোটা বাজিয়ে, বিজেপি শাসিত সুদূর উত্তরাখন্ড রাজ্যে প্রস্তাবিত বিশ্বভারতীর 'উপশাখা'য় (Satellite Campus) এইসব কাজের দুর্দান্ত সম্ভাবনার খতিয়ান যখন পেশ করা হয়, তখন অবশ্যই সংশয় আরও গভীর হয়! যে উপাচার্য মহাশয় "বিশ্বভারতী যাতে বন্ধ হয়ে যায়" সেই ব্যাপারে তৎপর, তিনিও "যতো শীঘ্র সম্ভব" রামগড় ক্যাম্পাসের কাজ করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন বিশ্বভারতীর জনৈক অধ্যাপক মহাশয়। ('দ্য টেলিগ্রাফ', ১৪ জুন ২০২০, ডিজিটাল দ্রষ্টব্য।)
বর্তমান বিশ্বভারতীতে বহু অবাঞ্ছিত ঘটনাই ঘটছে। কিন্তু মূল ও গভীরতর বিষয়, কেন্দ্রীয় স্তরে সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্র-বিরোধিতার তথা 'বিশ্বভারতী'-কে বিলুপ্ত করার, এবং মুখোশের আড়ালে থেকে বাঙালি-বিরোধিতার অশনি সংকেত।
বাংলা ও বাঙালিকে চিনতে-বুঝতে এইসব রবীন্দ্র-বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির এখনও হাজার বছর তপস্যা করতে হবে। রাজশক্তি, পেশীশক্তি ও অর্থশক্তির মিলিত দাপটে সাময়িক কোনও 'সাফল্য'-র নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেই পারে এরা। কিন্তু ক্রুদ্ধ বাঙালির মিলিত আত্মশক্তি সেই নেশার ঘোর কাটাতে বেশি সময় নেবে বলে মনে হয়না। অন্তত বাঙালির ইতিহাস সেই সাবধানবাণীই শোনায়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন -
"ভাবছ হবে তুমিই যা চাও, জগৎটাকে তুমিই নাচাও,
দেখবে হঠাৎ নয়ন খুলে হয়না যেটা সেটাও হবে।" (১৯০৯)
এই লেখার দু'বছর পরেই (১৯১১), বাঙালির বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের ধাক্কায় রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হয় সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা। এই সাবধানবাণী আজ আবার শাসকদের শোনানো প্রয়োজন।
মনে হয়, বাঙালির অবদান ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে মুছে দিতে মরিয়া কেন্দ্রের বিজেপি সরকার! খবরে প্রকাশ, গতবছর আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে ৪০০ জনেরও বেশি স্বাধীনতা-সংগ্রামীর নাম লেখা প্রস্তরফলক সরিয়ে দিয়েছে তারা। যার মধ্যে বিপুল সংখ্যাধিক্যই বাঙালি। গতবছর ১৮ সেপ্টেম্বর এই ফলক সরানো নিয়ে রাজ্যসভায় প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয়েছিলো কেন্দ্রীয় সরকারকে। নানা প্রস্তর ফলকে খোদিত ৩৮৪ জন বাঙালি স্বাধীনতা-সংগ্রামীর নাম স্বচক্ষে দেখেছি। সে ফলকগুলো এখনও আছে কিনা, থাকলেও তাদের আয়ু কতদিন, জানিনা! পর্যটক, ছাত্রছাত্রী, গবেষক, প্রশাসক ইত্যাদি কেউই যেন স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের আসল পরিচয় জানতে না পারে, তার জন্য লক্ষনীয়ভাবে তৎপর বর্তমান শাসকগোষ্ঠী। বাংলা, পাঞ্জাব, বম্বে, মাদ্রাজ, 'ইউনাইটেড প্রভিন্স', বিহার, আসাম ইত্যাদি বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের নাম দেখেছি ফলকে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, গুজরাট অঞ্চলের একটিও নাম সেখানে ছিলো না।
রবীন্দ্রনাথ এইসব দুর্গম অগ্নিপথের যাত্রীদের সম্পর্কে লিখেছিলেন, "দেশভক্তির আলোকে বাংলাদেশে কেবল যে চোর-ডাকাতকে দেখিলাম তাহা নহে, বীরকেও দেখিয়াছি। মহৎ আত্মত্যাগের দৈবী শক্তি আজ আমাদের যুবকদের মধ্যে যেমন সমুজ্জল করিয়া দেখিয়াছি এমন কোনোদিন দেখি নাই। ইহারা ক্ষুদ্র বিষয়বুদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিয়া প্রবল নিষ্ঠার সঙ্গে দেশের সেবার জন্য সমস্ত জীবন উৎসর্গ করিতে প্রস্তুত হইয়াছে। এই পথের প্রান্তে কেবল যে গবর্মেন্টের চাকরি বা রাজসম্মানের আশা নাই তাহা নহে, ঘরের বিজ্ঞ অভিভাবকদের সঙ্গেও বিরোধে এ রাস্তা কন্টকিত। আজ সহসা ইহাই দেখিয়া পুলকিত হইয়াছি যে, বাংলাদেশে এই ধনমানহীন সংকটময় দুর্গম পথে তরুণ পথিকের অভাব নাই।" (প্রবন্ধ: 'ছোটো ও বড়ো' দ্রষ্টব্য।)
মুসলমান ও হিন্দু, উভয় তরফের উগ্র সাম্প্রদায়িক অংশের সহযোগিতায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা বাংলা ভাগ করতে পেরেছিলো। ব্যাপক সাধারণ বাঙালি জনগণের বিন্দুমাত্র ভূমিকাও ছিলোনা এ'ব্যাপারে। রবীন্দ্রনাথ আজও মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে সকল বাঙালির সবচেয়ে বড়ো শিক্ষক, অনুপ্রেরণা ও ঐক্যসেতু। সাম্প্রতিক বাংলাদেশ-এ রবীন্দ্র-চর্চার ব্যপ্তি ও গভীরতা সঙ্ঘ পরিবারের কপালে ভাঁজ ফেলতেই পারে। 'বিশ্বভারতী'-কে আদর্শ মেনে "রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়"-ও গড়ে উঠেছে সেখানে। প্রশাসনিক খাঁড়ার আঘাতে 'বিভক্ত' (!) বাঙালি জাতি কিন্তু কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য-র আবেগে আজও 'ঐক্যবদ্ধ' বাংলার স্বপ্নকে লালন করে। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সকলের কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার তীর্থক্ষেত্র 'বিশ্বভারতী'-কে তথা বিশ্বমানবতার মহৎ প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে সর্বতোভাবে রক্ষা করা বাঙালির অন্যতম কর্তব্য।
বাঙালি অলস, বাঙালি নিদ্রামগ্ন, বাঙালি আত্মবিস্মৃত … সবরকম তিরস্কারই বাজারে চলতে পারে। কিন্তু বাঙালির আত্মযমর্যাদায়, আত্মগৌরবে ও স্বাধীনচেতনায় আঘাত হানলে তাঁরা কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, তা একসময়ে হাড়েহাড়ে বুঝেছিলো গর্বোদ্ধত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা, এবং আধুনিক কালে পাক্ সেনারা। 'মুসলমান' পূর্ববঙ্গ যখন মুসলমান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই করতে গিয়ে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে, অকাতরে ৩০ লক্ষ বাঙালি প্রাণ দিলো, তখনও এই সত্য আবার ইতিহাসে মান্যতা পায়। ব্রিটিশের আশীর্বাদপুষ্ট, তাদের একান্ত বশম্বদ ও স্তাবক শাসকরাও যতো শীঘ্র এই সত্য উপলব্ধি করতে পারে, ততই তাদের নিজেদের মঙ্গল। ধর্ম ও জাতগত ভেদাভেদের ঊর্দ্ধে উঠে, ঐক্যবদ্ধ বাঙালির রুদ্রমূর্তি তা'হলে তাদের আর দেখতে হবেনা।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী উত্তাল আন্দোলনের ইতিহাস ভালোভাবে জানা থাকলে কেউ আর রবীন্দ্রনাথ এবং বাঙালি জাতির আবেগকে উপেক্ষা করার স্পর্ধা দেখাতে সাহস পাবেনা। রবীন্দ্র-বিরোধিতার সাম্প্রদায়িক স্বপ্নও উবে যাবে তখন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গুরুদাস ব্যানার্জী, আনন্দমোহন বসু, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বিপিনচন্দ্র পাল, তারকনাথ পালিত, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রাসবিহারী ঘোষ, সখারাম গণেশ দেউস্কর, আব্দুল রসুল, আব্দুল হালিম গজনভি, 'মহমেডান সেন্ট্রাল অ্যাসোসিয়েশন'-এর মহম্মদ ইউসুফ খান থেকে শুরু করে বরিশালের অশ্বিনীকুমার দত্ত, নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়, ঢাকার নবাব আত্তিকুল্লাহ্, ময়মনসিংহের আচার্য চৌধুরীরা, গুরু নানকের বংশধর সর্বোচ্চ শিখ ধর্মযাজক বাবা কাউর সিং, প্রমুখ - সকলেই সেদিন বাংলা-ভাগের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলনের অংশীদার ছিলেন। ১৯০৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে, কলকাতায় সংগঠিত প্রতিবাদ সভায় জড়ো হয়েছিলেন পঞ্চাশ হাজার মানুষ। সমবেত কন্ঠে সেখানে গান হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত- "এবার তোর মরা গাঙ্গে বান এসেছে, 'জয় মা' ব'লে ভাসা তরী" - মাতৃভূমি 'বাংলা'-কে রক্ষার সমবেত শপথ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের হাতে-হাতে বাঁধা হয়েছিলো রাখী। বাবা কাউর সিং-এর হাতে রাখি বেঁধেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। সেদিনই সূচনা হয়েছিলো বাঙালি জাতির ঐক্য-প্রতীক 'Federation Hall' ভবন ('মিলন মন্দির') প্রতিষ্ঠার। ইংরেজি নামকরণ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের, বাংলা অনুবাদ ভগিনী নিবেদিতার। স্পর্ধিত শাসকের "Unsettled fact"-কে বাঙালি সেদিন গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।
বিশেষভাবে লক্ষণীয়, এই পার্টিশন-বিরোধী আন্দোলনের পর থেকেই শুরু হয় ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের প্রয়াসও।
জীবন সায়াহ্নে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "এমন ভুল কেউ যেন না করেন যে, বাংলাদেশকে আমি প্রাদেশিকতার অভিমানে ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাই, … সমগ্র ভারতবর্ষের কাছে বাংলার সম্মিলন যাতে সম্পূর্ণ হয়, মূল্যবান হয়, পরিপূর্ণ ফলপ্রসূ হয়, যাতে সে রিক্তশক্তি হয়ে পশ্চাতের আসন গ্রহণ না করে, তারই জন্যে আমার এই আবেদন।" (মাঘ ১৩৪৫-এ রচিত 'দেশনায়ক' প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।) রবীন্দ্র-বিরোধী সাম্প্রদায়িক শাসকদের কাছে সেটা তো আরও দুশ্চিন্তার!
রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতি সহ সমগ্র মানবজাতির অনুপ্রেরণা, সাহস, আদর্শ ও শক্তি। তাঁর উপর যদি আঘাত আসে, বাঙালির পুঞ্জিভূত আবেগ ও ক্রোধ তখন কিন্তু শুধুমাত্র শান্তিনিকেতন ও 'বিশ্বভারতী'-কে ঘিরে আবর্তীত হবার সম্ভাবনা খুবই কম। তখন সমগ্র বাঙালি জাতি আবার উত্তাল প্রতিবাদে ফেটে পড়বার সম্ভাবনাকে একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায়না। সেটাই হয়তো সেদিন অনেকের ঘুম ছুটে যাবার প্রধান কারণ হয়ে উঠতে পারে।