বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

সিলিকোসিস: উন্নয়নের পাথরকুচি ও তিলে তিলে মৃত্যুযাত্রা

সিলিকোসিস: উন্নয়নের পাথরকুচি ও তিলে তিলে মৃত্যুযাত্রা

পূবালী রাণা

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ অক্টোবর, ২০২১—
"শ্রমিকের ঘামে কোটিপতি
শ্রমিকের ঘামে বিলাস বাড়ি
শ্রমিকের ন্যায্য মূল্য চাইলে
হাতে ডাণ্ডাবেড়ি"

না, স্বনামধন্য কোনও কবি এ লেখা লেখেন নি। এ লেখা লিখেছেন নাসির। শ্রমজীবী নাসির। যে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে যেতেও পা মেলায় হক বুঝে নেবার মিছিলে। গলা মেলায় শ্রমিকের অধিকারের দাবি তোলা স্লোগানে। নাসির খুব খুব খুব করে চায় ওর মতো আর যেন কেউ না আক্রান্ত হয় সিলিকোসিসের মতোন মারণ রোগে। ওর মতো আর যেন কোনও মানুষকে না মরে যেতে হয় হাপরের মতো শ্বাস টানতে টানতে একটু অক্সিজেনের অপেক্ষায়।

নাসির ভীষণ ভাবে বেঁচে থাকতে চায়। ওর সব থেকে বেশি চাওয়া বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার। ওর ছ’মাসের বাচ্চাটার কোনও অপরাধ নেই। নাসিরের অপরাধ ও শ্রমের বিনিময়ে ভাতের জোগান চেয়েছিল।

নাসির জানতো না সিলিকোসিস কী রোগ। কিভাবে হয় এই মারণব্যাধি? কারা দায়ী এই রোগের জন্য? আসুন, একটু জানার চেষ্টা করি।

"সিলিকোসিস"- এই শব্দটা এসেছে "সিলিকন" বা বালির কণা থেকে। পাথর খাদান, কয়লা সহ বিভিন্ন খনি, পাথর কাটার কারখানা, সিমেন্ট কারখানা, মূর্তি গড়ার কারখানা, এমনকি ইঁট ভাটায় দিনের পর দিন কাজ করেন যাঁরা, তাঁদের শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে জমা হয় পাথরের গুঁড়ো, কয়লার গুঁড়ো, ইঁট বা বালির গুঁড়ো। ফুসফুসে যে ভালভ বা বেলুনগুলো থাকে, সেগুলো অকেজো হয়ে যায়। ফলে শ্বাস নেবার ক্ষমতাটুকুও থাকে না আক্রান্ত মানুষের। কিন্তু এই রোগের কি চিকিৎসা নেই? সুস্থ করে তোলা যায় না সিলিকোসিস আক্রান্ত মানুষকে? ক্যানসার, এডস্ এর মতো রোগের বিরুদ্ধেও তো চিকিৎসা বিজ্ঞান বিরাট সাফল্য পেয়েছে। তাহলে সিলিকোসিসের ক্ষেত্রে?

সিলিকোসিসে আক্রান্ত হন যে মানুষরা তাঁরা কি স্বাস্থ্য ও জীবন কিনতে পারেন? মুনাফা ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থায় সিলিকোসিসের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন দামী দামী ওষুধ। দিনে দু’তিনশো টাকা রোজগার করা মানুষগুলোর পক্ষে তা সম্ভব না। সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে কাজ হারানো নাসির, রহমান, সুবর্ণ গায়েনদের পক্ষে সম্ভব না দামী ওষুধ কিনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

যেহেতু কেনার ক্ষমতা নেই, তাই বাজার নেই। তাহলে সিলিকোসিসের ওষুধ বা সিলিকোসিস চিকিৎসার জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার উৎপাদনই নেই।

তাই বলে কি সভ্যতার নামে নিষ্ঠুরতা থেমে থাকতে পারে? নির্মাণ বন্ধ হতে পারে? তাই পিরামিড, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, তাজমহলের মতো আশ্চর্যের তালিকায় নাম তোলার জন্য তেরো হাজার কোটির সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রোজেক্টের নির্মাণ থেমে থাকে না লকডাউনেও। হলফ করে বলছি, এই সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রোজেক্টে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের অনেকেই আক্রান্ত হবেন সিলিকোসিসে। তবে তার জন্য তো ভবিষ্যতের অপেক্ষা করতে হবে।

আপাতত সিলিকোসিস রোগের ইতিহাস প্রাথমিকভাবে জানা যাক। মিশরে প্রায় পাঁচ হাজার বছর অতীতে যে প্রকাণ্ড সব পিরামিড তৈরি হয়েছিল, তার ভিতর থেকে যে মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে, বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জেনেছেন, সেই সমস্ত শ্রমিকদের মৃত্যু হয়েছে এই মারণরোগে। গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রিটাস গ্রীসের খনি শ্রমিকদের মধ্যে যে রোগের কথা বলেছেন তাতে তাঁরা আক্রান্ত হয়েছিলেন পঞ্চম খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে। সুতরাং আন্দাজ করা যায়, এই রোগের ইতিহাস কতোটা প্রাচীন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে শিল্প বিপ্লবের সময়। ১৮৩০ সালে সাধারণভাবে রেলওয়ে সার্ভিস চালু হয়। ১৮৫০ নাগাদ বাণিজ্যিকভাবে ইস্পাত উৎপাদন শুরু হয়। শুরু হয় মেশিনের জয়জয়কার। হাতুড়ির পরিবর্তে চলে আসে স্টিমড্রিল। উঠতে থাকে পাথর ভাঙার ধুলোর ঝড়।

১৮৭০ সালে পশ্চিম ভার্জিনিয়ার স্টিমড্রিল বিগ টানেলে জন হেনরীর জীবন শেষ হয়েছিল সিলিকোসিস আক্রান্ত হয়েই। ১৯০১-০২ সাল নাগাদ দক্ষিণ আফ্রিকার Rand খনিতে চার বছরে ২০০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ক্রমশ সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সিলিকোসিস নিয়ে চর্চা শুরু হতে থাকে।

১৯৩০ সালে জোহানেসবার্গে হয় ইন্টারন্যাশনাল লেবার অফিস (ILO)। ১৯৫০এ অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক নিউমক্কোনিওসিস কনফারেন্স। ১৯৯২ সালে ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন অকুপেশনাল লাঙ ডিসিজেস অনুষ্ঠিত হয়। সিলিকোসিস নিয়ে আন্তর্জাতিক দরবারে কিছুটা চর্চা শুরু হয়। কিন্তু তারপরেও ২০০৩ সালে আমেরিকা জানায়, তাদের দেশের ১৭ লক্ষ শ্রমিক বিপদজনক সিলিকা কণার বিপদের মুখোমুখি — যাঁদের মধ্যে অন্তত দু’লক্ষ আক্রান্ত এই মারণরোগে। এবার চলে আসা যাক ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে।

১৯৩৪ সালে কোলর স্বর্ণখনিতে প্রথম সিলিকোসিস আক্রান্তের খবর জানা যায়। তারপরেও যথাক্রমে চোদ্দ বছর এবং আঠারো বছর লেগে যায় ফ্যাক্টরি আইন এবং খনি আইন প্রণয়ন করতে। সিলিকোসিসকে অবহিত করার মতো (Notifiable Disease) হিসাবে ঘোষণা করা হয়। যার অর্থ সিলিকোসিস একটি পেশাগত রোগ এবং কোনও শ্রমিক এই রোগে আক্রান্ত হলে মালিকপক্ষ সরকারকে তা জানাতে বাধ্য।

কিন্তু শুধু আইনই হয়েছে। সরকারের পর সরকার বদল হয়েছে। কাজের কাজ কি কিছু হয়েছে? সিলিকোসিসে আক্রান্ত রহমান যখন তাঁর আসানসোলের মার্বেল পাথর কারখানার মালিকের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইতে গেলেন, মালিক মুখের ওপরে দেয় "তোমাকে তো চিনি না"!

এই ঘটনাই মনে করিয়ে দেয় যক্ষপুরীর সেই মজুরদের কথা। মনে করিয়ে হীরক রাজার দেশের খনি মজুরদের কথা। যাঁদের পরিচয় তাঁদের নাম্বারে। আর ঠিক এই দুটো পরিস্থিতির সঙ্গে কী দারুণ মিল দেখতে পাওয়া যায় আমাদের সরকার বাহাদুরের কাজকর্মে। গোটা দেশের মানুষকেই তাঁরা নম্বরে পরিণত করেছেন। তাই কবি লেখেন,
"অবিকল যক্ষপুরী, কেন হে প্রশ্ন করো?
আধারের সংখ্যার হয়ে আঁধারে গুমরে মরো"।

দিল্লির লালকুয়া এলাকায় সিলিকোসিসে আক্রান্তের মৃত্যুকে নিয়ে হইচই শুরু হয় ৯০এর দশক থেকে। প্রসার গ্রামের একটি সংগঠন মামলা করে। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, অন্তত কিছু সংবেদনশীল মানুষের চোখে পড়ে বিষয়টা। খানিকটা ভাবনাচিন্তা, সচেতনতা শুরু হয়। প্রায় কাছাকাছি সময়ে পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রামের চিঁচুড়গেড়িয়া গ্রামে বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু ঘটে। মালপানিদের খাদান আর কারখানায়। নাগরিক মঞ্চ নামের সংগঠনটি দীর্ঘ আট-নয় বছর আইনি লড়াই চালানোর পর ১১ জন মানুষকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয় মালিক কর্তৃপক্ষ। ভারতে সেই প্রথম সিলিকোসিস একটি মারণরোগ হিসেবে চিহ্নিত হয়। মালিকপক্ষ এই প্রথম বাধ্য হয় ক্ষতিপূরণ দিতে।

৮০র দশক থেকে মধ্যপ্রদেশ থেকে দলে দলে আদিবাসী মানুষ অভ্র খনিতে কাজ করতে যেতেন। ফিরে আসতেন কাশতে কাশতে। তারপর একসময় সবার চোখের আড়ালে অভ্যাসমতো মরে যেতেন। কিন্তু এতো দিনে মানুষের নজর ঘুরলো। অনেকগুলো সংগঠন মিলে আদালতের শরণাপন্ন হলেন। সেই মামলা অবশ্য আজও চলছে। কিন্তু তফাৎ হল, এখন বিষয়টাকে বৈজ্ঞানিক ভাবে দেখার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে। সুপ্রিমকোর্টে প্রশ্ন উঠেছে, কিভাবে এই অবৈধ কারখানাগুলো চলে? সরকার কেন এসব কিছুর জন্য জবাবদিহি করবে না? কেন বন্ধ করা হবে না এই সব কারখানা? উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে মানবাধিকার কমিশন। তারা বারবার তদন্ত-অনুসন্ধান করে সরকারকে সাবধানবাণী শুনিয়েছেন। আক্রান্ত মানুষদের দায়িত্ব নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সরকার সেই সাবধানবাণীকে অবহেলা করেছেন। বাধ্য হয়ে তাঁরা আদালতের কাছে প্রশ্নগুলো বড় করে তোলার চেষ্টা করছেন। "উন্নয়নের জন্য তো পাথরকুচি লাগবেই" বলে আর শ্রমিক সুরক্ষার প্রশ্নটাকে পাশ কাটানো যাচ্ছে না। উন্নত দেশগুলো উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সমস্যাটাকে ধামাচাপা না দিয়ে নানা উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে এই ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যু কমিয়ে আনতে পেরেছে।

ভারতে অবশ্য মুনাফার লোভে সমস্যাটাকে নিঃশব্দে চালান করে দেওয়ার অভ্যেস জারি আছে। জারি আছে একটা সিস্টেম। যে সিস্টেমের শরিক উপর তলা থেকে নীচ তলা।

সরকার-প্রশাসন চাইলে পারে না এই অবৈধ কারখানাগুলো বন্ধ করতে? রাজনৈতিক দলগুলো এই নিয়ে সোচ্চার হতে পারে না?

কিন্তু ওঁরা পারেন। যাঁরা নিজেরাই আক্রান্ত এই মারণব্যাধিতে। যাঁদের পরিবারের মানুষ আক্রান্ত এই রোগে। কিন্তু সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকরা অসংগঠিত। তাই প্রথমেই সংগঠিত করা দরকার তাঁদের। কারণ সংখ্যার ব্যাপ্তি যতো বাড়বে, ততো বেশি করে চাপ তৈরি করা যাবে প্রশাসনের উপর।

এই মুহূর্তে ভারতে প্রায় দেড় কোটি মানুষ আক্রান্ত সিলিকোসিসে। আরো দেড় কোটি শ্রমিক পাথর খাদানে কাজ করে চলেছেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন সিলিকোসিসের মৃত্যু ফাঁদের দিকে।

সরকার চুপ, মিডিয়া চুপ। এমনকি ভারতের অসংখ্য কমিউনিস্ট পার্টি, তারাও কি ভুলে গেছে শ্রেণীর লড়াই লড়তে?

শুধুমাত্র উত্তর এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ৩০টি গ্রামের প্রায় ৭০০র বেশি মানুষ সিলিকোসিসে আক্রান্ত। এঁরা প্রায় সকলেই ছিলেন কৃষিজীবী বা কৃষি শ্রমিক। আয়লার পর যখন নোনা জল ঢোকায় জমি চাষ করার উপযোগী থাকলো না, তখন ধীরে ধীরে কাজ নিলেন বিভিন্ন পাথর খাদান, পাথর কাটার কারখানায়। তারপর একসময় সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে ফিরে এলেন গ্রামে। মারা গেছেন ৪১ জন। যে কোনও মুহূর্তে মারা যেতে পারেন আরো কেউ কেউ।

তবে আশার কথা ধীরে ধীরে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া এই শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলেছেন সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি বা (SASSC)। আক্রান্ত গ্রামের মানুষরাই এই কমিটির সমস্ত পদে আছেন।

যদিও এই দুই অঞ্চলের মানুষ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বহু মানুষ সিলিকোসিসে আক্রান্ত। তাঁদের কাছে এখনো কোনও সাহায্য পৌঁছনো সম্ভব হয় নি।

সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিক সংগ্রাম কমিটি দীর্ঘদিনের নাছোড় লড়াই চালিয়ে সিলিকোসিসে আক্রান্ত মৃতের পরিবারের জন্য চার লক্ষ টাকা এবং অসুস্থদের চিকিৎসার জন্য দু' লক্ষ টাকার দাবি জানিয়ে আসছে। ভারতের মানবাধিকার কমিশন সিলিকোসিসে মৃত শ্রমিকদের পরিবারকে অবিলম্বে চার লক্ষ টাকা দেওয়ার সুপারিশ করেছে।

বলছে হেঁকে শ্রমিক ভাই/ শ্রমিক খুনের শাস্তি চাই, “বলছে হেঁকে শ্রমিকের ছেলে/ খাদান মালিক ঢুকবে জেলে।” কিম্বা “খাদান শ্রমিক দিচ্ছে ডাক/ অবৈধ খাদান নিপাত যাক।”

গিয়াসউদ্দিন, আবুল, স্মরজিৎ, খুদেরা জন হেনরির উত্তরসুরি। গত বছর ২৫ অক্টোবর ওঁদের মা বাবা স্ত্রী সন্তানরা রাস্তা কাঁপালো এরকম আরো অনেক স্লোগান তুলে। সমস্ত প্রতিবন্ধতাকে জয় করে আকাশ কাঁপিয়ে এগিয়ে চলেছিল বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী শ্রমিকদের মিছিল।


তাঁদের দৃপ্ত ভঙ্গিমা, বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, দেহের ভাষা, গলা শিরা তোলা স্লোগান বার্তা দিচ্ছিল “একদিন স্বপ্নের ভোর আসবেই...।”

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.